পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
চীনের ওহান শহরে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতী আগ্রাসন শুরু হলে পুরো চীনদেশ কার্যত লকডাউন করে দিয়ে দুই মাসের সর্বাত্মক লড়াই শেষে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয় চীন। এরপর দক্ষিণ এশিয়ার-পূর্ব এশিয়ার গন্ডি পেরিয়ে একে একে পশ্চিমা দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ভাইরাসের মহামারী। সে সময়েই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং পশ্চিমা ভাইরোলজিস্টরা দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ ও ভারতকে করোনা মহামারীর সবচেয়ে অনুকূল স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে বিবৃতি দেয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আন্তর্জাতিকভাবে লাইমলাইটে আসার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিক চীনে যাতায়াত করেছে। একইভাবে দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে কর্মরত হাজার হাজার চীনা কর্মী বাংলাদেশে যাতায়াত করেছে। এরপর ভাইরাস সিঙ্গাপুর, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ বাংলাদেশি কর্মী দেশে এসেছে। দেশের বিমানবন্দর, নৌবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার মতো কিট বা যন্ত্রপাতি না থাকায় শুরুতে অনেক যাত্রীর করোনা পরীক্ষা করা যায়নি। এমনকি তাদের বেশিরভাগই কোয়ারেন্টাইনের বাধ্যবাধকতার বাইরে থেকে যায়। ইতালি, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত চিকিৎসা ও নাগরিক সুযোগসুবিধার দেশগুলোতে যখন হাজার হাজার মানুষকে অসহায়ভাবে মুত্যুর কাছে সপে দিতে হচ্ছে, তখন তেমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় মার্চের ৮ তারিখে। ইতোমধ্যে একমাস পেরিয়ে গেলেও অধিক জনঘনত্বের দেশ হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশে করোনা মহামারী ইউরোপ-আমেরিকা বা ইরানের মতো রূপ নেয়নি। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ইতোমধ্যে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ এমন অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের বিদেশ ভ্রমণ বা বিদেশ ভ্রমণকারী বা কোনো চিহ্নিত করোনা রোগীর সংস্পর্শে যাওয়ার রেকর্ড নাই। এর মানে হচ্ছে, দেশে এমন অনির্দিষ্ট অসংখ্য মানুষ করোনাভাইরাস বহন করছে। এটি খুবই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ভগ্নদশা, এক আইইডিসিআরের খুবই সামান্য সক্ষমতার বাইরে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে বিদেশ ফেরত সন্দেহভাজনদের ভাইরাস শনাক্ত করতে না পারা এবং কোয়ারেন্টাইনে রাখার প্রয়োজনীয় বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার অভাবে ভাইরাস বহনকারী অচিহ্নিত ব্যক্তিরা এখন সামাজিক সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। আর এই শৈথিল্যের কারণেই এখন রাজধানীসহ পুরোদেশ অঘোষিতভাবে লকডাউনে রাখতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এখন প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন রোগীর সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। একদিকে বাড়ছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর আতঙ্ক, সেই সাথে বাড়ছে লকডাউনের কারণে কর্মহীন মানুষের দুর্ভোগ-উৎকণ্ঠা। সরকারের ঘোষিত হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ও খাদ্য সহায়তা নিয়ে চুরি-চামারিতে লিপ্ত গরিবের রক্তচোষা ঘৃণ্য মানুষদের তালিকাও ক্রমে দীর্ঘ হয়ে চলেছে। সরকারের দলীয় নেতা-কর্মীদের চুরিদারি ছাড়াও দরিদ্র-কর্মহীন ও বেকার মানুষদের জন্য অপর্যাপ্ত সহায়তা, সহায়তা প্রদানে অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, দলবাজি ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজির জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেই ধাপে ধাপে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বসেছে। এ কারণে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের আগে মানুষরূপী দানবীয় চোর, দুর্নীতিবাজ ভাইরাসগুলোকে সমাজ ও রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করার প্রয়োজনীয়তা আবারো সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার। দেশের ভেতরে বাইরে থেকে প্রতিদিনই খারাপ সংবাদ পাচ্ছি। ইতালির পর পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানী নিউইয়র্কে সর্বস্তরের মানুষের অসহায়ত্ব ও প্রিয়জনদের করুণ মৃত্যু বিশ্বকে হতবাক করে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। আমার বড়ভাই আরশাদুল বারীকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত। বোন ভাগিনা-ভাগ্নীসহ তাদের সন্তান-পরিজনদের নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতির আশঙ্কায় বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনরাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। অতীতে বিশ্বের দেশে দেশে ও আঞ্চলিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এমনকি মহাযুদ্ধও দেখেছে। ব্যাপক গণবিধ্বংসী মারণা (ডাব্লিউএমডি) এবং পারমাণবিক যুদ্ধের সময় নিরাপত্তামূলক প্রস্তুতিও পরাশক্তি ও উন্নত দেশগুলোর আছে। তবে নতুন ভাইরাসের কাছে তাদের অসহায়ত্ব বিশ্বের মানুষের মধ্যে নতুন চিন্তা ও বোধের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বে লালঘোড়া দাবড়ানো তেজি অর্থনীতির দেশ চীনের পায়ে লাগাম পরানোর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্রগুলো অসংখ্য মৃত্যু