পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রথম ধরা পড়ে মার্চ মাসের ৮ তারিখে। তারপর থেকে ৫২ দিন পার হয়ে গেছে। সরকার সাধারণ ছুটি বা অঘোষিত লকডাউন জারী করেছে ২৫ মার্চ। সেই হিসাবটি ধরলেও ৩৫ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এই ৩৫ দিন থেকে মানুষ বলতে গেলে গৃহবন্দি। অবশ্য একটি কথা টেলিভিশন সংবাদ এবং দৈনিক সংবাদপত্রে নিয়মিত বলা হচ্ছে যে, শহরাঞ্চল এবং বড় জোর শহরতলী ছাড়া গ্রামগঞ্জে কেউ এই অঘোষিত লকডাউন মানছে না। তারপরেও একথা বলা যাবে না যে, এই শাটডাউন গণহারে অমান্য করা হচ্ছে। আসলে ঘরে থাকতে থাকতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এখন যে সাধারণ প্রশ্নটি সব শ্রেণির মানুষের মনে উদিত হচ্ছে, সেটা হলো, করোনাভাইরাস কবে যাবে? এর কোনো উত্তর নাই। কারণ, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। অবশ্য সারাবিশ্বের ৭৮টি মেডিকেল ল্যাব করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। গত শনিবারের খবর, ইংল্যান্ডে একটি নব আবষ্কিৃত ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলকভাবে দুইজন মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এই পরীক্ষামূলক ট্রায়াল ব্যর্থ হয়েছে। দেখা গেছে, ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরে তাদের শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এখন বলা হচ্ছে যে, হয়তো আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সঠিক ভ্যাকসিনটি এক বা একাধিক দেশ আবিষ্কার করবে। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে গণহারে প্রয়োগের জন্য সেটি পাওয়া যাবে আগামী বছরে জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে কোনো এক সময়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী কোনো আশার বাণী নাই।
এর মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে আরো কতকগুলি উদ্বেগজনক খবর পাওয়া গেছে। আজ যে খবর পাওয়া যায় আগামীকালের খবরের সাথে তার কোনো মিল থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো সাংঘর্ষিক হয়। তেমনি একটা খবর হলো, করোনার আক্রমণের তিন মাস পর দেখা যাচ্ছে যে, সব রোগীর ক্ষেত্রেই যে লক্ষণ বা উপসর্গ থাকবে তার নয়। অত্যন্ত সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে, অনেক করোনা রোগী অংুসঢ়ঃড়সধঃরপ বা লক্ষণবিহীন। অর্থাৎ এই ধরনের রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে করোনার স্বাভাবিক লক্ষণসমূহ, যথা জ্বর, সর্দি, গলা ব্যাথা এবং শ্বাসকষ্ট দেখা যায় না। এরা একজন সুস্থ মানুষের মতোই অন্যদের সাথে মেলামেশা করেন, কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীর মতোই তারা সংক্রামক, অর্থাৎ তারাও রোগ ছড়ায়। এই ধরনের অংুসঢ়ঃড়সধঃরপ রোগের মধ্যে যাদের ওসসঁহব ঝুংঃবস অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তারা শয্যাশয়ী হয় না। কিন্তু যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা একদিন অকস্মাৎ শয্যাশয়ী হয়ে পড়ে।
দুই
কয়েকদিন আগে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক করোনা নিয়ে আরেকটি উদ্বেগজনক সংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, এতদিন একটি ধারণা ছিল যে, কোনো ব্যক্তি যদি করোনায় আক্রান্ত হন এবং পরে সুস্থ হয়ে উঠেন তাহলে তার আর করোনা হবে না। অর্থাৎ তার জবরহভবপঃরড়হ আর হবে না। কিন্তু বৈশ্বিক পরিমন্ডলে এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, একাধিক দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়া ব্যক্তি একমাসের মধ্যে আবার আক্রান্ত হচ্ছেন। এই ঘটনা কিন্তু হরহামেশা ঘটছে না বা এটিকে জেনারালাইজড করাও যায় না। ব্যতিক্রমী হলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ‘ডেইলী স্টারের’ ২৩ ও ২৪ এপ্রিল সংখ্যায় এই ধরনের ৩/৪টি কেসের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এসব পটভূমিকায় যদি বাংলাদেশের অবস্থা বিবেচনা করা যায় তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের মতো আত্মতৃপ্তির কিছু নাই। গত ১৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয় যে, বিগত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০১২। কিন্তু ২৫ এপ্রিলের বুলেটিনে দেখা যায় যে, পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯৯৮, অর্থাৎ ৫ হাজার। ৯ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯৮৬। এই ৯ দিনে গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪২ জন রোগী। অথচ তার আগে একমাসের গড় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে দৈনিক ১২৫ থেকে ১৩০। তার পরবর্তীতে এই সংখ্যা লাফ দিয়ে বাড়ার কারণ হলো, পরীক্ষাগার বা টেস্টিং ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেই সুবাদে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি। ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন যে, ২৪ এপ্রিল শুক্রবার ল্যাবের সংখ্যা ছিল ২১। আগামী ২৮ তারিখের মধ্যে ল্যাবের সংখ্যা বেড়ে হবে ২৮ । ২৮টি ল্যাব যদি তাদের সংস্থাপিত নমুনা পরীক্ষার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে তাহলে দৈনিক ৩০০টি করে পরীক্ষা করলে ২৮টি ল্যাব দৈনিক ৮৪০০টি নমুনা এবং মাসে ২ লক্ষ ৫২ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে পারবে। তারা যদি দৈনিক ২০০টি নমুনার পরীক্ষা করেন তাহলেও মাসে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার পরীক্ষা করতে পারে। এখানে প্রশ্ন হলো, মাসে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার পরীক্ষা তারা ‘করতে পারে’ নয়, তাদেরকে ‘পারতেই হবে’। না হলে বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে, অর্থাৎ এর ব্যাপকতা, বিস্তৃতি ও ভয়াবহতা কোন স্তরে আছে সেটা অজ্ঞাতই রয়ে যাবে। ফলে করোনা মোকাবেলা বা নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
তিন
বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ নাকি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ৪র্থ স্তরে রয়েছে। করোনা সংক্রমণের স্তর বিন্যাস সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভাইরোলজি (জীবাণুবিজ্ঞান) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুর রহমান খান বলেন, ভাইরাস সংক্রমণকে ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে, বাইরের দেশে ভাইরাস ছড়িয়েছে, কিন্তু এখনো আমাদের দেশে আসেনি। দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো, ভাইরাসটি বিদেশ থেকে আসা কারও মধ্যে পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্যায়টি হচ্ছে, ভাইরাসটি বিদেশ ফেরত মানুষের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদেরকেও সংক্রমিত করেছে। এটিকে বলা হয় লোকাল ট্রান্সমিশন। ৪র্থ পর্যায়টি হচ্ছে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। এই পর্যায়ে রোগটি কারো দেহে পাওয়া যায় যার সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণের কোনো ইতিহাস নাই। এই পর্যায়ে সংক্রমণটিকে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে সেটি মহামারীতে রূপ নেয়। এক সপ্তাহ পূর্বেও আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনে ছিলাম। কারণ তখন বেশ কয়েকজন রোগীর কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে কোনো প্রবাসীর সংস্পর্শ পাওয়া যায়নি যার টেস্ট পজিটিভ। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স বা আমেরিকার করোনা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, শুরুর দিকে তাদের সংক্রমণ বা মৃত্যুর হার কম ছিল। কিন্তু ৩/৪ সপ্তাহ পর তাদের সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার হু হু করে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এখন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাও আবার সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার টেস্টের বিপরীতে। যখন এই টেস্ট অন্তত: ৬ হাজারে পৌঁছবে তখনই আমরা বুঝতে পারবো যে বাংলাদেশে করোনা মহামারীর রূপ ধারণ করেছে কিনা। টেস্টের মন্থর গতি দেখে বিশেষজ্ঞরা র্যাপিড অ্যান্টি বডি টেস্টের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। বর্তমানে পিসিআর মেশিনে পরীক্ষা চলছে। আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ যেমন সময় সাপেক্ষ, তেমনি পরীক্ষার ফলাফল প্রাপ্তিও সময় সাপেক্ষ। কিন্তু র্যাপিড অ্যান্টি বডি টেস্টে রক্ত সংগ্রহ ও পরীক্ষা ১৫ থেকে ২০ মিনিটে করা যায়। তাই ডা. এবিএম আব্দুল্লাহসহ একাধিক বিশেষজ্ঞ অবলিম্বে অ্যান্টি বডি টেস্ট শুরু করার সুপারিশ করেছেন। আমেরিকা, ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়া র্যাপিড অ্যান্টি বডি টেস্ট করেছে। আমেরিকা এখন পর্যন্ত ৪৫ লক্ষেরও বেশি টেস্ট করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া করেছে দিনে ১ লক্ষ টেস্ট। ভারত দৈনিক ৫৫ হাজার। গত ২৫ এপ্রিল ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দৈনিক ১ লক্ষ টেস্ট করবে।
চার
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভিয়েতনামে করোনাভাইরাসে একজন রোগীও মারা যায়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের সাথে আমাদের তুলনা চলে না। কারণ এইগুলো ছোট দেশ এবং তাদের জনসংখ্যাও কম। তবে লক্ষ করার বিষয় এই যে, নেপালের আয়তন বাংলাদেশের সমান। ৫৬ হাজার ৮২৭ বর্গ মাইল। সেখানে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫১ এবং মৃত্যু শূন্য। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়েও বড়, ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৮৮২ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ৯ কোটি ৫৫ লক্ষ। সেখানে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত শনাক্ত ২৭০ জন। মৃত্যু শূন্য (সূত্র: ওয়ার্ল্ড ও মিটার)।
মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ করোনার ৪র্থ পর্যায়ে, অর্থাৎ মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছতে যাচ্ছে। মে মাসের প্রথম ১৪ দিন ক্রুশিয়াল। তখন বোঝা যাবে আমরা কোন পর্যায়ে রয়েছি। ঠিক তার আগে সীমিত পর্যায়ে হলেও অফিস আদালত, কারখানা, ব্যাংক ইত্যাদি খুলে দেওয়া কতখানি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে সেটা চিন্তার বিষয়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।