Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভবিষ্যতে মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই হবে কীভাবে : বিল গেটস

কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব

দ্য ইকোনোমিস্ট | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৩ এএম

ইতিহাসবিদরা যখন কোভিড-১৯ মহামারীর উপর বই লিখবেন, আমরা এখন পর্যন্ত কোন পরিস্থিতির মধ্যে জীবন যাপন করছি, তা সম্ভবত সেটির প্রথম তৃতীয়াংশ বা আরো খনিকটা জায়গা দখল করবে। কাহিনীর বেশিরভাগটি জুড়েই থাকবে এর পরবর্তী ঘটনা। বেশিরভাগ ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকাতে মহামারীটির সর্বোচ্চ ভয়াবহতা সম্ভবত এই মাসের শেষের দিকে কেটে যাবে। অনেকের আশা, ডিসেম্বরে যেভাবে ছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু ঠিক তেমন রুপে ফিরে আসবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, এমনটি ঘটবে না। আমি বিশ্বাস করি যে, মানবতা এই মহামারীকে পরাস্ত করবে। তবে কেবল তখনই, যখন জনসংখ্যার বেশিরভাগকেই টিকা দেয়া হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে না। এমনকি যদি সরকারগুলি আশ্রয়স্থলে অবস্থান করার নির্দেশ তুলে নেয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরায় চালুও হয়, মানুষের নিজের মধ্যেই রোগের সংস্পর্শে আসার বিরুদ্ধে প্রকৃতিক বিদ্বেষ রয়ে যাবে। বিমানবন্দরে বিশাল ভিড় থাকবে না। স্টেডিয়ামগুলি খেলাধুলা চলাকালীন মূলত খালিই খাকবে। এবং বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পতিত হবে। কারণ চাহিদা কম থাকবে এবং মানুষ খুব হিসাব করে ব্যয় করবে। মহামারীর বিস্তার উন্নত দেশগুলিতে ধীর হয়ে যায়।

তবে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এটি দ্রুত ছড়াতে শুরু করে। তাদের অভিজ্ঞতা সেকারণে আরো খারাপ হবে। দরিদ্র দেশগুলিতে, যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ করা কমই সম্ভব হয়, সেখানে দূরত্বে থাকার নির্দেশনাগুলিও ফলপ্রসূ হবে না। ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি সংক্রমিতদের যত্ম নিতে সক্ষম হবে না। কোভিড-১৯ নিউ ইয়র্কের মতো শহরগুলিকে নাস্তানাবুদ করেছে।

তবে তথ্য থেকে জানা যায় যে, এমনকি ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালেই আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশগুলির তুলনায় বেশি নিবিড় পরিচর্যার বিছানা রয়েছে। অতএব কোটি কোটি লোকের মৃত্যু ঘটতে পারে। ধনী দেশগুলি সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অতি জরুরি সরবরাহগুলি শুধুমাত্র সর্বাধিক দরদাতার হাতেই যাবে না, তা নিশ্চিত করে। তবে ধনী ও দরিদ্র অঞ্চলগুলির লোকেরা কেবল তখনই একইভাবে নিরাপদে থাকবে, যখন আমরা এই ভাইরাসের কার্যকর চিকিৎসার সমাধান পাবো, এর অর্থ একটি প্রতিষেধক। পরবর্তী বছর যাবৎ চিকিৎসা গবেষকরা বিশ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে থাকবেন।

সৌভাগ্যক্রমে, এই মহামারীটির আগেও তারা ভ্যাক্সিনোলজিতে বিশাল পর্যায় অতিক্রম করেছেন। প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলি সাধারণত আপনার দেহকে একটি মৃত বা দুর্বল ভাইরাসের সাথে পরিচয় করিয়ে প্যাথোজেনের আকারটি সনাক্ত করতে শেখায়। তবে নতুন একটি প্রতিষেধক পদ্ধতিও রয়েছে যাতে গবেষকদের বিশাল পরিমাণে প্যাথোজেনগুলি বৃদ্ধিতে সময় ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। এই এমআরএনএ ভ্যাকসিনগুলি জিনগত কোড ব্যবহার করে আপনার কোষগুলিকে কীভাবে প্রতিরোধে সাড়া দিতে পারে সেই নির্দেশ দেয়। এগুলি সম্ভবত প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলির চেয়ে দ্রুত উৎপাদন করা যেতে পারে।

