বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
রমজান মাসে সিয়াম সাধনা শেষে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদের আনন্দে যেন মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্য শরীক হতে পারে এ জন্য ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে। এতে রোজার ত্রটি বিচ্যুতিও পুরণ হয়ে যায়। ইসলাম বিশ্বজনীন কালজয়ী আদর্শ। দেড়হাজার বছর আগে মহানবী সা. বিশ্বের প্রধান খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরার স্ট্যান্ডার্ড নিরুপণ করেছেন। সাধারণত বিশ্বব্যাপী মানুষের ফসল খাদ্য বা সম্পদ গম, যব, খেজুর, কিসমিস, মনাক্কা, পনির ইত্যাদি দিয়ে পরিগণিত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশ বর্তমানে এ তালিকায় চালকেও শামিল করে নিয়েছে। এটি অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য বিবেচনায় করা হয়েছে।
তবে সব আলেম এ বিষয়ে একমত হননি। তারা বলেছেন, এভাবে স্ট্যান্ডার্ড পরিবর্তন করলে মহানবী সা. এর নির্দেশ অবিকৃত থাকবে না। তিনি ইচ্ছে করলে চালের নাম তখনই উচ্চারণ করতে পারতেন। সুতরাং হাদীসে বর্ণিত বস্তুগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে কেয়ামত পর্যন্ত ধরে রাখাই উত্তম। এখানে গম ছাড়া বাকী সব বস্তু দ্বারা ফিতরা দিলে এর পরিমাণ সাড়ে তিন সের। গমের বেলায় পৌনে দুই সের। এটি খেলাফতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। কারণ, মক্কায় গম ছিল সিরিয়া থেকে আমদানিকৃত বস্তু, দাম ছিল দ্বিগুণ। মানুষ আদায় করতে পারতো না। নবুওয়তের অনুসারী খেলাফত ঘোষণা দিলো, অন্যসব সাড়ে তিন সেরই থাকবে। কেবল গম পৌন দুই সের দিলেই চলবে। যেন, বেশি মানুষ দিতে পারে।
ফিতরা নিয়ে অণীত আলেমদের মতামত ও বর্তমান সময়ের ইসলামী চিন্তাবিদদের কনসেপ্ট অল্প স্বল্প জেনে বাংলাদেশেও গত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত ফেকাহ ও শরীয়তের শৃঙ্খলা তছনছ করে দেয়ার জন্য একটি মহল নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘারে সওয়ার হয়। তখন খতীব সালাহউদ্দীন সাহেব ও ডিজি দেশের আলেমদের সহায়তা নেন। ঢাকার বিশিষ্ট মাদরাসার ইফতা ও বিখ্যাত মুফতিগণ তাদের ডাকে সাড়া দেন।
চ‚ড়ান্ত বৈঠকে অন্যান্যের মাঝে মুফতি আব্দুল মালেক ও আমিও ছিলাম। অনেক কথাবার্তার পর সর্বশেষ বক্তব্য দেয়ার জন্য আমাকে বলা হয়। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আমাকে ফেইস করতে বলা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সবাই মিলে একবাক্যে বলেন, নদভী সাহেব আমাদের এই গবেষণা ও পর্যালোচনার বৈঠকের মুখপাত্র। তখন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে ফিতরার পূর্ণাঙ্গ কনসেপ্টটি নতুন করে জনগণের সামনে আসে।
এর আগে ফিতরার সর্বনি¤œ পরিমাণ কোনো হিসাব কিতাব ছাড়া ১০০ টাকা ধরে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। আমরা তখন ফিতরার চির নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড বস্তুর নাম ও পরিমাণসহ মহানবী সা. এর হাদীস থেকে উদ্ধৃত করেছি। সে কাজে যুক্ত ৩৩ জন মুফতি সাহেবের হৃদ্যতা ও শ্রম আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এই অভাজনের ওপর তাদের সে সময়কার আস্থার প্রতিদান আল্লাহ তাদের দিবেন। নতুবা সে ফেতনা মোকাবেলা করে আমরা জয়ী হতে পারতাম না।
