Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

করোনা ও তারাবীহ: লাখ লাখ হাফেজের আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত

ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই মসজিদ আছে। এমনকি কোনো কোনো গ্রামে একাধিক মসজিদও আছে। দেশে আসলে বর্তমানে কতটি মসজিদ আছে, তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। ঢাকাকে বলা হয়, মসজিদের শহর। গুগলের দেয়া তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের সংসদ সদস্য শেখ মো. নুরুল হকের প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান সংসদে যে তথ্য দেন, সে অনুসারে দেশে মসজিদের সংখ্যা ছিলো ২ লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি।

গুগলে আর কোনো আপডেট না পেয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নুরুল ইসলামের মোবাইলে ফোন করে দেশের মোট মসজিদের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি জানালেন, বর্তমানে দেশের মোট মসজিদের সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। তিনিও প্রকৃত সংখ্যা না দিতে পারার কারণে যা দাঁড়ালো তাতে করে দেশে বর্তমানে কতটি মসজিদ চালু আছে, তা অজানই রয়ে গেল।
এখন আসি আসল কথায়। এই মুহূর্তে সারাবিশ্বে মরণব্যাধি করোনার কারণে লকডাউন চলছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এদিকে মহিমান্বিত ইবাদতের মাস মাহে রমজান ও রোজা ঘরবন্দি মুসলমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। যে রোজার পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে প্রদান করবেন মর্মে নিজে ঘোষণা করেছেন।
এক মাস রোজা পালন মুসলমানদের জন্য এক মহাপবিত্র ইবাদত হিসেবে বিবেচিত। আর রোজাকে কেন্দ্র করে দেশের সকল মসজিদে উৎসবের আমেজে তারাবীহ নামাজ আদায় করা হয়। দেশের প্রায় তিন লক্ষাধিক মসজিদের অধিকাংশেই খতম তারাবীহ পড়ানো হয়। মুসুল্লিরা সমবেতভাবে দু’জন হাফেজের ইমামতিতে কোরআন খতম করার মানসে সারা মাস তারাবীহ’র নামাজ আদায় করে থাকেন। সে হিসাবে দেশে কমবেশি ৫ লক্ষ হাফেজের প্রয়োজন হয়, সুষ্ঠুভাবে মাসব্যাপী তারাবীহ নামাজ আদায় করার জন্য। কিন্তু তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি নেই। দেশে মোট হাফেজের সংখ্যা কতো, তা গণনা করার কোনো স্বীকৃত সংস্থাও নেই। তাই কোরআনে হাফেজদের প্রকৃত সংখ্যাটা জানাও বেশ দূরহ ব্যাপার। তবে সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, হাফেজগণ সারাবছর কোরআন চর্চা করে থাকেন এই মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে। তারাবীহ’র নামাজের প্রস্তুতি নিতে তাদের এই চর্চা অব্যাহত থাকে বছরব্যাপী।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। দেশে মহামারী করোনা। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও মৃত্যুর মিছিল দিনদিন লম্বা হচ্ছে। মুসুল্লিরা আসন্ন তারাবীহ’র নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে উৎসবের আমেজে আদায় করতে পারবেন, এমন কোনো সুসংবাদ দেশে নেই।
গত ৬ এপ্রিল ২০২০ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় অধিশাখা কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্র নং ১৬.০০.০০০০.০০১.২১.