পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে দেশে পুঁজিবাদি অর্থনীতির চাকা নিশ্চল হয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ থামেনি। করোনায় ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর মিছিলে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক রাজনীতি উত্তাল এক টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা শ্লথ হয়ে এলেও অন্যান্য রাজ্যগুলোতে বেড়ে চলেছে। এমন এক কঠিন বাস্তবতায় মার্কিন প্রশাসন, রাজনৈতিক সমাজ ও জনজীবনে অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। চীনের ওহানে করোনা মহামারী শুরুর পর সর্বাত্মক লকডাউনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মোকাবেলার চীনা পদক্ষেপের প্রশংসার পাশাপাশি চীনের এই বিপন্ন অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করার কথাও ভেবেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের মহামারী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া শুরু হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে বেøইম গেমসহ নানাবিধ বিষোদগার করতে শুরু করেন। ট্রাম্পের চীন বিরোধী প্রপাগান্ডা এক্টিভিজমকে কেউ কেউ নতুন ঠান্ডা লড়াই শুরুর ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। বিশ্বে শীর্ষ এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির দ্ব›েদ্বর প্রভাব সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। এ প্রেক্ষাপটে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।
করোনা মহামারী বিশ্বকে বদলে দিচ্ছে, নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবধারার জন্ম হচ্ছে। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর গতানুগতিক উন্নয়ন ধারনা, শক্তিমত্তা যেমন অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ছোবলে অসহায়, অসাড় ও লন্ডভন্ড অবস্থায় পতিত হলেও তাদের গতানুগতিক ভূ-রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-সংঘাতের ধারায় কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। করোনা মহামারী মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং আগামী নভেম্বরের নিবার্চনী বৈতরণী পার হতে বেøইম গেম ও চীনের সাথে সরাসরি দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়ার কৌশল গ্রহণ করেছেন বলে অনেকের ধারনা। চীনে করোনা মহামারী শুরুর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই হংকংয়ে চীন বিরোধী জোরদার আন্দোলন শুরু হলে ঠান্ডা লড়াইয়ের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নেপথ্যে কূটনৈতিক কলকাঠি চালাচালি করতে দেখা গেছে। আর এখন এই করোনা মহামারী পরিস্থিতিতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী দাঙ্গা ও বিক্ষোভ চলছে। মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে স্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার হাঁটুতে চেপে শ্বাসরোধ করে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার পর থেকে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভ চতুর্থ সপ্তাহে পদার্পণ করেছে। গণবিক্ষোভ কোথাও কোথাও এমন এক অবস্থায় পড়েছে যে সেখানে মার্কিন কনফেডারেল ইউনিয়নের অখÐতা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা সিয়াটলের কেন্দ্রস্থল থেকে টমাস জেফারসনের ভাস্কর্য উপড়ে ফেলেছে। সিয়াটলের জনজীবন সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিক্ষোভকারিরা সেখানে অটোনমাস জোন তৈরী করেছে। পাশাপাশি লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোভিড-১৯ তাÐব চলছেই। সেই সাথে চলছে রাষ্ট্রের বর্ণবাদী হিংসাত্মক আচরণের বিরুদ্ধে কলো ও মডারেট নাগরিকদের নজিরবিহীন বিক্ষোভ। শক্তিমত্তা, ভাবাবেগ ও আন্তর্জাতিকভাবে নাগরিক সমাজের সমর্থন পাচ্ছে ‘বø্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ নামের আন্দোলন। এ আন্দোলন এখন ইউরোপ ও এশিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। চীনারাও এ পরিস্থিতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সদ্ব্যবহারের সুযোগ হাতছাড়া করছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে সামনে এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিতে ছাড়েনি তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অখÐতায় হুমকির মুখে পড়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারছে না।
