পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তাকওয়া, শুদ্ধচারিতা এবং সংযম সাধনার আহবান নিয়ে প্রতি বছরের সাফল্য ও সৌভাগ্যের বার্তাবহ রমজান মাসে আল্লাহর মহাপরীক্ষা ‘করোনাভাইরাস’ মুসলমানের সৌভাগ্যকে ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না, বরং খাঁটি মুসলমান হিসেবে ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। করোনা প্রতিরোধকল্পে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাবলির অংশ হিসেবে রমজান মাসে মসজিদে গমন, জামাতে নামাজ ও খতমে তারাবীহ হতে বিরত থেকে ঘরে বসেই প্রত্যেক রোজাদার-পরিবার সহজেই রমজানের সব করণীয় পালন করতে পারবেন।
নামাজের পর রমজান মাসব্যাপী দিবসে রোজা পালন করা ইসলামের অন্যতম ফরজ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। রমজান রহমত, বরকত, মাগফিরাত এবং কোরআন অবতরণের মাস হওয়ায় এর মাহাত্ম্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। সূরা বাকারায় এই মাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যে রূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার।’ (আয়াত: ১৮৩) আরো বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি এই মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোজা পালন করে।’ (আয়াত: ১৮৫)
আরবের জাহেলী যুগের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে, দেখা যায় যে, ইসলামের পূর্বে আরবে কোরেশরা আশুরা দিবসে রোজা পালন করত। এইদিন খানা-ই-কাবায় গিলাফ পরিধান করানো হতো। মক্কী জীবনে রসূলুল্লাহ (সা.)ও এই দিন রোজা পালন করতেন। সম্ভবত তাঁর অনুসরণে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামও রোজা পালন করতেন। রোজা প্রথা চালু থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা হতে। হজরত জাফর (রা.) কর্তৃক আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর সামনে প্রদত্ত ভাষণ থেকে। নবুওয়াতের ৫ম বর্ষে প্রদত্ত এই ভাষণে অন্যান্য (নির্দেশের) সাথে রোজার কথাও উল্লেখ ছিল। এটি হিজরতের আট বছর আগের ঘটনা। সম্ভবত এটি আশুরার রোজা ছিল।
হিজরতের পর মদীনায় রসূলুল্লাহ (সা.) দেখলেন, ইহুদীরা ঐ দিবসে রোজা পালন করে। জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় যে, এই দিবসে হজরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কবল হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘মূসা (আ.) এর অনুসরণ করার অধিকার আমাদের বেশি।’ তাই তিনি আশুরার রোজা রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও নির্দেশ দেন। অতঃপর রোজা ফরজ হলে আশুরা দিবসের রোজা রাখা মোস্তাহাব হয়ে যায়। অর্থাৎ- যার ইচ্ছা রাখবে, আর যার ইচ্ছা রাখবে না।
আরববাসীরা রোজা রাখতে অভ্যস্ত ছিল না, গরমে রোজা রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। তাই ক্রমেই রোজা পালনের বিধান পরিপূর্ণতা লাভ করে। প্রথমে রসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদীনায় গমন করেন তখন তিনটি রোজা রাখার নির্দেশ হয়। অতঃপর রোজা ফরজ হলে ঐ নির্দেশ ঐচ্ছিক হয়ে যায়, যার ইচ্ছা রোজা রাখবে, যার ইচ্ছা একটি রোজার পরিবর্তে একজন গরিবকে খাওয়াবে। ক্রমে লোক যখন রোজা রাখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন কোরআনের আয়াত নাজেল হয় যে, রমজান মাস যে প্রত্যক্ষ করবে, তাকে মাসব্যাপী রোজা রাখতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রমজান মাসের রোজা কবে কোন তারিখে ফরজ হয়? বিভিন্ন বর্ণনা হতে জানা যায় যে, হিজরী ২/৬২৪ সালের ১ রমজান (১৭ ফেব্রুয়ারি) তারিখে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। রমজান মাসের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এক শ্রেণির লোক রোজা না রাখলেও রোজাদারগণ অধিকাংশই প্রয়োজনীয় কাজ কারবার সেরে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির আজকার, অজিফা পাঠ ইত্যাদি ছাড়াও সাধ্যানুযায়ী দান-খয়রাত করে থাকে। সাধারণভাবেই মুসলমান নারী-পুরুষ সবাই রমজান শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।
