পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ডাক্তার, সাংবাদিক ও পুলিশ এই তিন শ্রেণির মানুষকে নিয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। তবে তা কেন বা কী কারণে সে তর্ক করার সময় এটা নয়। তবে নিশ্চিত যে, আমরা আবার প্রয়োজন হলে তাদের কাছেই সবার আগে ছুটে যাবো। আর বিপদে পড়লে বলি আপনারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বিপদের কালো মেঘ কেটে গেলে ডাক্তারকে ডাকাত, সাংবাদিকদের সাংঘাতিক, পুলিশকে ঘুষখোর দুর্নীতিবাজসহ নানা উপমায় বিশ্রী ভাষায় সমালোচনা করে থাকি। কিন্তু বর্তমানে দেশে করোনা মোকাবেলায় এই তিন শ্রেণির মানুষই নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা না ভেবে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে আলোচনার সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো যে, দেশে মহামারী করোনা মোকাবেলা, লকডাউন কার্যকর ও ত্রাণ বিতরণে সার্বিক সহযোগিতা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, ৫০০ শতাধিক আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যা সার্বিক বিবেচনায় পুলিশ সদস্যদের মনোবল দুর্বল করে দিতে পারে। এদিকে মূলত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই করোনা যুদ্ধে সামনের কাতারের মূল সৈনিক। আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তথ্যানুযায়ী আমাদের দেশে করোনা মোকাবেলায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে দেশের চিকিৎসা সংকট প্রকট হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি তারা সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছিলেন? নাকি মানহীন অপর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য এটা ঘটেছে। তবে আজ সেই বিতর্কে না গিয়ে এত অধিক সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মী কেন এবং কীভাবে আক্রান্ত হলো তা দ্রæত চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই হারকে অবশ্যই শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। তা করতে না পারলে তাঁদের মনোবলে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যা সামগ্রীক বিবেচনায় মোটেই প্রত্যাশিত নয়।
সংবাদপত্র বা মিডিয়া হলো সমাজের দর্পণ। সংবাদকর্মীরা প্রতিদিন মাঠেঘাটে ছুটে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পরিবারের সদস্যদের কথা না ভেবে স্বাস্থ্য বিভাগের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প শোনাচ্ছেন, ত্রাণ বিতরণের খুঁটিনাটি প্রচার করছেন। ত্রাণ বিতরণে গ্রাম-গঞ্জের সঙ্গতি অসঙ্গতি তুলে ধরে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। ভয়হীন চিত্তে মিডিয়া কর্মীরা জনগণকে প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক বিভিন্ন সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করছেন। ইতোমধ্যে তিনজন সিনিয়র সাংবাদিক করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সারাদেশে করোনা আক্রান্ত সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংবাদিকদেরকে কোন প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী অদ্যাবধি প্রদান করা হয়নি। এমনকি সরকার ঘোষিত লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রশংসনীয় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও সেখানে নেই সাংবাদিকের নাম। অথচ শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও জাতির প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সাংবাদিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এদিকে স্বাস্থ্যবিভাগের যেসব দায়িত্বশীলরা করোনা নিয়ে গোটা জাতিকে অন্ধকারে রেখে সময়ে সময়ে অসত্য তথ্য দিয়ে বা কখনও কখনও অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে পুরো করোনা যুদ্ধটাকেই হযবরল অবস্থায় দাঁড় করালো, মানহীন পিপিই ও মাস্ক ক্রয় করলো বা যাদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন কেনাকাটায় অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলো, যাদের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দৃশ্যমান দৈন্য পরিলক্ষিত হলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে মানহীন মাস্ক প্রাপ্তির অভিযোগ করায় যখন মুগদা হাসপাতালের পরিচালককে চাকুরি জীবনের শেষ সময়ে ওএসডি করা হলো তখন কিন্তু পুরো জাতি হতাশ হয়েছে। লজ্জিত হয়েছে। ক্ষুদ্ধ হয়েছে। এদিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘কিট’ যা করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে কিছু মানুষের নোংড়ামি ও কটুক্তি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে চরম বিরক্ত করেছে। আসলে করোনা নিয়ে দেশবাসী কোনো পক্ষের কাছ থেকেই আর কোনো অপরাজনীতি প্রত্যাশা করে না।
করোনা মহামারীতে সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত ২ লক্ষ ৯০ হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে ৪৩ লাখ। আমাদের দেশেও আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু লকডাউন কার্যকর করা যাচ্ছে না। মানুষকে ঘরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে, চাকরি হারানোর ভয়ে ঢাকামুখী শ্রমিকদের ঢল সামলানো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত হচ্ছে, দেশে আড়াইশ’র কাছাকাছি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ১৬ হাজারের মতো আক্রান্ত, তখন কিছু দায়িত্বশীল মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন ও বিবেক বর্জিত কাজ দেশের অধিকাংশ জণগনকে ক্ষুব্ধ করেছে। দেশে লকডাউন আর দলবলসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপির ধানকাটার দৃশ্য দেখে দেশবাসী বিরক্ত। এটা দেশের কৃষকের সাথে তামাশা করার শামিল।
লকডাউনের মধ্যেই রাস্তায় দেদারছে চলছে গাড়ি, নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও কিছু কিছু স্থানে স্বাস্থ্যবিধি নামেনেই দোকানপাট খোলা রাখা হচ্ছে। আইনশৃংখলা বাহিনী এসব নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। বর্ষাকাল ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ব্যাপার হলো, যিনি বা যারা এই কাজ তদারকি করবেন সেই মেয়র সাহেবরা কোথায় আছেন তাও নগরবাসী জানতে পারছে না। ডেঙ্গু মোকাবেলায় এখনই হাসপাতালে পৃথক ইউনিট প্রস্তুত করাসহ মশা নিধনে স্প্রে করা উচিৎ। তা নাহলে আরেক বিপদ জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারে।
করোনাকালে শ্রমিকদের মধ্যে কর্ম বাঁচানোর ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। শুধু দেশেই নয় বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে দেড় কোটি রেমিটেন্স যোদ্ধা চাকরি হারানোর শংকায় দিনাতিপাত করছে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতে তাগাদা দিচ্ছে বলে সংবাদে প্রকাশ। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবে ও শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আইএলও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশের অবস্থা কিন্তু এই পরিস্থিতির বাইরে নয়। দেশেও শ্রকিকদের মধ্যে কাজ হারানোর ভয় কাজ করছে। তাই কোনো বাধাই শ্রমিকদের রাজধানীমুখী ঢল আটকানো যাচ্ছে না। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সুসমন্বিতভাবে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এযাবৎকালের পারফরমেন্স হতাশাজনক। একটা বিষয় সংশ্লিষ্টদের মাথায় রাখতে হবে যে, বিগত ১২০ বছরের মধ্যে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণি এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শিল্পের স্বার্থে তাদের বাঁচাতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিক মালিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, দেশের কৃষিখাতই আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তাই কৃষি মন্ত্রণালয়কে কৃষকবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। কৃষি সহায়ক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ফরিয়া বা মধ্যসত্বভোগীরা যাতে কৃষি প্রণোদনার অর্থ ভাগবাটোয়ারা করতে না পারে সে বিষয়ে তৎপর থাকতে হবে। করোনা পরবর্তীতে কৃষি ও কৃষক বাঁচলে দেশ থেকে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা দূরিভূত হবে। অর্থনীতি বাচঁবে। বাচঁবে দেশের মানুষ।
লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।