পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চলমান করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব সভ্যতাকে এক অভূতপূর্ব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। গত চারমাসে দুই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পরও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে সামরিক প্রযুক্তি ও মারণাস্ত্রের মজুদ নিয়ে গর্বোদ্ধত পরাশক্তিগুলো। বছরে ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক ব্যয় নির্বাহ করে বিশ্বের শতাধিক দেশে সামরিক উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষের আহাজারি ও সংক্ষোভের দৃশ্য সারাবিশ্ব দেখেছে। সেখানে ডাক্তারদের জন্য মাস্ক নেই পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুউপমেন্ট (পিপিই) নেই, স্যানিটাইজার নেই, শত শত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত, অনেকের মৃত্যুবরণ করার রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি মার্কিনীরা হতবিহŸল, দিশেহারা। করোনা মমহামারী নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ার শুরু থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা উন্মাদের মতো আচরণ করে চলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি, ফিলিস্তিনী শান্তি প্রক্রিয়ায় দ্বি-রাষ্ট্রের সমাধান এবং জেরুজালেমের অবস্থানের মতো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ববহনকারী অনেক কিছুকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোক্স বলে উড়িয়ে দিয়ে খামখেয়ালিপনার বিষয়ে পরিণত করেছেন। চীনের পর ইউরোপে হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শাট-ডাউন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে অনীহা ও দেরি করার খেসারত দিতে হচ্ছে মার্কিন জনগণকে। এই মুহূর্তে বিশ্বের ২ শতাধিক রাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী মহামারী ছড়িয়ে পড়লেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ বিশেষভাবে আলোচিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ নয়, করোনায় আক্রান্ত প্রথম দেশও নয়, তথাপি এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনায় মৃত্যুর হার ও সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গোয়ার্তুমি ও অপরিণামদর্শিতাকেই দায়ী করা হচ্ছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস প্রাণঘাতী রূপে ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকে করোনা নিরোধী চিকিৎসা সরঞ্জামাদি (মাস্ক, হ্যান্ডগøাভস, পিপিই ইত্যাদি) করোনা চিকিৎসায় কার্যকর বলে দাবি করা ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং সবশেষে করোনাভাইরাস নির্মূলে শরীরে ডিজইনফেট্যান্ট প্রয়োগের মতো নানা বিষয় নিয়ে বালখিল্য ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে ট্রাম্পকে। তবে করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগময় সময়েও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যনীতি এবং যুদ্ধংদেহি মনোভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। অথচ এই মহাদুর্যোগের পর পুরো বিশ্বব্যবস্থা এবং বিশ্বমানবতায় আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
যে অর্থনীতি এবং বিশ্বব্যবস্থা মানুষের জীবন রক্ষায় সক্ষম নয়, সে ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন ব্যবস্থা চালুর সম্ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। শিল্পোন্নত বিশ্বে একদিন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকলে শত বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। গত চারমাস ধরে শুধু অর্থনৈতিক কর্মকান্ডই বন্ধ রাখা হয়নি, সেই সাথে লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিং নির্দেশাবলী জারি করে সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় গণজমায়েত পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও ইউরোপ আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এইভাইরাসে মৃত্যুই যেন শেষ কথা নয়, মৃত্যুর পর নিজ নিজ ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি নীতি অনুসারে প্রত্যাশিত সৎকার, জানাজাসহ প্রত্যাশিত সম্মান ও রিচুয়াল থেকেও বঞ্চিত হওয়ার মতো অবস্থা দেখা দিয়েছে। বাড়িতে, রাস্তায় বা হাসপাতালে রোগী মরে পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, শোক প্রকাশের জন্য পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষের জীবনে হাসপাতালে মৃত্যুর আগে প্রিয়জনের, সন্তানের, পিতা-মাতার সাথে শেষ দেখা, আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে শেষ ইচ্ছার কথাগুলো না বলাই রয়ে গেছে। এতদিনে হাজার হাজার কোটি টাকায় গড়ে তোলা অত্যাধুনিক হাসপাতাল ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকরী অগ্রগতি, স্বাস্থ্যখাতের কর্পোরেট ইন্ডাসট্রিয়ালাইজেশন এক অতি ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসের কাছে ধরাশায়ী হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারীতে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক-অর্থনৈতিক সুরক্ষায় রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও দায়-দায়িত্ব পালনে সাফল্য ও ব্যর্থতার যে চিত্র উঠে আসছে তাতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার গতানুগতিক ধারণা পাল্টে গিয়ে একটি নতুন মানচিত্রের আবির্ভাব ঘটলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। গতানুগতিক অর্থনৈতিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতার অসারতা ইতোমধ্যেই পরিস্ফুট হতে শুরু করেছিল। সেই সত্তরের দশকে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভুটানের রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক যখন প্রথম জিডিপি (গ্রস ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি) প্রবৃদ্ধির বদলে জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) ধারণাকে জাতীয় মূল নীতি হিসেবে চালুর উদ্যোগ নেন তখন বিশ্বের কোনো দেশই এই ধারণার সারবত্তা উপলব্ধি করতে পারেনি। গত চার দশকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরির্তন, প্রাকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়, মানব সমাজে অশান্তি-অস্থিতিশীলতা, দ্বন্দ-সংঘাতের পেছনে থাকা ভোগবাদ ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় ক্রমবর্ধমান অশান্তির কালোছায়া এটাই প্রমাণ করেছে যে, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে শান্তির পথ অন্বেষণ করাই সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিষয়। শিল্পোন্নয়ন ও সীমাহীন অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা দেশে দেশে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা, জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। যার সামষ্টিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট করে তুলছে। শিল্পায়নের অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন লাখ লাখ টন ফসিল জ্বালানি পুড়িয়ে হাজার হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-পারঅক্সাইডসহ নানা দূষিত উপাদান বাতাসে, পানিতে ও মাটিতে ছড়িয়ে দেয়ার কারণে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও বিশ্বের উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে তার ফল হিসেবে কোটি কোটি মানুষের ক্যানসার, হৃদরোগ, কিডনি ফেইলিউর, ডিপ্রেশন, ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব। দূষণ ও উষ্ণায়ন সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে না পারলে হিমালয়সহ সুউচ্চ পর্বতগুলোর আইসক্যাপগুলো গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েক মিটার বেড়ে যাবে। এর ফলে লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি এবং কোটি কোটি মানুষের জনপদ সমুদ্রের পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে বড় ধরনের খাদ্যঘাটতি ও উদ্বাস্তু সংকটের জন্ম দেবে বলে কয়েক দশক ধরে পরিবেশবাদী ও আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এর আগেই করোনাভাইরাস আমাদের সামনে ভিন্ন বার্তা, ভিন্ন আশঙ্কা ও বাস্তবতা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই মহামারীর গন্তব্য বা শেষ কোথায় তা এখনো অনিশ্চিত। আমরা কেউই এই মহামারীর আশঙ্কা থেকে মুক্ত নই।
এখনো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা সফল কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কোটি কোটি মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা এবং ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিংই করোনাভাইরাস থেকে এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার একমাত্র কার্যকর প্রতিবিধান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়লরা ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম নিয়ে কোটি কোটি সদ্য বেকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেও এই ব্যবস্থা বেশিদিন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কোনো দেশেরই নেই। এ কারণেই প্রতিদিন বিশ-পঁচিশ হাজার নতুন সংক্রমণ ও দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর মধ্যেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লকডাউন তুলে দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু করার বিষয় চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ভয়াল দৃশ্য দেখার পরও বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে লকডাউন ও সোশ্যাল ডিসটেন্সিং রক্ষা করা যাচ্ছে না। শ্রেফ পেটের দায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজি বা ত্রাণের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে আসছে হাজারো মানুষ। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ২শ’র কম। আক্রান্ত প্রায় ৬ হাজারের বেশি। অন্য অনেক দেশের তুলনায় এ পরিসংখ্যান হয়তো স্বস্তিদায়ক। তবে করোনাকারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। করোনার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীরা প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। সব হাসপাতালে করোনাবহির্ভূত জটিল এমনকি সাধারণ রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের সেবা বঞ্চিত রোগীদের বিক্ষোভ করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। রোগীদের সাথে ডাক্তার ও নার্সদের মানবেতর আচরণের অভিযোগসহ নানাবিধ অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের অগোছালো, প্রস্তুতিহীন অবস্থা সম্পর্কে শুরুতেই বিশ্ব সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। দুই মাস পেরিয়ে এসেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতিহীনতার চিত্রই প্রকট। এখনো দেশে গড়ে প্রতিদিন করোনা পরীক্ষা হচ্ছে ৩-৪ হাজার মাত্র। যেখানে শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই ৬ লক্ষাধিক মানুষের বিদেশ ভ্রমণের রেকর্ড আছে। বিদেশ ফেরত এসব মানুষ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক সংক্রমণ সৃষ্টি করেছে। এ কারণেই লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা না গেলে মে মাস নাগাদ বাংলাদেশে করোনা মহামারী ভয়াল রূপ ধারণ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রাণহানী যে পর্যায়েই ঘটুক না কেন, দেশে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়া এবং কোটি কোটি মানুষ কর্মসংস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ায় দারিদ্র্য পীড়িত অনাহারক্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশে সাধারণ ছুটি ও লকডাউনে কর্মহীন মানুষ এখন করোনাভাইরাসের চেয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের ভয়ে বেশি আড়ষ্ঠ হয়ে পড়েছে। যে দেশ যত বেশি শিল্পোন্নত বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সে দেশ তত বেশি পরনির্ভশীল। করনোভাইরাসের মহামারী দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে পশ্চিমাবিশ্বে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা একটি বিশ্বমন্দায় রূপ নিতে পারে। ইতালি, আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্দা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি খাতকে সরাসরি আঘাত করছে। জ্বালানি তেলের মূল্যে ধস, সউদি আরব , সিঙ্গাপুর বা আরব আমিরাতের মন্দা বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে চলেছে। এর মানে হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপ যেমনই হোক, এর বৈশ্বিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। অন্যদিকে কোন দেশ করোনাভাইরাস মহামারী কীভাবে মোকাবেলা করেছে, কোন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তার অবস্থা সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন আগামীদিনে রাষ্ট্র হিসেবে দেশগুলোর সমৃদ্ধি ও মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে মারা যাচ্ছে, তখন সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকার পরও বাংলাদেশে অবস্থানরত ইউরোপ-আমেরিকান নাগরিকরা কাতার এয়ারওয়েজ থেকে চার্টাড প্লেন এনে ব্যাপক হারে ঢাকা ছেড়েছে। এর মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারণা ও আস্থাহীনতা ধরা পড়ে।
করোনাভাইরাসের দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বের দেশগুলোর সামর্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই তাদের পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করতে শুরু করেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গেøাবাল-এর গেøাবাল রেজিলিয়েন্স ইনডেক্স-১৯’এ বিশ্বের ১৩০টি দেশের করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবেলা সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৬তম। আর এ সপ্তাহে প্রকাশিত জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি এশিয়া প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি দেশের জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গেøাবাল রিজেলিয়েন্স ইনডেক্সে শতাধিক দেশের পেছনে থাকার তিন সপ্তাহ পর ইউএনডিপির জরিপে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর তো বটেই, ইরান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনেরও ধারে কাছে নেই বাংলাদেশ। এমনকি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা নেপালও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকার চিত্র উঠে এসেছে ইউএনডিপির রিপোর্টে। জরিপে ব্যবহৃত ৮টি সূচকের মধ্যে থাইল্যান্ড, ইরান ও ফিলিপাইন ৭টি খাতে নাগরিকদের সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয়েছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর ৬ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে দ্বিতীয় সারিতে অবস্থান করছে, ৫ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে জাপান, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও ভারত তৃতীয় সারিতে অবস্থান করছে। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা চারটি এবং নেপাল ও পাকিস্তান তিনটি পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বয়স্ক ও প্রতিবন্দীদের ভাতা দেয়া ছাড়া আর কোনো সূচকেই বাংলাদেশের পদক্ষেপ নেই বলে ইউএনডিপির রিপোর্টে বলা হয়েছে। ইউএনডিপি’র পক্ষে এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিস্ট নেটওয়ার্ক নামের একটি সংস্থার এই জরিপে যে সব বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, স্বল্প খরচে ও সহজে সব নাগরিকের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানোর উদ্যোগ, অসুস্থতার সময় পর্যাপ্ত ভাতা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত রাখা ও কর্মসংস্থান হারানো মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়া এবং চাকরিজীবীদের চাকরিচ্যুতি ঠেকানোর মতো পদক্ষেপ। রিপোর্ট অনুসারে এসব ক্ষেত্রে এশিয়াপ্যাসিফিকের অন্যদেশগুলোর পাশাপাশি ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানের সমান সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
করোনাভাইরাস মহামারীর পর বৃটেন এবং ভুটানের মধ্যকার সামাজিক-অর্থনৈতিক পার্থক্যের ব্যবধান নিয়ে নতুন করে হিসাব কষতে বসবে মানুষ। যুদ্ধের শিল্প ও মানবিক সুরক্ষার মধ্যে যে স্বার্থের দ্ব›দ্ব তৈরি হয়েছে তা নিরসনের একটি বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রত্যাশা করছে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ববাস্তবতার আলোকে ভাইরাস, মহামারী, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগ দেখা যেতে পারে বলে রাজৗনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রত্যাশা করেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধের দুই দশকের মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারসহ কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানী ঘটলেও লিগ অব নেশনস থেকে জাতিসংঘ পুনর্গঠন এবং পারমাণবিক বোমা বিরোধী ননপ্রলিফারিং ইনিশিয়েটিভসহ আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ ও সম্মিলিত পদক্ষেপের কারণে গত ৭৫ বছরেও বিশ্বকে আর কোনো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়নি। করোনাভাইরাস নিয়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বেøইম-গেইম ও ঠান্ডা লড়াইয়ের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমা ইউনিপোলার সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধরে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ প্রায় সব বিশ্ব সংস্থাকে নিজেদের সুবিধামত পরিচালনা করে এলেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজেগোবুরে অবস্থায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উপর চীনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার চাঁদা ও অনুদান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। করোনাভাইরাস মহামারী পরবর্তী বিশ্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা, দায়িত্ব ও ভূমিকা অনেক বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় এই সংস্থার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈরিতা ও অসহযোগিতা একটি নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় মার্কিন ফেডারেল সরকারের ব্যর্থতা একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে সমর্থনের পাল্লা ডেমোক্রেট প্রতিদ্ব›দ্বী জো বাইডেনের দিকে ঝুঁকতে পারে। তবে জো বাইডেন আশঙ্কা করছেন, করোনা মহামারীর অজুহাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচন বাতিল করে দিতে পারেন। আর জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মার্কিন নীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা যায়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।