মদীনা রাষ্ট্রটি তখন কয়েক লাখ বর্গমাইল হলেও নগরটি ছিল বর্তমান মসজিদে নববীর সমান। জনগণ ছিলেন সর্বসাকুল্যে তিন লাখ। তাদের কেউ যেন ঈদের দিন কষ্ট না করেন সে জন্য জামাতের যাওয়ার আগেই ফিতরা আদায় করার হুকুম ছিল। যারা ফিতরা দিতেন তাদের জীবন মানও ফিতরা পাওয়া মানুষদের চেয়ে খুব বেশি উন্নত ছিল না। বিশেষ ধনী মানুষ ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। আজকের মুসলিম সমাজ বঞ্চিত মানুষদের ঈদ আনন্দে শরীক করতে চাইলে আইনত তারা ৬০-৭০ টাকা থেকে ফিতরা শুরু করতে পারে। আরও বেশি যে দেয়া যায় এটি বিগত বিতর্কের আগে মানুষ জানতও না। জানতেন কেবল উলামায়ে কেরাম। এখন গম থেকে পৌনে দুই সের অথবা তার মূল্য (বাজার ভেদে) ৬০-৭০ টাকা। সর্বনি¤œ পরিমাণ বলে দেয়া আলেমদের দায়িত্ব।
এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক সর্বনি¤œ ৭০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেহেতু সামর্থ্য অনুযায়ী আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির ও যবের যে কোনো একটি পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণ বা এর বাজার মূল্য এক ফিতরা হিসাবে করতে হবে। সেহেতু আটার ক্ষেত্রে (অর্ধ সা), ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম যার বর্তমান বাজার মূল্য ৭০ টাকা। যবের ক্ষেত্রে (এক সা) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম, যার বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ২৭০ টাকা। এছাড়া কিসমিস (এক সা) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম, যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা ধরা হয়েছে। খেজুরের ক্ষেত্রে (এক সা) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম, যার বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ টাকা এবং পনিরের ক্ষেত্রে (এক সা) ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম যার বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ২ হাজার ২০০ টাকা।
এখন কেউ যদি আটা বা গম দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চায়, তাহলে সে ৭০ টাকা দিবে প্রতিটি ফিতরার মূল্য। যব দিয়ে যদি কেউ ফিতরা আদায় করতে চায়, তাহলে সে ২৭০ টাকা করে প্রতিটি ফিতরা আদায় করবে। যার সামর্থ্য আছে যদি সে কিসমিস দিয়ে ফিতরা আদায় করে, তাহলে সে প্রতিটি ফিতরা আদায় করবে ১৫০০ টাকা। এভাবে খেজুর দিয়ে আদায় করলে ১৬৫০ টাকা আদায় করবে প্রতিটি ফিতরা। খেজুরের মূল্যে যদি কেউ ফিতরা আদায় করতে চায়, তাহলে সে আরও অনেক বেশি আদায় করতে পারবে। কেননা, এখানে খেজুরের স্ট্যান্ডার্ড দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এরচেয়ে দামী খেজুরও বাংলাদেশে এখন পাওয়া যায়। আর যার সামর্থ্য আছে এবং সে পনির দিয়ে আদায় করতে চায়, তাহলে সে প্রতিটি ফিতরার মূল্য আদায় করবে ২২০০ টাকা। এখন আপনি নিজের ও পরিবারের প্রতিটি পোষ্যের পক্ষ থেকে ঈদের আগেই অর্থাৎ রমজানে ফিতরা আদায় করে দিন।
আপনার সংগতি মতে ফিতরা দেয়া নৈতিকতার দাবি। একজন কোটিপতি তার পরিবারের চার সদস্যের ফিতরা ২৮০ টাকা দেবেন না ৮০০০০ টাকা দেবেন এটি তার বিবেচনার ওপর ছেড়ে রাখা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও মহব্বত অনুযায়ী মানুষ ফিতরা আদায় করে। ফিতরার এ বিস্তারিত হিসাব ও কনসেপ্ট আত্মস্থ করে নিলে এ মহান অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও পবিত্র সওয়াবে পরিপূর্ণ ইবাদতটি আপনার কাছে খুব ভালো লাগবে। মুসলমানরা শুধু নয় বিশ্বের চিন্তাশীল সকল মানুষ মহানবী সা. এর এই মানবিক ও সাম্য, মৈত্রিপূর্ণ আদর্শের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।