পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার সকল সামাজিক সিস্টেমগুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। কখনও কখনও মৃত্যুভয়ে আবার কখনও কখনও লোভের বশবর্তী হয়ে আমরা নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের মানদন্ডে পরাজয় বরণ করছি। সন্তান তার মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে আসছে। বাবা তার করোনাগ্রস্ত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। স্বামী তার স্ত্রীর, আর স্ত্রী তার স্বামীর পাশে থাকতে পারছে না। প্রতিবেশীরা মসজিদের খাটিয়া দিচ্ছে না করোনায় মৃত্যু সন্তানের লাশ কবরস্থানে নিতে। লাশ গোছলের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কবর খনন করার মানুষ ভয়ে লাপাত্তা। বাবা মার জানায় সন্তানরা, আর সন্তানের জানাযায় বাপ ভায়েরা অংশগ্রহণ করতে পারছে না। সীমিত আকারে স্বাস্থ্য প্রটোকল মেনে খুব কমসংখ্যক আত্মীয় স্বজন অংশগ্রহণ করার অনুমতি পাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে আপনজনের লাশ দাফন কাফনের দায়িত্বটা দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
করোনা ঐতিহ্যগতভাবে বছরের পর বছর গড়ে উঠা সামাজিক বন্ধনগুলোকে ঠুনকো করে দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সমাজে এক বিরাট ক্ষত তৈরি হচ্ছে। রোজা চলছে অথচ বন্ধুকে ডাকবো না ইফতারের টেবিলে। আত্মীয়-স্বজনকে তো অনেক আগেই ফেসবুকে বারণ করে দিয়েছি বাসায় না আসার জন্য। পুরো মাস হয়তো ঘরে থেকেই রোজা পালন করতে হবে প্রতিবেশীর সাথে হবে না দেখা তারাবিতে। ঈদের নামাজ জামাতে আদৌ হবে কিনা জানে না কেউ। বাবা মার কবর জিয়ারতে সন্তানের যাবার সুযোগটাও হয়ে গেছে অনিশ্চিত। কোথায় হবে ঈদের জামাত তার ঠিক নেই। বড় বড় দালানের ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাস করলেও আগের মতো আর ইফতারের প্লেট আদান প্রদান হবে না করোনা ভয়ে। ইফতার পার্টি হবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ঈদ উত্তর কোলাকুলির কথা হয়ত ভুলেই যাবো। বাচ্চারা ঈদে সেলামী পাবে না। কেউ কেউ না পেয়ে বড়দের উপর বড্ড মন খারাপ করবে। এই মুহূর্তে দেশের পথঘাট বন্ধ। মানুষ ঘরবন্দি। বিপণিবিতানগুলো এখনও বন্ধ। কবে খুলবে তা জানা নেই। এবার হয়ত ঘটা করে উৎসবের আমেজে ঈদের নতুন পোষাক আর কেনাই হবে না। আত্মীয়-স্বজন বঞ্চিত হবে নতুন গিফ্ট থেকে। কেউ আবার মনক্ষুণ্ণ হবে। বিদেশ থেকে আসবে না ঈদ বাজারের জন্য ডলার। পরবাসী সন্তান এবার বাবা মার কোলে ফিরে আসবে না যোগাযোগ বিচ্ছন্নতার কারণে।
যাদের আত্মীয়-স্বজন আবার ইতোমধ্যেই প্রবাসী জীবনে করোনায় মৃত্যু বরণ করেছেন তাদের পরিবারে থাকবে শোকের ছায়া। দেশে বেঁচে যাওয়া বাবা মা লকডাউনের কারণে পাড়া প্রতিবেশীকে জড়িয়ে কাঁদতেও পারবে না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্ব কি দেখেছে এমন মহামারী(?) নাকি কেউ কোনদিন কল্পনাও করতে পেরেছিলো এমন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা? কিন্তু বাস্তবে আমরা তাই দেখছি। করোনা মহামারি কোন একক দেশের লড়াই নয়। লড়াইটা গোটা বিশ্বের। তাই সবাইকে লড়তে হবে সস্মিলিতভাবে। করোনায় মানুষ মরছে। আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। লকডাউনে নিম্নআয়ের ঘরবন্দি মানুষের খাদ্য সঙ্কট আস্তে আস্তে প্রকট হচ্ছে। দেশে দেশে নাজুক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি। উৎপাদন ও শিল্পের চাকা বন্ধ। এমন এক পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বকে লড়াই করতে হচ্ছে এক অদৃশ্য শত্রু করোনার সাথে। এ লড়াই শুধু মাত্র একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়। লড়াইটা হলো কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের মুখে দু’বেলা খাদ্য তুলে দেবার লড়াই। কর্মহীন মানুষকে কর্ম পাইয়ে দেবার লড়াই। দেশে দেশে কলকারখানা চালু করার লড়াই। ভুলুণ্ঠিত মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। সর্বোপরি অর্থনীতির চাকাকে সচল করার লড়াই। এ লড়াইয়ে বিশ্বকে জিততেই হবে। না হলে পরাজিত হবে বিশ্ব মানবিকতা। পরাজিত হবে মানুষের