পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমরা বর্তমানে এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। যুদ্ধ করছি এক অদৃশ্য শত্রুর সাথে। এ যুদ্ধ একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়। যুদ্ধটা সামগ্রিক অর্থে আমাদের সবার। তাই সকল বিভক্তি ও বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সবাইকে এই মহামারী করোনার বিরুদ্ধে একসাথে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। আর লড়াইয়ে আমাদেরকে অবশ্যই জিততে হবে। সেজন্য দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। দাড়াঁতে হবে বিপন্ন মানুষের পাশে।
দুর্দিনে ভুলে গেলে চলবে না যে, শ্রমজীবী মানুষের হাড়ভাঙ্গা শ্রমের মধ্যদিয়েই আমাদের আর্থিক ও সামাজিক সফলতার সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরি হয়েছে। দেশে বিদেশে বাড়ি গাড়ি ও কারখানা তৈরিতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের বিলাসী জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম। সুতরাং আজকের এই দুর্দিনে তাদের পাশে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশে বিদেশে আজ আমাদের যে গাড়ি-বাড়ি, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি তার সিংহভাগ কৃতিত্ব কর্মীদেরই পরিশ্রমের ফসল। তাই এই মহামারীর সময়ে আমাদের সেই সব স্বল্প আয়ের মানুষদের অবহেলা না করে ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক সফলতার কারিগর হিসেবে গণ্য করে পাশে থাকতে হবে। তাদের মনে এই বিশ্বাসটা তৈরি করে দেয়া খুবই জরুরি যে তাদের মালিক বা চাকরিদাতা শুধুমাত্র তাদের মুনিব নন, তাদের প্রকৃত অভিভাবক। সময়মত বেতন, বোনাস পরিশোধ করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। পাওয়াটাও তাদের অধিকার। দেশের প্রচলিত শ্রম আইনও সেটাই বলে। ধর্মে তো গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ করার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। প্রধাণমন্ত্রীও করোনাকালে কর্মী ছাঁটাই না করা ও কর্মীদের সাথে মানবিক আচরণ করার আহবান জানিয়েছেন। আশা করি, আমরা বিপদের দিনে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকে ভুলে যাবো না। তাদের পাশে থাকবো। কর্মীদেরকেও তাদের প্রতিষ্ঠানের এই আর্থিক দুর্দিনে প্রকৃত চাওয়া পাওয়ার হিসাব না কষে টিকে থাকার লড়াইটাই সর্বাগ্রে করতে হবে। তবে কিছু কিছু শিল্পোদ্যোক্তা তাদের কর্মীদের বঞ্চিত করার ফন্দি-ফিকিরে আছে। শ্রমিকরাও বিক্ষুব্ধ, সরকারের উচিত উভয় পক্ষের সাথে বসে আলোচনা করে সমাধান করা।
করোনা আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে সত্য, তেমনি অনেক কিছু শিখিয়েছে। দিয়েছে পশু-পাখির জন্য বসবাসযোগ্য ধরিত্রী। হাত ধুয়া শিখিয়েছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে শিখিয়েছে। কোনো ধনসম্পদই যে বিপদের দিনে কাজে আসে না তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ধনী-গরিব সবাইকে মোটামুটি এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যারা দেশের টাকা লুট করে বা বিদেশে পাচার করে বাড়ি-গাড়ি, অট্টালিকা বানিয়েছে, বিদেশি ব্যাংকে নিজেদের ভোগ বিলাসের জন্য টাকা জমিয়েছে করোনাকালে সেই টাকা কোনো কাজেই আসছে না, তা জানিয়ে দিয়েছে। তারা অসুস্থ হলে সেই চুরি করা টাকা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবার বিমান টিকিট কিনতে পারবে না তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রকৃতি মনে হয়, আজ বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ করছে। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। আমরা এতদিন শুধু নিজেরা ভালো থাকতে চেয়েছি। অন্যের কথা, প্রতিবেশীর কথা সর্বোপরি পরিবেশের কথা ভাবিনি। মানুষ হত্যার জন্য কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র বানিয়েছি। দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে মারণাস্ত্র বিক্রির বাজার স¤প্রসারিত করেছি। কিন্তু মানুষ বাঁচানোর জন্য যৎসামান্যই করেছি। ইউরোপের বহুদেশ অপেরা ও ফুটবলের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের কর্মকান্ড যে খুবই নগণ্য ছিলো তা করোনা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে। নিজেরা ভালো থাকার জন্য দিনের পর দিন আমরা পরিবেশ ধ্বংস করেছি। নির্বিচারে গাছ কেটে বন-জঙ্গল উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রি করেছি, পাহাড় কেটে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে ইটভাটা তৈরি করেছি, কারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলে জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করেছি, নদী দখল করে নিজেদের বহুতল ভবন নির্মাণ করেছি। শিল্প-কারখানার বিষাক্ত ধোয়ায় জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছি। ধরিত্রীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছি। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করেছি। তাহলে কি প্রকৃতি আজ সকল অবিচারের প্রতিশোধ নিচ্ছে?
মহামারী করোনা আমাদের সবকিছুতেই মস্তবড় একটা ঝাঁকুনি দিয়েছে। আমরা আজ বদলে যাওয়া পৃথিবীর বদলে যাওয়া একেকটি মানুষ। পৃথিবীর সবকিছু বদলে গেছে। ইরাক-ইসরাইল ও সিরিয়ার আকাশে আর বারুদের গন্ধ নেই। আছে শুধু বেঁচে থাকার লড়াই। আমরা সবাই কমবেশি বদলে গেছি বা বদলাতে বাধ্য হয়েছি। আমার নিজের কথাই যদি বলি তাহলে বলতে হয় শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেবার তাড়া নেই, পরীক্ষার ডিউটি নেই, স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন করার বালাই নেই, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের তাগিদ নেই, আছে শুধু করোনামুক্ত একটা সকাল দেখার প্রচন্ড তাড়া। সব কিছুই আজ অন্য রকম। কিছুই নেই আর আগের মতো। তবে পূর্বাকাশে আগের মতই নিয়ম করে সূর্য উঠে তা আবার সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে অস্তও যায়। প্রকৃতিও আজ তার রং বদলিয়েছে। বহুদিন পর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লোনাজলে ডলফিন জলকেলি করছে। সৈকতের তপ্ত বালুতে লাল কাঁকড়া দলবেঁধে মনের আনন্দে খেলা করছে। মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পাখিদের কলতান বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দদূষণ কমে গেছে। বায়ুদূষণ নাই বললেই চলে। রাস্তা ঘাটে কোলাহল কমেছে। তবে বেড়েছে আতঙ্ক। চাকরিজীবিদের মধ্যে চাকরি হারানোর আতঙ্ক, শ্রমজীবী মানুষের মাঝে শ্রম হারানোর আতঙ্ক। বিনা চিকিৎসায় মরে যাবার আতঙ্ক, আত্মীয়-স্বজনের জানাজায় অংশগ্রহণ না করতে পারার আতঙ্ক। এমন হাজারো আতঙ্কে আতঙ্কিত দেশের প্রতিটি মানুষ। ফলে বদলে গেছে মানুষের জীবনাচার। কেউ আর আপনজনের বাসায় যায় না। অন্যকেও ডাকে না। মসজিদে নিয়ম করে সময়মত আযান হলেও মুসল্লি কম। যেতে পারে না প্রাণভয়ে। প্রায় প্রতিটি ঘর এখন একেকটি এবাদতখানা। মানব সভ্যতার এক অচেনা শত্রু করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সব নিয়মকে তছনছ করে দিয়েছে। এযেন এক বদলে যাওয়া অচেনা পৃথিবী। মানুষও বদলে গেছে। বদলেছে তাদের আচরণ। তবে কিছু মানুষের বদলানোটা আমাদেরকে লজ্জা দেয়, অপমানিত করে। চালচোরদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়নি দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মন্ত্রী-এমপিদের ধানকাটা ফটোশেসন দেখে লজ্জিত হই। অর্থনৈতিক বিপর্যের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত কিট নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আমলাতান্ত্রিক বিলম্বতা দেখে হতাশ হই, ৫০ লক্ষ কর্মহীন মানুষের মাঝে সরকারের নগদ অর্থপ্রদানের তালিকায় অর্থ-বিত্তবানদের নাম দেখে লজ্জা পাই। এতকিছু অসঙ্গতির মাঝেও প্রতিদিন আমরা একটি সু-সংবাদের আশায় দুপুরে অনেক সমালোচনার জন্ম দেয়া স্বাস্থ্যবিভাগের প্রেস ব্রিফিং এর জন্য টিভি’র পর্দায় চোখ বুলাই। কিন্তু সু-সংবাদ আর আসে না। কবে তা আসবে তাও কারো জানা নেই। বিশ্বশ্রম সংস্থার মতে, বদলে যাওয়া দুনিয়ায় প্রায় অর্ধেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের মতে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকা নিম্নমুখী হবে।
