Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অটোপসি হচ্ছে না করোনায় মৃতদের

বিষদভাবে জানতে মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধান প্রয়োজন : প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ রোগের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে ওষুধ ও চিকিৎসা : প্রফেসর আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২০, ১২:০২ এএম

মহামারী করোনাভাইরাসে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের শরীরে কি ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। মৃত ব্যক্তিদের অটোপসি (মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধান) ছাড়া যদিও এটি জানা সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত মৃতদের অটোপসি করার বিষয়টি ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনেও উল্লেখ করা হয়নি। এতে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস আমাদের দেশের মানুষের শরীরে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে সেটি অজানাই থেকে যাচ্ছে। 

সূত্র মতে, অটোপসি’র মাধ্যমে যাদের মৃত্যু হয় তাদের শরীরে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, দেহের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এই বিষয়গুলো জানা যায়। এটা জানা না থাকলে এসব রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেয়া বা এই রোগের সঠিক ওষুধ আবিস্কার সম্ভব হয় না। তাই যখনই কোন দেশে নতুন কোন রোগের প্রদূর্ভাব দেখা দেয় তখনই ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের অটোপসি করতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র অটোপসি করেই জানা সম্ভব নতুন রোগ মানবদেহে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। চীন, ইতালি, ব্রাজিল, ইংল্যাান্ডসহ সব উন্নত দেশেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের মৃতদেহে রোগের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কেরালায় এবং শ্রীলংকায় অটোপসির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা গাইডলাইন প্রণয়নে কাজ করছেন তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাই দেশে কোন রোগীরই অটোপসি হচ্ছে না। দেশের মানুষের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে অবিলম্বে অটোপসি করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু হৃদরোগ বিভোগের প্রধান প্রফেসর ডা. আব্দুল্ল­াহ শাহরিয়ার বলেন, দেশকে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই অটোপসি করতে হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। চীনে করোনা আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এক ধরনের প্রভাব দেখা গেছে, আমেরিকাতে অন্য ধরনের প্রভাব দেখা গেছে। তাই আক্রান্ত সব রোগীর চিকিৎসা এক ধরনের হবে না। একটি রোগ রোগীর ওপর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার ওপর নির্ভর করে ওষুধ এবং চিকিৎসা কি ধরনের হবে। প্রফেসর শাহরিয়ার বলেন, চীন আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসে মাইক্রোথাম্বার বা শর্সের মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী রোগীদের শরীরে ‘হ্যাপি হাইপোস্কিমা’ বা সুখকর অক্সিজেনের ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে। অর্থাৎ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় অনেক নেমে গেছে। কিন্তু সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আবার রোগীর ভেতরে অক্সিজেন ঘাটতির কোন লক্ষণ প্রকাশ পাবে না, কিন্তু তার মৃত্যু হবে। এছাড়া শিশুদের মধ্যে ‘কাওয়াসাকির’ মতো রক্তনালী স্ফিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যাতে শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
জানা গেছে, কোভিড -১৯ এর আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন একজন চীনা নাগরিকের ওপর অটোপসি (মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধান) পরিচালিত হয়। যেখানে প্রথম প্রতীয়মান হয় করোনাভাইরাস মানবদেহের ফুসফুসে কি ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে। অটোপসিতে কোভিড-১৯ এর প্যাথলজিকাল বৈশিষ্ট্যগুলি তীব্র শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (সার্স), মধ্যম শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (মার্স) এবং করোনাভাইরাসের একই পরিবারে হওয়ায় ফুসফুসে একই ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি স্ট্রোকের মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে। তবে অন্য অঙ্গগুলির কোনও ক্ষতি হওয়ার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চীনা রোগ বিশেষজ্ঞরা আরও ভাল চিকিৎসা এবং একটি ভ্যাকসিন বিকাশের জন্য এই রোগ সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে এখনও ১১ টি অটোপসি পরিচালনা করছেন। তবে এর রোগজীবাণু সংক্রান্ত প্রক্রিয়া এবং লক্ষণগুলি এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
প্রথম প্রকাশিত অটোপসি ফলাফলে উহান থেকে একজন ৮৫ বছর বয়সী ব্যক্তির ফুসফুসে শর্সের মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। লিউ লিয়াং হলেন প্রথম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যিনি গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ওই বৃদ্ধার মৃতদেহটি পরীক্ষা করেন।
ব্রাজিলের গবেষকরা স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ থেকে রক্ষার্থে সন্দেহভাজন করোনভাইরাস মৃত্যুর ক্ষেত্রে ন্যূনতম আক্রমণাত্মক অটোপসি কৌশল ব্যবহার করছেন। প্যাথলজিস্টরা সম্ভাব্য সংক্রামক অঙ্গ, তরল এবং স্রাবের সংস্পর্শে আসেন। ছয় বছর ধরে, ইউনিভার্সিটি সাও পাওলো স্কুল অফ মেডিসিনের হাসপাতাল দাস ক্লিনিকাসের গবেষকরা এ সংক্রান্ত কৌশল রপ্ত করছেন। যার মধ্যে আফ্রিকার ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা ব্যবহৃত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানকার চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মৃতদেহগুলো একটি প্রতিরক্ষামূলক, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মধ্যে আবৃত করেন এবং রোগ বিশেষজ্ঞরা তাদের বিশ্লেষণ করতে চান এমন অঙ্গগুলির- নমুনা সংগ্রহে প্রাথমিকভাবে একটি আল্ট্রাসাউন্ড ডিভাইস ব্যবহার করে। যেটাতে ছোট ছোট সূঁচ ব্যবহার করে গবেষকরা মরদেহ থেকে টিস্যু বের করে আনেন। এই প্রক্রিয়ায় গবেষকরা নিরাপদ থাকেন এবং সন্দেহভাজন কোভিড-১৯ রোগীদের টিস্যু নমুনাগুলি সংগ্রহ করে রোগের জৈবিক জ্ঞান বিকাশের জন্য ব্যবহার করেন। গবেষক দলের অন্যতম সদস্যা ড. সালদিভা বলেছেন, আমরা গবেষকরা ব্যবহারের জন্য টিস্যু নমুনাগুলির একটি জৈবিক ভান্ডার তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছি। যা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রক্রিয়া বুঝতে এবং রোগ নির্ণয়ের উন্নতি করতে সহায়তা করবে। মস্তিষ্ক, হার্ট, ফুসফুস, প্লীহা, অন্ত্র এবং অন্ড কোষের পাশাপাশি লালা গ্রন্থি থেকে নমুনাগুলি সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলি ব্যয়বহুল নয়। তবে কৌশলটির প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অটোপসি করে অনেক কিছু জানা সম্ভব, যা রোগ উপসমে কার্যকর ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে প্রণিত গাইডলাইনে এটি অন্তভর্‚ক্ত করা প্রয়োজন কিনা সেটা মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাইরাসটি আমাদের কি ধরনের ক্ষতি করছে তা আমরা জানি না। মানবদেহে করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে বিষদভাবে জানতে মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। ইতালিতে অটোপসি করে মানবদেহে এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধান করা ছাড়া ওই রোগ এবং রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত যে ক্লিনিক্যাল গাইড-লাইন ইতিমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে সেখানে অটোপসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাবে আমি মনে করি দেশের প্রয়োজনে এবং দেশের মানুষের সুচিকিৎসায় গাইডলাইনে বিষয়টি দ্রতই অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অটোপসি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