মূল্যবোধ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমনতর একটি কঠিন মুহূর্তে আমাদের চারপাশে দেখছি অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতি। একশ্রেণির মানুষ যখন খাদ্যের অন্বেষণে জীবন সংহার হতে পারে জেনেও লকডাউন উপেক্ষা করে ত্রাণের জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামছে। তখন আরেক শ্রেণির মানুষ(!) গরিবের ত্রাণের চাল চুরিতে ব্যস্ত। এরা কোথাও কোথাও ক্ষমতার দাপটে আবার কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ত্রাণ লোপাট করছে। প্রধানমন্ত্রী যখন অসচ্ছল মানুষের মুখে দু’বেলা খাবার পৌঁছে দেবার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন মানবতা বিবর্জিত কিছু মানুষের ত্রাণ চুরির ঘটনা আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছে ৭১’র কথা। যখন পাকিস্তানী হায়েনাদের অত্যাচারে মানুষ ঘরহারা, বসত ভিটা থেকে বিতাড়িত, প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দিকবেদিক ছুটছে, তখন কিছু মানুষ(!) অন্যের সম্পদ লুট করছে, দখলে ব্যস্ত অন্যের ঘরবাড়ি।
আজকের দিনেও কিছু মানুষ অন্যের ত্রাণ চুরি করছে। আবার কেউ কেউ অতি মুনাফার আশায় নিত্যপণ্য মজুদ করে বাজারে সঙ্কট তৈরি করছে। হায়রে মানুষ! হায়রে মানবিকতা! হায়রে লোভ! আজ যে যুদ্ধে গোটা বিশ্ব লড়াই করছে, সেখানে একজন গর্ভবতী মা রাস্তায় সন্তান প্রসব করছে, চিকিৎসার অভাবে রোগীরা এক হসপিটাল থেকে ছুটছে অন্য হসপিটালে, মৃত্যু মানুষের লাশ দাফনের দায়িত্ব পর্যন্ত পাড়া প্রতিবেশী নিচ্ছে না, তখনও লুটপাট ও মজুতদারির নোংড়া মানসিকতা থেকে আমরা বের হতে পারলাম না। করোনায় কে বাচঁবে কে মরবে তা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু করোনা পরবর্তী বিশ্বে যেন মানবতা, নৈতিকতা ও কল্যাণবোধ মরে না যায় সে লক্ষ্যে এখন থেকেই সকল প্রকার অন্যয়-অত্যাচার, অর্থপাচার, লুটপাট বন্ধ করতে হবে। করোনা আসলে কারো ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ বিত্তকে তোয়াক্কা করেনা। আর করে না বলেই কিন্তু করোনা ধনী গরিব সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
যারা একদিন তাদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে অহংকার করতো, গর্ববোধ করতো তারাও আজ করোনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে মানুষ কতটা অমানবিক হলে দেশে করোনা সৈনিক ডাক্তারদের সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে? নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে স্বাস্থ্য কর্মীদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে? দেশটাকে বাঁচাতে হবে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানুষের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে হবে। আর তা না পারলে বিশ্বমানবতা বিপন্ন হবে। এত খারাপ কিছুর মাঝেও কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ এখনও যে বেঁচে আছে তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সিলেটের গরিবের ডাক্তার খ্যাত এক তরুণ চিকিৎসক, হতদরিদ্র ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন। নাজিমুদ্দিন আমাদের পরাজিত করে মানবিকতাকে জয়ী করেছেন। যিনি তাঁর ভিক্ষে করে বাড়ি বানানোর জন্য জমানো টাকার পুরোটাই তুলে দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে। মানবিকতার অনন্য নজির সৃষ্টিকরা একটি ঘটনার কথার মধ্যদিয়ে লেখাটার পরিসমাপ্তি করতে চাই। মেয়েটির নাম ঊষরংধ এৎধহধঃড়, ব্রিটিস নাগরিক। বয়স ৩২ বছর। করোনা চিকিৎসায় অক্সফোর্ডের নতুন ভ্যাকসিনটা প্রথম তার শরীরে দেয়া হয়েছে। শরীরে এন্টিবডি তৈরি হলে তাকে দেয়া হবে করোনাভাইরাস। ভ্যাকসিন কাজ না করলে তার মৃত্যুও হতে পারে। কোনদিন দেখা বা চেনা হবে না এমন লাখো কোটি মানুষের জন্য সে নিয়েছে এই ঝুঁকি।
এই মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অনেক বীরের নাম আমরা কোনো দিনই জানবো না। নাম না জানলেও যেন না ভুলি, মানুষ মানুষের জন্য এই চেতনায় অনেকে কাজ করে বলে আমরা এখনো দিন বদলের স্বপ্ন দেখি।
লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।