পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু পার্বত্য এলাকা ছাড়া অবশিষ্ট বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তর নদীগঠিত বদ্বীপ। নদীমাতৃক আমাদের দেশজুড়ে আছে শত শত নদ-নদী। আর নদীর বুকে জেগে আছে চর। যেখানে বসবাস করে হাজার হাজার মানুষ। এসব চরে বসবাসরত মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়। মানুষ, সমাজ, সংষ্কৃতি ও পরিববেশ সবই অন্য রকম। এখানে বসবাসরত মানুষ অধিকাংশ দিন আনে দিন খায়। চরবাসীরা অনেকাংশে বেশি দুর্ভোগের মধ্যে দিন যাপন করে। একদিকে মৌসুমি বন্যা, নদী ভাঙ্গন, কালবৈশাখী ঝড় ও শৈত্যপ্রবাহ তাদের জীবন ও জীবিকার উপর চরম প্রভাব ফেলে। আবার নদীর বুকে ভেসে উঠা বালু জমির উপর ফসল ফলানো তাদের বেঁচে থাকার প্রধানতম উপায়। কিন্তু, সেখানে কৃষিকাল থাকে খুব সংক্ষিপ্ত সময় ধরে। বন্যার সময় কৃষিকাজ করা সম্ভব হয় না। তখন তারা মূল ভূমিতে, দূরবর্তী বা নিকটবর্তী শহরে আসে কাজের সন্ধানে। সাধারণত, শহরে তারা অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে শ্রম বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন, তারা রিকশা বা ভ্যান চালায়, মাথায় করে সবজি বিক্রয় করে, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে বা গার্মেন্টে খন্ডকালীন সময়ের জন্য কাজ করে। উপার্জনের এই সকল অস্থায়ী ও অটেকসই কৌশলগুলো শুধুমাত্র খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে, আকস্মিক মহামারীকে মোকাবেলা করার জন্য তা কোনোমতেই যথেষ্ট নয়।
খুব বেশি বছর গত হয়নি তারা মঙ্গার মতো দুর্যোগ কাটিয়ে উঠেছে। মঙ্গা বলতে বোঝায়, উপার্জনের অভাবে বা খাদ্যসামগ্রী ক্রয় না করতে পারার কারণে অনাহারে দিন যাপন করা। উত্তরবঙ্গের রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের মানুষজন, বিশেষ করে যারা তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্র বা যমুনা নদীর চরে বসবাস করে, তারা অনেকেই ভূমিহীন ও দরিদ্র। তারা জানে মঙ্গার ভয়াবহতা কীরূপ। নিয়মিত আয় যদি তাদের না থাকে তাহলে তারা নি:স্ব হয়ে পড়ে। কেউ ঋণ করে, জমি বিক্রয় করে, এমনকি কেউ ভিক্ষা করে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। আর, যে সকল গৃহস্থালীতে নারীই প্রধান বা একমাত্র সদস্য তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। আমি আমার পিএইচডি গবেষণার মাঠকর্মকালীন সময়ে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর কিছু চরে স্বচক্ষে দেখেছি যে দরিদ্র চরবাসীরা কি ভয়ানক দারিদ্র্যতার মধ্যে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে। কিছু চরবাসীকে দেখেছি, তারা অন্য চরে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ভিক্ষা করে।
নিয়মিত দুর্যোগে তারা অভ্যস্ত। তবে, করোনাভাইরাসজনিত সম্ভাব্য মহামারী সম্পূর্ণভাবে আকস্মিক। এরূপ মহামারীতে হয়তো তারা তাদের স্বল্প আয় দিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করবে। হয়তো বা এতে করে মঙ্গা-পরিস্থিতি আবারও দেখা দিতে পারে তাদের মাঝে। তাছাড়া, করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলো সীমিত বা বন্ধ করা হয়েছে। এতে করে, যে সকল চরবাসীরা মূলভূমিতে বা শহরে এসে দিনমজুরের কাজ করে আয় করতো, তাদের উপার্জন করার রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা মূল ভূমির সাথে ও রাষ্ট্রের অধীন স্থানীয় জনপ্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারছে না। কারণ, তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। সেই নৌকার চলাচল যদি সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে তারা মূল ভূমিতে আসতেও পারবে না, শ্রম বিক্রয় করতে পারবেনা, করোনা সম্পর্কিত রাষ্ট্রের আদেশ সম্পর্কেও জানতে পারবে না।
বর্তমান করোনাভাইরাস দুর্যোগ সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষ যেন খেতে পারে, সে জন্য রাষ্ট্র প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু, মনে রাখা দরকার যে, এই দুর্যোগ আসার আগে থেকেই তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের মধ্যে দিন যাপন করছে। রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তার প্রজেক্টগুলির (যেমন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও বয়স্ক ভাতা) সুবিধা দরিদ্র চরবাসীর নিকট ন্যায্যভাবে ও কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই পৌঁছায় না। খুব সাধারণ কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। এছাড়া চর-পরিবেশের সাথে একটি কারণ জড়িত, সেটি হচ্ছে, চরগুলি নদীর বুকে অবস্থিত। সেগুলির সাথে পরিবহন মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ করা যায় না। সেখানে বিদ্যুৎ নেই। ফলে, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে যোগাযোগ ও সেখানে সম্ভবপর নয়। যদিও খুব অল্প মানুষ নিজ খরচে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তবে তার প্রভাব ও বিস্তৃতি উল্লেখযোগ্য নয়। একমাত্র কার্যকর উপায় হলো যদি চরবাসীর নিকট স্বশরীরে জরুরী ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া যায় অথবা চরবাসীরাই স্থানীয় প্রশাসন অফিস থেকে ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় উপায়টিতে একটি সমস্যা আছে। দরিদ্র চরবাসীর মধ্যে অনেকেই যাতায়াত ভাড়া নিজ পকেট হতে দিতে পারে না। আমি মাঠকর্মের সময় দেখেছি যে, অনেক চরবাসী চেয়ারম্যানের অফিসে গিয়ে ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কারণ, যে পরিমাণ টাকা নৌকা ভাড়া বাবদ ব্যয় হবে তা দিয়ে আরও বেশি পরিমাণ চাল-ডাল কেনা সম্ভব। তাছাড়া, অভিযোগ রয়েছে যে খুব নি¤œ মানের চাল-ডাল ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে দরিদ্রদের দেওয়া হয়। যা,পাখিরও খাওয়ার যোগ্য নয় বলে এক চরবাসী বলেছিলেন।
বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মঙ্গা ও বন্যার সময় ত্রাণ দিয়ে থাকে। তবে, স্থানীয় মানুষ হতে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা ত্রাণের চেয়ে তাদের খ্যাতির জন্য ফটো সেশনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এছাড়াও, সংগঠনগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিদেরকেই ত্রাণ সামগ্রী পেতে সহায়তা করে। সে গরীব হোক বা না হোক। এটি অনুমান করা কঠিন নয় যে, করোনাভাইরাস দুর্যোগ সময়েও সরকারি ত্রাণ সামগ্রীগুলো বিতরণে স্বজনপ্রীতির ও দুর্নীতির সংস্কৃতি পুনরাবৃত্ত হবে। এই সম্ভাব্য মহামারীকালে দরিদ্র চরবাসীরা যেন প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী ও সেবা ন্যায্যভাবে পায় সে সম্পর্কে সরকারকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধি, সমাজের বিশেষ ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে ও উপস্থিতিতে ত্রাণসমাগ্রী বিতরণ করলে চরবাসীরা তা ন্যায্যভাবে পাবে বলে আশা করছি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।