পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনার মৃত্যুর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অন্যান্য মৃত্যুর মিছিল, লঞ্চডুবি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে, কিন্তু কোনো তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে নাই বা তদন্তের আলোকে ফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা তাও জনগণ জানে না। তবে এবারে পোস্তখোলার লঞ্চ দুর্ঘটনাকে নৌ প্রতিমন্ত্রী হত্যা বলে মন্তব্য করেছেন। এখন দেখা যাক, হত্যাকারী এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারী সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী পরিমাণ শাস্তি কার্যকর হয়। মাদক কারবারী বা চিহ্নিত সন্ত্রাসীর এনকাউন্টারে মৃত্যু এবং প্রতিনিয়ত বর্ডার এলাকায় ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশিদের হত্যার সংবাদ সমভাবে, সমমেজাজে দেশবাসী গ্রহণ করে না। কারণ বর্ডারে বাংলাদেশি হত্যা (যার প্রতিবাদ শুধু ফ্লাগ মিটিংয়ে সীমাবদ্ধ) প্রতিটি দেশবাসীর মন-মগজে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে। বিনা পাসপোর্টে বর্ডার ক্রস করলে কি কোনো দেশে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়? কোনো ব্যক্তি যদি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে তখন তো কোনো ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড গুলি করে হত্যা করে না। হৃদয় নিংড়ানো স্বাধীনতা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায় যখন বর্ডার এলাকায় বাংলাদেশিকে ভারতীয় বাহিনী ঠুনকো অজুহাতে হত্যা করে। কোনো কারণেই কালোবাজার, স্মাগলিং বা অবৈধ পন্থায় বর্ডার ক্রসকে সমর্থন করা যায় না, কিন্তু এর অর্থ কি বর্ডার ক্রস করলেই হত্যার জন্য গুলি? এর জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা বা বিধান চালু করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কি কোনো প্রকার দায়-দায়িত্ব নাই?
মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে ‘বজ্রপাত’, যার উপর বিজ্ঞানীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। তবে পবিত্র কোরান শরীফে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। গত তিন বছরে বজ্রপাতে মৃত্যু সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মিডিয়ার তথ্য মতে, চলতি বছর দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ এর কাছাকাছি। এপ্রিলে ২১ জন হলেও শুধু মে মাসের এক-তৃতীয়াংশ সময়ে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মারা যান ৭৬ জন। ২০১৭ সালের একই সময়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩২ জন। এর আগের বছর ছিল ৪৩ জন। ওই বছর প্রায় ৩৫০ জন মারা যাওয়ায় সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রস্তুতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। শোনা গিয়েছিল যে, এজন্য বিভিন্ন এলাকায় তালগাছ রোপণ করা হবে। কিন্তু পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয় নাই।
‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হিসাবে সরকারের এক নতুন ঘোষণা জনগণের উপর আভির্ভূত হয়েছে। ঘোষণাটি হলো করোনা টেস্ট করাতে নির্ধারিত বুথে গিয়ে স্যাম্পল দিলে জনপ্রতি ২০০/- এবং বাড়ি থেকে স্যাম্পল দিলে জনপ্রতি ৫০০/- টাকা ফিস দিতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে করোনা পরীক্ষা করার ফিস নির্ধারণ করা হয়েছে কি? মিডিয়াতে এ মর্মে কোনো সংবাদ চোখে পড়ে নাই। তবে পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ বা ভারতে নাগরিকদের অর্থনৈতিক অবস্থান চিন্তা করলে তা বিবেক সম্পন্ন হবে না। কারণ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যের অভিশাপে জর্জরিত। যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় তাদের