আর অনির্দিষ্ট লকডাউনের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গত দেড় মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২২ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কর্মহীন হয়েছে প্রায় দুই কোটি মানুষ। এটি বিশ্বের একনম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তির আভ্যন্তরীণ চিত্র। অর্থ-বিত্ত-বৈভব ও ডিজিটাল প্রযুক্তি দিয়ে অদৃশ্য ভাইরাসের করাল মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না। ইতালিতে যখন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন, তখন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কর্মহীন, সহায়-সম্বলহীন মানুষ জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যের জন্য সব ভয় তুচ্ছ করে রাস্তায় নেমে আসছে। আরেক শ্রেণির মানুষ গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ চাল গুদামে লুকিয়ে এবং পাচার করে পকেট ভারী করার চৌর্যবৃত্তির গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে এখনো মানবিক মানুষের কাতারে দাঁড়াতে পারছে না! করোনাভাইরাসের করাল গ্রাস কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। অর্থবিত্ত-বৈভব, রাজনৈতিক ক্ষমতা, আভিজাত্য যেন এই উপশমহীন মৃত্যুর কাছে তুচ্ছ। এহেন বাস্তবতায় বিশ্বের সবকিছু বদলে যেতে চলেছে। পুরনো বিশ্বব্যাবস্থা, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং গণমানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি অবশ্যম্ভাবি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমন এক মহাক্রান্তিকালেও কি বাংলাদেশের পুরনো চোর-বাটপারদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না?
করোনাভাইরাসে গত দুইমাসে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর বেশিরভাগ ঘটেছে ইউরোপ-আমেরিকায়। এই মুহূর্তে আমেরিকাই হচ্ছে এর এপিসেন্টার। বিশ্বের সবচে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অসার-ভঙ্গুর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে পুরো বিশ্ব। যারা এতকাল ধরে স্টারওয়ার ও সুপারসনিক লজিস্টিক ব্যবস্থা নিয়ে হলিউডি মুভি দেখিয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তারা নিজেদের ডাক্তার ও নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ওষুধ-পথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবকিছুই কর্পোরেট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় রাষ্ট্রের সরকারগুলো যথাসময়ে ত্বরিৎ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর চীনের শাসকদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ত্বরিৎ সিদ্ধান্তে পুরো চীনকে লকডাউন করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়ার দৃষ্টান্ত থেকে তারা শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু চীনের লকডাউন থেকে নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ এবং চীনের বাণিজ্যিক আধিপত্য পরাস্ত করার সুযোগ বলে মনে করেছিল। মাত্র দুইমাসের মধ্যে চীন পেন্ডেমিক নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলেও দুইমাস পেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রমবর্ধমান হারে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে মার্কিন প্রশাসনের হযবরল অবস্থাই শুধু ধরা পড়ছে না, তাদের দুর্বৃত্তপণা ও অমানবিক মানসিকতাও প্রকাশ পাচ্ছে। এই মহামারীতে জাতিসংঘসহ বিশ্বসংস্থাগুলো যুদ্ধবন্ধ এবং অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখার আহবান জানালেও ইরান, ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরিসর বিস্তৃত করেছে। সেখানে করোনাভাইরাসে অধিক সংখ্যক মানুষের মত্যু নিশ্চিত করাই যেন মার্কিনীদের লক্ষ্য। অন্যদিকে ভাইরাস মহামারী সামলাতে মাস্ক, পিপিই, ওষুধ এবং ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার যোগান নিশ্চিত করতে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানবিক দায় ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন দেশের জন্য জরুরি ভিত্তিতে মাস্কসহ ভাইরাস মোকাবেলার সরঞ্জাম সরবরাহের সময় সমুদ্রে বেশ কয়েকটি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য জার্মানি, ব্রাজিলসহ অন্তত ৫টি দেশ মার্কিনিদের দিকে আঙুল তুলেছে।
নিজ দেশের নাগরিকদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সম্ভাব্য বিপদাপদ থেকে রক্ষায় তেমন কোনো প্রস্তুতি, সক্ষমতা না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের নাগরিকদের চেয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী রক্ষাকে যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষার দাবিতে নিউইয়র্কে যখন স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে তখন ইসরাইলি বাহিনীর জন্য স্পেশাল বিমানে ১০ লাখ মাস্ক পাঠানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। মার্কিন ও ইসরাইলি গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সংবাদের তথ্য পরিবর্তনের খবরও পাওয়া যায়। তবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া রিপোর্টের কারণে মার্কিন প্রশাসন নিজ দেশের জরুরি প্রয়োজনকে পাশ কাটিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর জন্য এক মিলিয়ন মাস্ক পাঠানোর তথ্যটিকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে করোনাভাইরাসে সারাবিশ্বে একটি মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে মানুষ আর কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। এটি সম্পূর্ণ আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত-অভাবনীয় বিপর্যয়। এই দুযোর্গ সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার উপর। লকডাউন, শাটডাউনের কবলে দুইমাস ধরে শিল্পকারখানা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছে তার পুরোভাগে রয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। ২০০০ সালে একবার এবং ২০০৮-৯ সালে একবার গত দুই দশকে অন্তত দুইবার অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে পশ্চিমা অর্থনীতি। গত দশকের অর্থনৈতিক মন্দায় মার্কিন প্রশাসন ট্রিলিয়ন ডলারের বেইল-আউট প্রোগ্রাম গ্রহণ করেও সেই মন্দার গহবর থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার উপর এবারের মন্দা তিরিশের দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের চেয়েও অনেক বেশি গভীর হতে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই মার্কিন ট্রেজারির ঋণের পরিমাণ ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের উপর, যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। বিশ্বের সব দেশের সম্মিলিত ঋণের চেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বেশি, জিডিপির হিসেবে ৭৬ ভাগের উপরে। চলতি করোনাভাইরাস লকডাউনে মার্কিন অর্থনীতিতে আরো ১০ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির শতভাগের বেশি। এমন অবস্থায় পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতৃত্ব হারাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার বাস্তবতায় আগামীর বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে আশঙ্কা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত ও বদলে যাওয়া এক বিশ্ববাস্তবতা। জনগণের উপর প্রতিবছর কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা চাপিয়ে যে ফাঁপা, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে আছে শুধু সামরিক আগ্রাসন, দেশসমূহের উপর অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। পুঁজিবাদের সেই সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা একসময় হোম সিকিউরিটির নামে মার্কিন জনগণকেও শেকলে বেঁধে ফেলেছে। মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থরক্ষাকারী সাম্রাজ্যবাদ জনগণের বিপদে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের এই সময় পেরিয়ে যে সময় বিশ্বের জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে নতুন চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করবে বিশ্ব।
চীন ছাড়া বাকি দুনিয়ায় করোনাভাইরাস মহামারী এখন তুঙ্গে অবস্থান করছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার মানুষ নতুন করে ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ এক চরম ভীতিকর ও বিভীষিকাময় অবস্থা। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিষেধক, ওষুধ ও ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়াসও চলছে নিরন্তর। চীন থেকে করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার পর তারা ত্বরিৎ গতিতে পুুরো হুবেই প্রদেশসহ চীনের প্রায় সব শিল্প ও বাণিজ্য নগরীতে লকডাউন করে পুরো অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। চীনের এই লকডাউন পদ্ধতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে নাকচ করে না দিলে এখন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর বড় মাশুল গুণতে হতো না। চীনের উপর ব্লেইম গেম থেকে শুরু করে একে একে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রতিটি ধাপেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভুল উদ্যোগগুলো বার বার মার্কিন জনগণ ও বিশ্বসম্প্রদায়কে বিচলিত করেছে। বিশ্বের করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত বুধবার পর্যন্ত ২০ লাখ অতিক্রম করেছে। শুধুমাত্র নিউইয়র্ক শহরে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশ্বে মৃতের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স অব্যাহত মৃত্যুর মিছিল কমিয়ে আনতে যখন আবারো লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জীবনের মূল্য অগ্রাহ্য করে অর্থনীতি সচল করার উদ্যোগের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পুরো বিশ্বের ভীতি ও হতাশার মধ্যেও গত মঙ্গলবার চীন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনের সর্বশেষ ধাপে উত্তরণের ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে বাকি দুনিয়ার গবেষকরা এক-দেড় বছরের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরির কথা বলছিল, সেখানে চীনের রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই ব্যাপকহারে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির কথা বলছে। এভাবেই লাখো মানুষের প্রাণঘাতী একটি মহামারীর বিশ্ববাস্তবতায় আগামীর বিশ্বব্যবস্থায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং পরিবর্তিত নতুন বাস্তবতায় উপনীত হতে চলেছে। করোনাভাইরাসের মহামারী কোথায় গিয়ে থামবে, এই মুহূর্তে তা কেউ বলতে পারছে না। তবে এই ভাইরাস ইতোমধ্যে বিশ্বসভ্যতাকে যত মৃত্যু, যত আতঙ্ক ও মানবিক সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে, মানুষের জাগতিক প্রয়োজনকে সঙ্কুচিত করে যেভাবে গৃহবন্দি করে চরম বিভীষিকার মুখে দাঁড় করিয়েছে তাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর কখনোই আগের অবস্থানে ফিরে যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।