০০৩, ২০২০-১৪৮ এর ৪/১ ধারা অনুসারে ওয়াক্তিয়া নামাজে ইমাম ও মোয়াজ্জিন-সহ ৫ জন, আর জুম্মা’র নামাজে ইমাম ও মোয়াজ্জিন-সহ সর্বমোট ১০ জন মুসুল্লি জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন বলে বলা হয়েছে। সরকার ও ইসলামী ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যেই মুসুল্লিদেরকে নিজ নিজ বাসায় তারাবীহ নামাজ আদায় করার জন্য অনুরোধ করেছেন বা নির্দেশনা জারি করেছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনা রোধ কল্পে এ সিদ্ধান্ত অত্যাবশ্যকীয়। আশা করি, দেশবাসী বিশেষ করে গ্রামের মুসুল্লিরা তা মেনে চলবেন। যে কথা বলছিলাম। করোনা গোটা বিশ্বব্যাবস্থাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর কল্পনাতেও ছিলো না। বিশ্ববাসী এখন প্রতিদিন করোনামুক্ত সকাল দেখার আশায় ঘুমাতে যায়। রাজধানীবাসী এবার রমজানে প্রথমবারের মতো পুরান ঢাকা ও বেইলী রোডের বাহারী ইফতারির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। রমজান মাসে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর, এমনকি গ্রামাঞ্চলের অনেক মসজিদে গরিব খেটে খাওয়া রোজাদারদের মধ্যে ইফতার বিতরণ করা হতো। এবার হয়তো তা আর সম্ভব হবে না। বঞ্চিত হবে সমাজের অস্বচ্ছল মানুষগুলো।
রোজার মাসে বাংলাদেশসহ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ওমরাহ পালনের উদ্দ্যেশে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় গমন করেন। মানুষ ক্বাবা ঘর তাওয়াফ করছে না, এ দৃশ্য বিশ্বমুসলিমদের জন্য হৃদয়বিদারক। নবীজির রওজায় মসজিদে নববীতে বিশ্ববাসী একসাথে বসে ইফতার করতে পারবে না, তা বিশ্ব কি কোনদিন স্বপ্নেও ভেবেছিল? সেটাও আজ সত্য হতে চলেছে। করোনা গোটা বিশ্বব্যাবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। কবে তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, তা এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারছে না।
তবে যে কারণে এ লেখার অবতারণা তা হলো, এবার কমবেশি প্রায় ৫ লক্ষাধিক কোরআনে হাফেজ বেকার হয়ে যাবেন। কেন বলছি? কারণ, হাফেজ সাহেবদের অধিকাংশই সারা বছর এই পবিত্র মাসটির জন্য অপেক্ষা করেন দু’টি কারণে। এক. তাদের কোরআন চর্চাটা জারি রাখার জন্য। অন্যটি বাড়তি কিছু আয়ের জন্য। ২৭ রমজান কোরআন খতম হয়ে যায়। আর সেদিন মুসুল্লিরা খুশি চিত্তে হাফেজ সাহেবদেরকে হাদিয়া প্রদান করে থাকেন। এবার সেরকম হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সমজিদে খতম তারাবীহ জামাতের সাথে আদায় করা তো দূরের কথা, মুসুল্লিরা জামাতের সাথে মসজিদে নামাজ-ই পড়তে পারবেন না। আর পড়াও উচিত হবে না।
এখন এই আনুমানিক ৫ লক্ষ হাফেজ সাহেবদের আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যাবে, তা সরকার ও স্ব-স্ব মসজিদ কমিটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে এতো বিপুল সংখ্যক হাফেজ সাহেবদের উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের রোজা ও ঈদ নিশ্চিতভাবে কষ্টদায়ক হয়ে যাবে।
এক্ষেত্রে দেশের সকল সমজিদ কমিটি পূর্ব থেকেই নিয়োগকৃত হাফেজ সাহেবদেরকে সংশ্লিষ্ট মসজিদের পক্ষ থেকে নিয়োগ করতে পারেন। যেহেতু ৫/১০ জন মুসুল্লি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবেন, সেহেতু একদিকে যেমন সারাদেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদে কোরআন তেলাওয়াত হলো, কোরআন খতম হলো, আর কোরআনের চর্চাটাও বজায় থাকলো, অন্যদিকে হাফেজ সাহেবদের আর্থিক বিষয়টারও একটা সুরাহা হলো।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের জেলা অফিসের মাধ্যমে প্রকৃত হাফেজগণের তালিকা তৈরি করে হাফেজদের জন্য মসজিদভিত্তিক থোক বরাদ্দ প্রদান করে এই ক্রাইসিস সুচারুভাবে সমাধান করতে পারে। সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিরাও কোরআন নাযেলের মাসে কোরআন চর্চা চালু রাখার স্বার্থে এগিয়ে আসতে পারেন। সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত মসজিদে খতম তারাবীহর জন্য পূর্বের মতো হাফেজ নিয়োগ করে সাময়িকভাবে এই ক্রাইসিসও মোকাবেলা করা যেতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন