Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাকালে শিক্ষা সঙ্কট

ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। করোনা মহামারী থেকে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ১৮ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে। পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়ায় ক্লাসরুমে এখনও তালা। প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। বরং করোনা পরিস্থিতি এখনও নাজুক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার মতো অবস্থা এখনও দেশে অনুপস্থিত। অবস্থার উন্নতি হতে বা ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতি দেশে কবে সৃষ্টি হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার জীবন ও জীবিকা একসাথে চালানোর নীতি অনুসরণ করলেও তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখনও বিদ্যমান। সরকার দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নাই। যা অধিকাংশ অবিভাবকের কাছেই প্রসংশিত হয়েছে। তবে কেউ কেউ যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল কলেজ খুলে দেবার কথা আকারে ইংগিতে বলছে না তা কিন্তু নয়।

ইতোমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে অনলাইনে তাদের ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান কতটা নিশ্চিত করা হচ্ছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রতিটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের পছন্দমত পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করছে। এসব পদ্ধতি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে কতটা গ্রহণযোগ্য সে বিষটাও ইউজিসির ভেবে দেখার সময় এসে গেছে। তা নাহলে উচ্চশিক্ষায় ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এমনিতেই দেশের শিক্ষার গুণগত মানের সূচক নিম্নমুখী। মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চাবি এখন করোনার হাতে। আগেই বলেছি যে, দেশের যা অবস্থা তা কোনভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে নয়। তবে প্রশ্ন হলো, কতদিন তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা যাবে? তাই যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতেই হয় তবে তা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরুত্ব বজায় রেখেই খুলতে হবে।

বাংলাদেশ শিক্ষা ও তথ্য পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ১ লক্ষ ২৯ হাজার ২৫৮টি। যার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬২০টি। মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০ হাজার ৬৬০টি। এর মধ্যে সরকারি ৬৭৫টি। সরকারি ও বেসরকারি মিলে দেশে কলেজের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৫১টি। এর মধ্যে বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৩হাজার ৯৯০টি। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি, আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৩টি। দেশে ৩টি সরকারিসহ হাজার হাজার মাদরাসা রয়েছে। এছাড়া দেশে বহুসংখ্যক কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ, ক্যাডেট মাদরাসা ছাড়াও স্থাস্থ্য শিক্ষা ও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করা নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। কখন বা কবে তাদের শ্রেণিকক্ষের তালা খুলে দেয়া হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রেণিক্ষের আসন বিন্যাসসহ সার্বিক পরিকাঠামো সম্পর্কে আমরা কমবেশি ওয়াকিবহাল। অবকাঠামোগত পরিষেবা বিবেচনায় শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মফস্বল ও গ্রামের প্রতিষ্ঠান অনেক পিছিয়ে। শহরের প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি কিছুটা মানা সম্ভব হলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা বর্তমান ব্যবস্থায় কোনভাবেই সম্ভবপর হবে না। গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশেই অপ্রতুল। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা মোটেই সম্ভবপর হবে না। ‘জীবন না জীবিকা’ এই প্রশ্নে আমরা ইতোমধ্যে জীবন ও জীবিকাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ফলাফল যে খুব ভালো তা বলা যাবে না।

এদিকে ‘শিক্ষা না জীবন’ এই প্রশ্নটিও আজ বড় করেই সবার মনে ঘুরেফিরে আসছে। ইতিহাসের পাতা হাতড়ালে আমরা দেখতে পাবো যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দীর্ঘদিনের জন্য বহুদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি স্থবির ছিলো। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও দীর্ঘদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। জীবনটাই মুখ্য ছিলো, শিক্ষা নয়। গত একসপ্তাহ যাবৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনুসরণ করলে দেখা যাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সন্তানের নিরাপদ জীবনটাই প্রত্যাশা করেছেন, শিক্ষা নয়। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত পরিষেবার বর্তমান অবস্থা আহামরি কিছু নয়। আবাসিক হলসমূহের সিট বণ্টন ব্যবস্থা, হলের ডাইনিং-ক্যান্টিনের পরিস্থিতি মোটেই করোনা মোকাবেলায় বর্ণিত স্বাস্থ্যবিধি সমতুল্য নয়। হলসমূহে সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখাটা এক প্রকার অসম্ভব। গণরুমের পরিস্থিতির কথা নাইবা বললাম।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে গিয়ে আজ আমরা জীবনটাকেই বহুলাংশে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি। আমরা বিপণি বিতানে স্বাস্থ্যবিধি মানিনি, গণপরিবহনে মানছি না বলেও অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়। স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে করোনা সামাজিকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনতর এক জটিল পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তটি ভেবেচিন্তে নেয়াটাই যুক্তিযুক্ত হবে। আবেগ নয়, বাস্তবতার নিরিখেই নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষা নয়, সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে জীবনকে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন