পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা এক আতঙ্কের নাম। এক অদৃশ্য শত্রু এ অদৃশ্য শত্রু র বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব আজ যুদ্ধরত। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। থমকে গেছে বিশ্ব, বন্ধ হয়ে গেছে সব আনন্দ, ক্ষমতার দাপট, শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের হুঙ্কার। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, আধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ রাষ্ট্র, মহাকাশজয়ী বিজ্ঞানীসহ চিকিৎসা বিজ্ঞানও আজ করোনার কাছে পরাস্ত। পৃথিবীর প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, বৃটেন, ফ্রান্স, ইরানসহ বিশ্বের ২১০টির বেশি দেশ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত। ফলে, জীবন না জীবিকা- এ নিয়ে শুরু হয়েছে তর্ক। বিভিন্ন বিজ্ঞানী, গবেষক ও অর্থনীতিবিদসহ অনেকের মত হলো, এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন মানুষের জীবন বাঁচানো।
করোনার প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবী। পরিবর্তন হচ্ছে আন্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। এই ভাইরাসের প্রভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবন বদলে গেছে। পরিবর্তন আসছে রাজনীতিতে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোস গে ব্রেয়াসুস এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আরোপিত বিভিন্ন বাধা নিষেধ তড়িঘড়ি তুলে নিলে তার ফলাফল হবে আরও ভয়াবহ। অর্থনীতিতে পড়তে পারে আরও মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
জন্ম নিচ্ছে নতুন বিশ্বব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের পরের পৃথিবী হবে আগের চেয়ে ভিন্ন। পরিবর্তন আসতে পারে ক্ষমতাধর মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সামরিক নীতিতেও। পরিবর্তন হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক কৌশল। বিগত কয়েক মাস থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক যুদ্ধ জোর কদমে এগুচ্ছিল। অর্থনীতির পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে প্রভাব বজায় রাখার ও নিজেদের মূল্যবোধ নিয়েও দেশ দু’টির মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছিল। করোনাভাইরাস এ উত্তেজনাকে হয়তো আরও বৃদ্ধি করে দিতে পারে। বিশ্বরে ছোট বড় সকল রাষ্ট্র এখন নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। নিউইয়র্কের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গেই পড়েছে। তারা চীন থেকে পিপিইসহ ভাইরাস পরীক্ষার কিট ও ভেন্টিলেটর নিচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষার জন্য ইউরোপের দেশেগুলোও পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য একটি প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি প্রস্তাব রেখেছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বৈশ্বিকভাবে একটি কাঠামো- ‘গ্লােবাল গভর্ন্যান্স’ গড়ে তোলার জন্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ও জি-২০’র সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ট্যাস্কফোর্স গড়ে তোলার যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে জবাবদিহি কতটুকু থাকবে তা স্পষ্ট নয় এবং এটা হলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কার্যক্রম কী হবে তা বলা মুশকিল। তবে করোনাভাইরাসের এই ভয়াল থাবা থেকে উদ্ধারের জন্যে বিশ্ব মোড়লদের কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে এবং একশক্তিকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার নীতির পরিবর্তন আনতে হবে। ভাইরাসের আঘাতে কোন দেশ কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেমন জনবল হারাবে, কোন বয়সের জনশক্তি কী পরিমাণ হারাবে, স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কেমন হবে তার পরিসংখ্যানের উপর আগামী বিশ্ব ব্যবস্থার রূপ নির্ভর করবে।
করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক ক্ষতি বা প্রতিক্রিয়া অতীতের যে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে বেশি হবে, এ বিষয়ে কারো কোনো সংশয় নেই। অর্থনৈতিক মহামন্দার পূর্ণ আলামত সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে। আমেরিকা-ইউরোপে স্টক মার্কেটে বিশাল ধস নেমেছে। আমেরিকার স্টকমার্কেটের সূচক প্রায় ৩২ শতাংশ কমে গেছ। চীনে গাড়ি বিক্রি প্রায় ৯২% কমে গেছে। এভাবে অর্থনীতির প্রত্যেকটি খাতে মহামন্দা ধেয়ে আসছে। অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলার জন্য ইতোমধ্যে বহুদেশ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। প্রধানমন্ত্রীর এ পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, তা হলো প্রণোদনা নিয়ে যেন কেউ দুর্নীতি ও অনিয়ম না করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রণোদনা প্যাকেজ কি সংকটে পতিত জনগোষ্ঠির জন্য সঠিকভাবে কাজে লাগবে নাকি এলিট শ্রেণির কতিপয় সদস্য লাভবান হবে, তা দেখার বিষয় রয়েছে। সমাজের বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য যদি কিছু করা না হয়, যদি অর্থনীতি সেই পুরোনো পথেই চলে তাহলে সংকট কাটানোর চেষ্টা হবে আন্তঃসার শূন্য এবং তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হবে ব্যাপক। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে শোষণহীন ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হলেই বৈশি^ক অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপধ্যায় এক আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষের জীবন বাঁচানো, অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে তাদের কাজে ফেরানো। তার পরবর্তী সময়ের সমস্যা স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায় তা দেখতে হবে।’
করোনার প্রভাবে জীবন ও জীবিকাকে এক সাথে বাঁচানোর কাজটি সহজ হবে না। আইএমএফ বলেই দিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে ঢুকে গেছে। জীবন বাঁচাতে ঘরে বসে থাকার সময় যত দীর্ঘ হবে অর্থনৈতিক সংকট তত বাড়তে থাকবে। এ সংকটকালীন সময়ে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ। চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন ভাতা, সহায়ক হাসপাতাল ও জরুরি কক্ষ তৈরি, নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করা। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে আছে দরিদ্র জনগোষ্ঠি। সে জন্য এই জনগোষ্ঠি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপী ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত খেলাপী ঋণ এর দ্বিগুণের বেশি। বিশ্ব অর্থনীতির এই সংকটে উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আইএমএফ-এর মতে, আন্তর্জাাতিক সংস্থা বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। সংকট মোচনে এখান থেকে অর্থ পাওয়া যাবে। এ সময়ে অর্থের যোগান বাড়ানো উচিত।
পৃথিবীর মানুষ ঘরবন্দি। দেশে দেশে লকডাউন মানুষের চলাচল বন্ধ, বন্ধ আছে কলকারখানা, যানচলাচল বন্ধ, বন্ধ আছে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বড় বড় শপিংমল। পৃথিবীর বান্ধুমন্ডল এখন সতেজ। বাতাসে পরিবেশবান্ধব উপাদানই এখন বেশি। ওজোন স্তর এখন অনেক সতেজ। প্রাণীকূল ও সমুদ্রের প্রাণীরা আজ খুব আনন্দে মেতে উঠেছে। সাগরে হাঙ্গর, কুমির আর ডলফিনের নাচ দেখা যায়। প্রকৃতি এখন তার আসল রূপে সেজেছে। এ প্রথিবীটা শুধু মানুষের জন্য নয়। মানুষ তার জীবন রক্ষায় ব্যস্ত। বিশ্ব আজ স্বাস্থ্যসেবায় যে ব্যয় করেছে পরিবেশ রক্ষায় অতীতে তার সিকিভাগও ব্যয় করেনি। করোনাভাইরাসে একদিকে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে অন্যদিকে প্রকৃতি নতুন সাজে তৈরি হচ্ছে।
করোনাভাইরাস পৃথিবীকে কীভাবে বদলে দেবে, কীরূপে সাজাবে পৃথিবীকে, সে বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। বৈশ্বিক পরিবেশ বদলে যাওয়ার এক ক্রান্তিকাল আজ আমারা অতিক্রম করছি। এই পরিবর্তন কতটা ভারসাম্যপূর্ণ ও নিরাপদ হবে নাকি সবার অধিকারকে সংকুচিত করবে, আরও বিপদ ডেকে আনবে, তার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।