নাইন-ইলেভেনের পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাকে বিশ্বরাজনীতিতে এক উন্মাতাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। একদিকে আলকায়েদা, তালেবানের নেটওয়ার্কের নামে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তকমা দিয়ে মুসলমান দেশগুলোকে তটস্থ করে তোলা হয়, অন্যদিকে ভারতের মত সাবেক সোভিয়েত বলয়ের রাষ্ট্রকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রে পরিণত হতে দেখা যায়। তবে পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে তার আর শত্রæর দরকার হয়না। সে আপনাআপনি নিজের ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়ে। ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা বশংবদ দেশগুলোর দিকে তাকালে তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। দ্রæত পরিবর্তনশীল চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন দেখার বিষয়। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে চীন-ভারতের মধ্যে ন্যুনতম কৌশলগত সমঝোতা খুবই জরুরী ছিল। ব্্িরক্স বা ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত নতুন আঞ্চলিক ফোরামে অংশগ্রহণের মধ্য ভারত-চীনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুঁচিয়ে যে নতুন সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তা রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা অনেকটাই ভারতের। দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধসহ চীন-মার্কিন টানপোড়েন ও উত্তেজনায় ভারতের মার্কিন ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যাওয়া, একের পর এক সামরিক চুক্তি করা এবং চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে অংশগ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় সম্পর্ককে বৈরীতায় পরিণত করার ক্ষেত্রে ভারতই মূল ভূমিকা পালন করেছে। চীনের সাথে রাশিয়ার সীমান্তবিরোধ মিটে গিয়ে বৈরীতা যেভাবে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে, ঠিক একইভাবে চীন-ভারতের মধ্যকার সমস্যাগুলোও পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক প্রটোকলের দ্বারা শান্তিপূর্ণ মিমাংসা অসম্ভব নয়। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশেষত চীন-ভারত ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা পুরো অঞ্চলকেই যেন পিছিয়ে দিচ্ছে। বর্ণবাদী ট্রাম্পের শাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন বড় সংকটের সম্মুখীন একইভাবে ট্রাম্পের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে হিন্দুত্ববাদী মোদির শাসনে ভারতও একই ধরনের বিপদের সম্মুখীন।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় হটস্পট ভারত। গত তিনমাস ধরে সেখানে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ভারতের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই একদিকে কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের দমনে বর্বর পন্থা বেছে নিচ্ছে ভারত, অন্যদিকে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং চীনের মত বড় প্রতিবেশী থেকে শুরু করে নেপাল-ভূটানের মত ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সাথেও তাল মিলাতে পারছে না। অথচ ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী ক্ষমতায় বসার পর বিজেপি সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক যে এজেন্ডা প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মূল ফোকাস ছিল প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করা। মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে প্রতিবেশীদের সাথে রাখার এই স্ট্র্যাটেজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মোদি সরকারের সে এজেন্ডা বা ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। গত সাত বছরে ভারত একদিকে তার প্রতিবেশীদের কাছে আস্থা ও বিশ্বস্ততা বিসর্জন দিয়েছে, অন্যদিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং কাশ্মীর ও লাদাখের স্বায়ত্বশাসন বিলোপের মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরেও আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক সংহতি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। এভাবেই এখন ভারত সম্ভবত কয়েক দশকের মধ্যে নাজুক ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি, শতকোটি মানুষের দেশ ভারত নিকটতম প্রতিবেশীদের কারো কাছেই আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারেনি। গত বছরের প্রথমদিকে পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থা তৈরী হয়েছিল, যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতকে সমর্থনের বার্তা শুধুমাত্র বাংলাদেশই দিয়েছিল। বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে না গেলেও ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতার মত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতাও অঘোষিতভাবে একটি অগ্রহণযোগ্য ডিপ্লোম্যাটিক ফেনোমেনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্কভুক্ত অন্য সবগুলো দেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিদেশ সফরের ভেন্যু হিসেবে ক্ষুদ্র প্রতিবেশি ভূটানকেই বেছে নিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে ভূটানের ডোকলাম সীমান্তে চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধের সময় স্পষ্ট হয়ে গেছিল ভূটানকে আস্থায় রাখতে ভারতের নিবিড় প্রচেষ্টার নেপথ্য হেতু কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিস্তু শেষ পর্যন্ত ভূটানকেও আস্থায় রাখতে পারেনি ভারত। গৃহযুদ্ধ মোকাবেলায় ভারতের ইঁদুর-বিড়াল খেলার তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক আগেই চীনের বলয়ে চলে গিয়েছে। গৃহযুদ্ধ অবসানে চীনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর নির্মানের মধ্য দিয়ে সে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। এমনকি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চুক্তি করে চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়েছে।
এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীন-ভারত সম্পর্কের টানপোড়েনে সবচেয়ে বিষ্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের দিক থেকে নেপালের ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ানোর বাস্তবতা। কিছুদিন আগেও নেপাল ছিল সাংবিধানিকভাবে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ল্যান্ডলকড কান্ট্রি হওয়ায় নেপালের রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই ছিল ভারতের দ্বারা প্রভাবিত। সেই নেপাল এখন ভারতের দাবিকৃত স্থল ও জলসীমার বেশকিছু এলাকা একতরফাভাবে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। লেপুলেখ ও কালাপানিসহ ভারতের জন্য কৌশলগতভাকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকা যা এতদিন ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিল অনেকটা হঠাৎ করেই নেপাল সেসব এলাকা নিজের বলে দাবি করে তার মানচিত্রভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। নেপালের এমন সিদ্ধান্তে হতচকিত ভারত চীনের প্ররোচনায় নেপাল এসব করছে বলে নরম স্বরেই অনুযোগ তুলেছে। তবে নেপালে নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া, নেপাল সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং সামরিক অবস্থান থেকে বুঝা যাচ্ছে, তারা ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের কাছে নতিস্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত এলাকাকে নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করার মধ্য দিয়ে নেপাল যখন ভারতের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়িয়েছে, ঠিক সে সময়ে ইন্দো-নেপাল সীমান্তে নেপালি পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫ ভারতীয় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিদিনই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশীরা ভারতীয় বিএসএফ’র গুলিতে হতাহত হলেও নেপালি পুলিশের মত গুলি করে ভারতীয়দের এভাবে হতাহত করার নজির বাংলাদেশের বিজিবি’র নেই বললেই চলে। আমরা বলছি না, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষিরা নির্বিচার গুলি চালিয়ে ভারতীয়দের হত্যা করুক। তবে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অন্যায় ও উদ্ধত আচরণের বিপক্ষে অবস্থান নিতে কুণ্ঠিত অথবা কোন অদৃশ্য নির্দেশে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্তে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে কোনো পক্ষই তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ভারত-পাকিস্তান বিরোধে মার্কিন মধ্যস্থতাকে মেনে নিতে না পারলেও চীনের সম্প্রসারণবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যত অসহায় ভারত এবার মধ্যস্থতার জন্য রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে এবং রাশিয়ার মধ্যস্থতার প্রস্তাবে চীনও সায় দিয়েছে। এখানেই কূটনৈতিকভাবে রাশিয়ার কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় ঘটল। তবে চীনের সাথে সরাসরি দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন-ভারত দ্বন্দে মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা পালনের যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। একইভাবে আরব-ইসরাইল সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারির ভূমিকা থেকেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচ্যুত হয়েছে। এভাবেই সম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইম্পেরিয়াল পাওয়ারের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বসেছে। তবে চীন-ভারতের উত্তেজনা প্রশমন ও সীমান্ত বিরোধ মিমাংসার উদ্যোগ পুরো অঞ্চলের জন্য ইতিবাচক। তবে এটা ধরেই নেয়া যায়, চীন-ভারত সীমান্তের বেশ কিছু বিতর্কিত এলাকা চীনের দখলে চলে যাওয়ার পর মস্কোর প্রস্তাবে একটি ভার্চুয়াল আলোচনায় রাজি হয়েছে চীন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মত লাদাখের উপর চীনের দাবি দীর্ঘদিনের। ভারত তার সংবিধানের ৩০ ধারা বিলুপ্ত করে যেভাবে কাশ্মীরকে ভারতের অর্ন্তভুক্ত করেছে, একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পেয়ে অধিকৃত পশ্চিমতীর ও জর্ডান নদীর উপত্যকার আরবদের এলাকাগুলোকে ইসরাইল নিজেদের দখলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইসরাইলের দখলদারিত্বের পেছনে কোনো আইনসম্মত ভিত্তি বা যুক্তি না থাকলেও নেপাল ও চীন ভারতের দাবিকৃত এলাকাগুলো দখলে নেয়ার পেছনের ঐতিহাসিক ভিত্তি ও যুক্তিগুলো অকাট্য বলে মনে হতে পারে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান তুলে বর্ণবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদিও বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে গ্রেট করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। উভয়ের বিধি বাম। আমেরিকান কনফেডারেশন ভেঙ্গে যেতে বসেছে। আর নরেন্দ্র মোদির ভারত একের পর এক পাকিস্তান, চীন, নেপাল ও ভূটানের কাছে ইজ্জত ও ভূমি হারাতে বসেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুরু থেকেই ভারসাম্যহীন। এ জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই দায়ী। এতদিন যেভাবেই চলুক না কেন, এখন আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে যে নতুন বাস্তবতা দেখা দিয়েছে, সেখানে ইন্দো-মার্কিন জোট হালে পানি পাচ্ছে না। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা থেকে শুরু করে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন চীন বিরোধি প্রোপাগান্ডা ও শিনোফোবিয়া কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তখন তার ইউরোপীয় মিত্ররা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তারা চীনের সাথে ঠান্ডা লড়াইয়ে জড়াবে না। গত কয়েক সপ্তাহের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহে আমেরিকা বা ভারতের বিপক্ষে চীনের প্রাধান্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিশ্বের সামনে আরেকটি অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা অপেক্ষা করছে। এহেন বাস্তবতায় কোভিড লড়াইয়ে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র চীন, ইরান, রাশিয়া বা ভিয়েতনামের মত দেশগুলো থেকেও পিছিয়ে আছে, অন্যদিকে নেপাল, ভূটান, পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকা ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। দুই বছর আগেও বাংলাদেশের উপর প্রভাব বিস্তারে চীন-ভারতের এক প্রকার ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমরা চীনকে পাশে রাখতে চাই আবার ভারতের সমর্থনও অটুট রাখতে চাই। সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হলেও কখনো কখনো এমন সময় এসে দাঁড়ায় যখন নিরপেক্ষতার সুযোগ থাকেনা। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, নেপাল ও ভূটানের কাছ থেকেও বাংলাদেশের শিক্ষনীয় আছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা থেকে যদি আমরা শিক্ষা না নেই তাহলে সামনের কঠিন সময়ে আমাদের কোনো গত্যন্তর থাকবে না।
করোনা যুদ্ধের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার সাথে পুরনো বন্ধুত্ব বিসর্জন দিয়ে আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধার ভারতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সূচনা এখান থেকেই। এখন চীনকে আস্থায় রেখে নেপালও ভারতকে চোখ রাঙানোর সাহস পাচ্ছে। বেশ কিছু বির্তকিত এলাকা নেপাল নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করার পরও ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গোফ নামিয়ে বলছেন, নেপালের সাথে ভারতের ‘রোটি বেটি সম্পর্ক’ বিশ্বের কোনো শক্তি এ সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না। এরাই বন্ধুত্বের ফিরিস্তি জাহির করার পরও যখন তখন বাংলাদেশকে উদ্ভট সব হুমকি দিচ্ছে। এখন নেপালের শক্ত পদক্ষেপের জবাব দিতেও সাহস পাচ্ছে না। অন্যদিকে, এতদিন ধরে যৌথ টহলে চলা লাদাখের গুরুত্বপূর্ণ অংশের পাশাপাশি পুরো গ্যালওয়ান নদী উপত্যকা এবং পেংগং সু এলাকার উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ভারত মস্কোর মধ্যস্থতায় শর্তহীন আলোচনায় যাচ্ছে। তবে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি প্রশ্ন তুলেছেন, চীনের সাথে যদি রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ভারতের আলোচনা হতে পারে, নেপাল বা বাংলাদেশের সাথে নয় কেন? বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাÐ, পানি বন্টন, বাণিজ্য ঘাটতিসহ সব বিষয়ে ভারতের সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখতে চায় বাংলাদেশের জনগণ। এসব ক্ষেত্রে ভারত ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারলে চীনের সাথে উন্নয়ন অংশিদারিত্ব ও জোরালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক রেখেও ভারতের সাথে সুপ্রতিবেশিসুলভ লেনদেন ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।