রমজান মাসব্যাপী তারাবীহর নামাজ আদায় করার বিধান এই মাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুসলিম পরিবারে এই সুন্নত পালনের ইতিবাচক প্রবণতা সর্বত্রই লক্ষ করা যায়। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকলেই বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে তারাবীহর নামাজ আদায় করে থাকে এবং খতমে তারাবীহর জন্য ছোট বড় প্রায় সকল মসজিদেই হাফেজে কোরআন নিয়োগ করা হয়। অনেকেই অত্যন্ত আনন্দের সাথে তারাবীহর জামাতে অংশগ্রহণ করে থাকে, এমনকি সকলের মধ্যে তারাবীহ পড়ার ধূম পড়ে যায়। কিন্তু এইবার বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা মহামারী উল্লেখিত সকল ঐতিহ্য অনুসরণ স্থগিত করে দিয়েছে। প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরে বসে এগুলো পালন করতে হবে, যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সেহরী খাওয়াও ধর্মীয় বিধান। ছোট-বড়, নারী-শিশু সবাই অতি ভক্তি ও আগ্রহ সহকারে সেহরী খেয়ে থাকে। শহরে সেহরী খাওয়ার জন্য পাড়ায়-মহল্লায় জাগানো পার্টি কাজ করে। দেশের জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে বিশেষ করে রেডিওতে সেহরীর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে। সেহরীর এসব নানা উদ্যোগ, আয়োজন ইসলামী ঐতিহ্য-সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। সেহরী অপেক্ষা ইফতার যেন একটি উৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু এবার করোনা মহামারীর আশঙ্কায় ইফতারির অনুষ্ঠান ও সমাবেশ নিয়ন্ত্রিত থাকবে। অপরকে ইফতার করানো একটি ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সামাজিক রেওয়াজ।
পবিত্র রমজান মাসের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মাসের শেষ দশ দিন ‘এতেকাফ’ করা। ‘এতেকাফ’-এর শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা, অপেক্ষা করা। কিছু সময়ের জন্য কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকার নামও এতেকাফ। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এতেকাফ অর্থ হচ্ছে, রমজান মাসের শেষ দশ দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মসজিদে নির্জনভাবে এবাদতে মশগুল থাকা। এটি সুন্নতে কেফায়া। মহল্লার মসজিদে কোনো একজন মুসল্লী তা পালন করলে সকলের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে। রসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে প্রতি বছর নিয়মিত এতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের বছর তিনি সর্ব মোট ২০ দিন এতেকাফ করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, সুন্নতে মোয়াক্কাদা কেফায়া হলেও রসূলুল্লাহ (সা.) এতেকাফের প্রতি এরূপ গুরুত্ব প্রদান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য কিছুক্ষণের জন্য যে একাগ্রতা ও নির্জনতা প্রয়োজন তা এতেকাফের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। এই ধ্যান ও একাগ্রতার প্রথম শিক্ষা লাভ করেন রসূলুল্লাহ (সা.) হেরা গুহায়, যেখানে তাঁর প্রতি প্রথম অহী নাজেল হয়। তাছাড়া কোরআনে যে লায়লাতুল কদরের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা রমজান মাসের শেষ দশ দিনের কোনো বেজোড় রাতে (সর্বসম্মত মতে, ২৭ রমজান) অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা হাদীসে বলা হয়েছে। সুতরাং, এতেকাফের মাধ্যমে শব-ই-কদর লাভের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কিন্তু এবারের এতেকাফের সময় পর্যন্ত করোনা পরিস্থির উন্নতি না হলে সম্ভবত এতেকাফকারীদের সংখ্যা সীমিত রাখতে হতে পারে।
পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখা যেমন ইসলামের রোকন, যাকাত প্রদান করাও পঞ্চ রোকনের একটি। এই যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তারা যাকাত প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিল। যাকাত অর্থ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা এবং বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি ও পরিশুদ্ধ হয়। মুসলমানগণ সাধারণত রমজানুল মোবারক মাস হতে যাকাত প্রদানের হিসাব ধরেন এবং যাকাতের শরীয়ত নির্ধারিত হকদারগণের মধ্যে যাকাতের অর্থ প্রদান করেন। গরিব, দরিদ্র ও অসহায়দের ভাগ্যোন্নয়নে যাকাতের সামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। পবিত্র রমজান মাসে যাকাত প্রদানের প্রথা মানব কল্যাণের এক উত্তম ও সুন্দরতম ব্যবস্থা, যা ইসলামের সৌন্দর্যেরও পরিচায়ক বটে।
হকদারগণের কাছে যাকাত পৌঁছে দেয়ার জন্য পবিত্র রমজান মাসে বিশেষ সুযোগ এসে থাকে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের দ্বারা যাকাত প্রদানকারীগণ একদিকে যেমন তাদের ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনে উৎসাহিত হবেন, তেমনি মানবতার সেবায়ও উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, এবার করোনা মহামারীজনিত কারণে দান-সদকা ও যাকাত প্রদানে পূর্বের ন্যায় যেখানে সেখানে বিতরণকারী ও প্রাপকদের ভিড় জটলা তথা সমাবেশ ঘটানো হতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিরত থাকতে হবে। পরিশেষে, ঘাতক করোনা মহামারী হতে আল্লাহতায়ালা সকলকে নিরাপদ ও মুক্ত রাখুন এবং অতিসত্তর এ ভয়ংকর দুর্যোগ দুনিয়া হতে বিদূরীভূত করুন, এ প্রার্থনা সকলেরই হওয়া উচিত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।