আমার আশা, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশ্বজুড়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে। যদি এমনটি হয়, তবে এটি হবে একটি ঐতিহাসিক অর্জন : দ্রুততম গতিতে মানবজাতির কোনো নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করা। প্রতিষেধকের এই অগ্রগতি ছাড়াও, এই মহামারী থেকে আরো ২টি বড় যুগান্তকারী আবিষ্কার বের হবে। একটি হ’লো, রোগ শনাক্ত করণের ক্ষেত্রে। পরের বার কোনো নভেল ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে, মানুষ গর্ভধারণের জন্য যেমনভাবে ঘরে বসেই পরীক্ষা করে, সম্ভবত সেভাবেই সেটির পরীক্ষা করতে সক্ষম হবে। তারা কাঠিতে মূত্রের পরিবর্তে তাদের নাকের শ্লেষ্মা রেখে পরীক্ষা করবে।

গবেষকরা একটি নতুন রোগ শনাক্ত করার কয়েক মাসের মধ্যে পরীক্ষা করার জন্য এ জাতীয় সরঞ্জাম প্রস্তত করতে পারেন। ৩য় যুগান্তকারী হবে, ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধগুলি। এগুলি বিজ্ঞানের অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের একটি শাখা ছিল। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ওষুধ তৈরিতে আমরা ততটা সফল হইনি, যতটা আমারা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সফল হয়েছি। তবে এর পরিবর্তন ঘটবে। গবেষকরা বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরালগুলির বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করবেন, যা তারা স্ক্যান করতে সক্ষম হবেন এবং নভেল ভাইরাসগুলির কার্যকর চিকিৎসা দ্রুত সন্ধান করতে সক্ষম হবেন।

এই ৩টি প্রযুক্তিই পরবর্তী মহামারীতে সংক্রমণের সংখ্যা খুব কম থাকা অবস্থাতেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আমাদের প্রস্তুত করবে। তবে এই অন্তর্নিহিত গবেষণা বিদ্যমান সংক্রামক রোগগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতেও সহায়তা করবে। এমনকি আগাম ক্যান্সার নিরাময়েও সহায়তা করবে।

(বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করছেন যে, এমআরএনএ ভ্যাকসিনগুলি একসময় ক্যান্সার ভ্যাকসিনের জন্য দিক নির্দেশক হতে পারে। এমনকি, কোভিড-১৯’র আগে পর্যন্ত কীভাবে কিছুটা সাশ্রয়ী ম‚ল্যে সার্বজণীনভাবে আরএনএ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা যায় সেবিষয়ে তেমন গবেষণাও হয়নি।)

আমাদের অগ্রগতি শুধু বিজ্ঞানেই ঘটবে না। প্রত্যেকে বিজ্ঞান থেকে উপকৃত হবে, তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দক্ষতাতেও ঘটবে। আমি মনে করি, ২০২১ সালের পরবর্তী বছরগুলিতে আমরা ১৯৪৫ সালের পরের বছরগুলি থেকে শিখব। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর নেতারা আরো সংঘাত রোধ করতে জাতিসংঘের এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। কোভিড-১৯ এর পর নেতারা পরবর্তী মহামারী প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন। এটিতে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলির সমন্বয় ঘটবে। আমি আশা করি যে, তারা নিয়মিতভাবে ‘জীবাণু যুদ্ধের খেলা’য় অংশ নেবে ঠিক যেভাবে অস্ত্র যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী অংশ নেয়।

এগুলি আমাদের পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুত রাখবে যখন কোনো নভেল ভাইরাস বাদুড় বা পাখি থেকে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোনো অধম অভিনেতা যদি ঘরে তৈরি ল্যাবে একটি সংক্রামক রোগ সৃষ্টি করে এবং এটিকে অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা করে, তাহলে আমাদেরো প্রস্তুতি থাকবে। মহামারীর বিরুদ্ধে অনুশীলনের মাধ্যমে পৃথিবীও জীবাণু-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করবে। এটি বিশ্বজনীন রাখুন। এসব কিছুই অনিবার্য নয়। ইতিহাস কোনো গতবাধা ছক অনুসরণ করে না। মানুষ কোন পথটি গ্রহণ করবে, তা বেছে নেয় এবং সিদ্ধান্তে ভুল করে ফেলতে পারে। ২০২১ এর পরের বছরগুলি ১৯৪৫ সালের পরের বছরগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে, আজকের সেরা উপমা হতে পারে ১৯৪২ সালের ১০ নভেম্বর।

ব্রিটেন সবেমাত্র যুদ্ধের ১ম পদাতিক জয় লাভ করেছে এবং উইনস্টন চার্চিল একটি বক্তৃতায় ঘোষণা করলে, ‘এটিই শেষ নয়। এমনকি এটি শেষেরো শুরু নয়। তবে এটি সম্ভবত, শুরুর শেষ।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