আমাদের দেশেও বহুসংখ্যক গার্মেন্ট কর্মী তাদের চাকরি হারাবে। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের দেশের প্রায় ৪০% গার্মেন্ট কর্মী কোন না কোনভাবে পূর্বে কৃষির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। সুতরাং দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্বার্থে তাদেরকে পুনরায় কৃষিকাজে ফেরানোটা খুবই জরুরি। স্বল্পসুদে কৃষিঋণ প্রদান ও কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশের কৃষিখাতকে উজ্জীবিত করার মধ্যদিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাসমূহকে সঠিকভাবে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করা গেলে তা সামগ্রিক প্রান্তিক জনপদের আর্থিক উন্নয়ন কর্মকান্ড তরান্বিত হবে। ক্ষুদ্রঋণ ও এসএমই খাতও দেশের বেকারত্ব নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতা ও অক্ষমতার চিত্র জেনে গেছি। তাই আবেগ নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমাদেরকে চলতে হবে। প্রান্তিক মানুষের আয় কিন্তু কমে গেছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে যারা খন্ডকালীন চাকরি বা টিউশনি করে নিজের ভরণপোষণ চালাতো, তারা করোনাকালে অর্থকষ্টে একপ্রকার দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। তারা না পারছে অন্যের কাছে হাত পাততে না পাচ্ছে কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা। তাদের জন্য না আছে কোনো বেকার ভাতা, না আছে কোনো প্রণোদনা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে চাকরি হারিয়ে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। আমাদের দেশে সে সুযোগও নেই। করোনা পরবর্তীতে আমাদের শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। করোনার প্রভাবে বিদেশ থেকে কর্ম হারিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ দেশে ফিরতে বাধ্য হবে। এতে করে একদিকে যেমন ফরেন রেমিটেন্স কমে যাবে অন্যদিকে এত অধিকসংখ্যক কর্মহীন মানুষ দেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিদেশ ফেরত আসা মানুষগুলোর জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে দেশে সামাজিক অনাচার সৃষ্টি হবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া না। আসলে সামগ্রিক অর্থে আমরা একটা যুদ্ধকাল অতিক্রম করছি। যুদ্ধটা হলো করোনাকে জয় করে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। নিরন্ন মানুষের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো মোটা ভাত ও মোটা কাপড় তুলে দেবার যুদ্ধ। কর্মহীন মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার যুদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার যুদ্ধ। কলকারখানায় উৎপানের চাকাকে সচল করার যুদ্ধ। বিশ্বমানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। এযুদ্ধে কিন্তু একা জেতা যাবে না। সবাইকে নিয়েই জিততে হবে। একা ভালো থাকা যাবে না। সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হবে। আসুন, সবাই সবার পাশে থাকি।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।