পক্ষে কি ২০০/- টাকা ফিস দিয়ে করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব? উপরোক্ত আদেশে সাধারণ দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ করোনা টেস্ট করাতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারের অবশ্যই বুঝা উচিৎ ছিল যে, আমাদের দেশের কত পারসেন্ট লোক সমাজ বা স্বাস্থ্য সচেতন? এতো প্রচার প্রচারণার পরেও মিডিয়া খুললেই দেখা যায় যে, শত-হাজার লোক মাস্ক ছাড়াই বাজারে, রাস্তাঘাটে ঘুরাফিরা করছে। সংক্রমণ ঠেকাতে হলে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে করোনা টেস্ট করানো দরকার। নতুবা গোপনভাবে করোনা সংক্রমিত হতেই থাকবে। কারণ কিছু করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে যার কোনো প্রকার উপসর্গ না থাকলেও করোনাতেই মৃত্যু বরণ করছে। সচেতন থেকে চিকিৎসকরা যেখানে মৃত্যুবরণ করছে, সুস্থ-সবল স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া স্বত্তে¡ও পুলিশ যেখানে আক্রান্ত হচ্ছে, সেখানে খেটে খাওয়া মানুষ দ্বারা গোটা দেশবাসী সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারের উচিৎ হবে ২০০/৫০০ টাকার বিনিময়ে করোনা টেস্ট পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়া। অন্যথায় এ দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। সরকার যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছে সেখানে ফি নিয়ে করোনা টেস্টের সিদ্ধান্ত একটি হাস্যকর ঘটনা বটে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলতেন, ‘গরিব নেহি, গরিবী হটাও’। বাস্তবে ভারতে গরিবী হটেনি, গরিবই বরং হটে গেছে। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে এখন চলছে গরিব হটানোর অদৃশ্য প্রকল্প। মানুষ কি পরিমাণ গরিব হলে নিজের কিডনি বিক্রি করে? একটি জেলার একই এলাকায় ১৬ জন ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেছে, যার সংবাদ চাউর হওয়ার পর মামলা হয়েছে। কিডনি বিক্রয় প্রবণতার হিড়িক রোধ করার জন্য হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন। বলেছেন, শুধুমাত্র নিকট আত্মীয়কে কিডনি দেয়া যাবে। স্বেচ্ছায় কিডনি দিয়ে কোনো স্বজনকে যদি বাঁচানো যায়, তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু আপত্তি উঠে তখনই যখন সরকার বলে যে, বাংলাদেশ গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি তাই হয় তবে কেন এদেশের মানুষের ক্ষুধার জ্বালা মিটাতে কাঠের নৌকায় বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরেই সলিল সমাধি হচ্ছে? পিতামাতা তাদের শিশু সন্তানদের গলাটিপে হত্যা করছে। এর পিছনে কি শুধু পারিবারিক কলহ দায়ী, না কি অভাব-অনটন থেকে এ হত্যার সূত্রপাত? যে পরিবারে দু’বেলা অন্ন জোটে না সে পরিবারে বিবাদ-কলহ ছাড়া আর কি থাকতে পারে?
প্রতিটি সিগনালে গাড়ি থামলে যখন অসহায় ভিক্ষুকদের দেখি তখন রাজধানীর চাকচিক্য ম্লান হয়ে যায়। জুমার নামাজে প্রতিটি মসজিদের সামনে ভিক্ষুকদের জটলা, যাদের হাড্ডিসার বদন এবং ক্ষুধার্থ চেহারা দেখলে সরকারের প্রচারিত ‘উন্নয়নের চেহারা’ কালো ছায়ায় ঢেকে যায়। সরকার এ ধরনের কথা প্রচার করে নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য, কিন্তু সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করে বহুগুণে শুধুমাত্র সরকারের কিছু বদনত্যার প্রত্যাশায়। তবে তাদের এ প্রত্যাশা বিফলে যায় নাই, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ ছেড়ে এখন তারা পাজারো গাড়িতে চড়ে। বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক, তারাই যখন স্বার্থ হাসিলের জন্য বিক্রি হয়, তখন ভুক্তভোগী মানুষেরা তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনাকে নিয়তির খেলাই মনে করে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন এবং প্রতিটি নাগরিকের অংশীদারিত্বের দাবি এখন আর কেউ করে না, যা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি। তবে সে প্রতিশ্রুতি একেবারে বিফলে যায় নাই। কারণ একটি শ্রেণি এককভাবে ধনী হয়েছে, এখন তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বিত্তশালী হয়েছে, বাকীরা রয়েছে প্রতিযোগিতায়, কার আগে কে শত কোটি টাকার মালিক হতে পারবে। এর পিছনে রয়েছে ব্যাংক লুট, মানি লন্ডারিং, বিদেশে রাজ প্রসাদ নির্মাণ প্রভৃতি। অনেকেরই পরিবার এখন বিদেশে নিজস্ব প্রাসাদে বসবাস করে, বেগম পাড়া নামে ধনী ললনাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বিদেশে রয়েছে। বেশি কথা বলে এমন একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি ঘরনার রাজনীতিবিদ (বিনা ভোটে নির্বাচিত এম.পি) দেশে করোনা দুঃসময়ে পাড়ি জমিয়েছেন কানাডায়, তার জবানীতেই দেশবাসী জানতে পারলো তার পরিবারবর্গ কানাডায় থাকে, অথচ মুখে যখন তার খৈ ফুটতো তখন বুঝা যেতো যে তার চেয়ে দেশপ্রেমিক আর কেউ নাই।
সরকার পাটকল শ্রমিকদের এড়ষফবহ ঐধহফ ঝযধশব এর মাধ্যমে বাধ্যতামূলক চাকরি থেকে বিদায় করে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনাশিপ ভিত্তিতে পাটকল পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাট শ্রমিকদের দাবি বড় বড় আমলাদের চুরি ও দুর্নীতির কারণে পাটকলে লোকসান হচ্ছে। সরকারি প্রেস নোট মোতাবেক লোকসান দিয়ে দীর্ঘদিন পাটকল সরকারের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। আমলাদের পুকুর চুরির ঘটনা কারো অজানা নেই। সরকার আমলাদের চুরি বন্ধ করতে পারছে না এবং এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। কারণ, সরকার যখন আমলানির্ভর হয়ে পড়ে তখন চোখের সামনে চুরি হলেও নির্বাক হয়ে যায়, যেহেতু আমলারাই সরকার টিকিয়ে রখেছে বলে একটি পাবলিক পারসেপশন বাজারে চালু আছে, যার সত্যতাও অবশ্যই রয়েছে।
প্রাইভেট পাবলিক যৌথভাবে পাটকলগুলি চালানোর সরকারের যে যুক্তি তা একটি শুভঙ্করের ফাঁকি মাত্র। প্রাইভেট অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা। এ জুট মিলগুলি এখন ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করা হবে যাদের টাকা আছে তারাই ইড়ড়শ গড়হবু দিয়ে পানির দরে মিলগুলি কেনার সুযোগ পাবে। বিত্তশালীদের অলস টাকা (ওফষব গড়হবু) ব্যবহারের একটি সুযোগ সরকার করে দিলো। ফলে টাকাওয়ালারা আরো বিত্তশালী হবে বটে, কিন্তু পাটকল শ্রমিকদের পরিবারগুলি নিঃস্ব হয়ে যাবে। গত ২০ বছর পূর্বে যে ব্যক্তি ১০ বিঘা জমির মালিক ছিল, সংসারের ঘানি টানতে যেয়ে জমি বিক্র করে নিঃস্ব হয়েছে এবং যে ২০০ বিঘা জমির মালিক ছিল সে হয়েছে ৫০০ বিঘা সম্পত্তির মালিক। এমনিভাবে বিভিন্ন সেক্টর ওয়াইজ গরিবকে নিঃস্ব, অন্যদিকে ধনীদের আরো বিত্তশালী করার অদৃশ্য পরিকল্পনা এগিয়ে যাচ্ছে।
অর্থ উর্পাজনের জন্য মানুষ বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা (যারা সমাজে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত) লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে অসচ্ছ ও অসাধু প্রতিযোগিতায় নেমেছে। হাসপাতাল চালু করেছে সেবার উদ্দেশ্যে নয়, বরং মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিংড়ানোর একটি ফাঁদ পাতা হয়েছে। ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে যে, করোনা ভাইরাসের ভুয়া নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে টাকা আদায় করে নিচ্ছে। তবে কি টাকা কামানোর প্রতিযোগিতায় মানুষ পশুর চেয়েও নীচে নেমে গেলো? ডাকাত ডাকাতি করে, চোর চুরি করে সমাজে ডাকাত বা চোর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এ রক্ত পিপাসুদের সমাজ কোন বিশেষণে চিহ্নিত করবে?
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।