পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা নামক অদৃশ্য দানবের নারকীয়তায় বিশ্ববাসীর ন্যায় বাংলাদেশের মানুষও ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছে। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ। তাই দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ। সরকারি যেটুকু চালু আছে, সেখানকার ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও করোনা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে অন্য রোগের চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই কোটি কোটি মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। এ ব্যাপারে গত ৪ এপ্রিল ডয়চে ভেলের খবরে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশে ক্যান্সার, কিডনি ও ডায়বেটিসে আক্রান্ত সোয়া চার কোটি মানুষ। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে তাদের অনেকেই নিয়মিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, কিডনি, ক্যান্সার বা ডায়বেটিসে আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এ কারণে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে এ ধরনের রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রতি বছর এই সময়ে অনেকের জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা হয়। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদেরও জ্বর, সর্দি, কাশি হতে পারে। তাই বলে তাকে সেবা না দেওয়া অমানবিক।’ বিষয়টি সরকারও অবগত। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ৪ এপ্রিল বলেছেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। মানুষ এখন বিপদে আছে, এই বিপদে প্রাইভেট চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যদি চিকিৎসা না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে, তবে সরকারও তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে লাইসেন্স বাতিলসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।’ এতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। গত ৬ এপ্রিল বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছেন ঢাবির শিক্ষার্থী সুমন চাকমা। এর আগে চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেও করোনার ভয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়নি কোনও হাসপাতাল। এর আগে এভাবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা দেয়নি! দ্বিতীয়ত যেসব হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তারও অনেকগুলোতে প্রয়োজনীয় সেটআপ নেই বলে খবরে প্রকাশ। তাই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। গত ৬ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর দিতে পারছি না।’ দেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এ হাল-চাল জেনেই জরুরি চিকিৎসায় সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে ওইসিডি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ৪ এপ্রিল বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় বাংলাদেশে চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল স্টাফ ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠাতে চায় ওইসিডি সদস্য রাষ্ট্রগুলো।’ উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সামনে আরো ভয়ংকর দিন আসছে। দেশ জুড়ে করোনার সুনামি বয়ে যেতে পারে। এখন থেকে মানুষকে ঘরে রাখা না গেলে আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। জাতিসংঘও প্রায় অনুরূপ আশংকা প্রকাশ করেছে। এই অবস্থায় দেশে ডেঙ্গুর আগমন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এপ্রিল হতে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মওসুম। যা শুরু হয়ে গেছে। তাই ডেঙ্গুও শুরু হয়েছে। আর হবেই না কেন? ডেঙ্গু হয় এডিস মশার কামড়ে। দেশে মশা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক। মাঠে-ময়দানে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে কোথাও নিস্তার নেই মশার অত্যাচার থেকে। কামড়িয়ে কিংবা মাথার উপর চাক ধরে ভন ভন শব্দে ঘুরে জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলছে দীর্ঘদিন যাবত। এমনকি ঘরের মধ্যেও রক্ষা নেই। কয়েল জ্বালিয়ে, এরোসল দিয়ে কিংবা মশারি টাঙ্গিয়েও মশা থেকে রেহাই মিলছে না। লকডাউনে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তারা টিভি দেখে, রেডিও শুনে, গল্প করে, বই-পত্রিকা পড়ে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু এসব নির্বিঘ্নে করতে পারছে না কেউই মশার অত্যাচারে। এ চিত্র সারা দেশেই। তবে, ঢাকায় বেশি। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নিস্তার পাচ্ছেন না মশার অত্যাচার থেকে। তাই তিনি গত ৩১ মার্চ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘মশার গান আমি শুনতে চাই না। মশা মারতে হবে। কাল রাতে যখন ঘুমাতে গেলাম, তখন দেখলাম মশারা সংগীত চর্চা করছে। মশার গান শুনলাম। মশা গুন গুন করে কানের কাছে গান গাচ্ছিল। অর্থাৎ মশার প্রাদুর্ভাব কিন্তু আস্তে আস্তে শুরু হবে। তারপর আসবে ডেঙ্গু।’ এর আগে তিনি ঢাকার নতুন মেয়রদ্বয়ের শপথ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘মশা যেন ভোট খেয়ে না ফেলে।’ সর্বোপরি মশা বৃদ্ধি ও ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে স¤প্রতি পত্রিকান্তরে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই লাভ হয়নি। তাই মশার ব্যাপক অত্যাচার চলছেই। কারণ, ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মশা নিধনের দায়িত্বরত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কর্মীদের দিয়ে করোনাভাইরাসের জীবাণুনাশক পানি ছিটানোর কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে গত মার্চ থেকে, যা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া, মশার উৎপত্তিস্থলও ধ্বংস করা হয়নি। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই। তাই মশার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ফলে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে সারাদেশে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। তাতে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই বছরের তিন মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্বও বেশি। কারণ, আগাম পদক্ষেপ নেয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মশা নিধন করা হয়নি। করোনাকারণে সব ‘ফোকাস’ সেদিকে চলে গেছে। তাই এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। জাবির কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চলতি বছরের প্রথম এই তিনমাসে এডিস মশার যে ঘনত্ব পেয়েছি সেটা অনেক বেশি। এবারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বেশি। অর্থাৎ ডেঙ্গুর সিজনে রোগীর সংখ্যা বাড়বে যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।’ মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় অসংখ্য মানুষ। তাতে প্রাণহানিও ঘটে অনেক। এছাড়া, মানুষের শান্তি ও ঘুমের ব্যাঘাতের তো অন্ত নেই।
দেশে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে কয়েক বছর যাবত। তবে, গত বছর এটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। এর মধ্যে ২৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশ। ফলে গত বছর ডেঙ্গু নিয়ে আতংক সৃষ্টি হয়েছিল সারাদেশে। সর্বোপরি গত বছর ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য কিছু ডাক্তার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ ব্যবসায়ী বাটপারি করেছিল! এই অবস্থায় মশা নিধনের জন্য শুরু করা হয়েছিল মহাযজ্ঞ। সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। রাজনীতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষও তাতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। পাশাপাশি শুরু হয়েছিল পণ্য প্রচারের মতো মশক নিধন কার্যক্রমের ছবি তুলে মিডিয়ায় প্রকাশ করার প্রতিযোগিতা! আবার কয়েক দিন পর সব শেষ। মশা নিধনের দিকে আর কেউই ফিরে চায়নি! শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কিছু ওষুধ ছিটিয়েছিল। কিন্তু তাতে মশা নিধন হয়নি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তাতে প্রমাণিত হয়েছিল, ‘মশা নিধনের ছিটানো ওষুধ অকার্যকর। তাই মশা বিনাশ হয়নি।’ এ জন্য ওষুধ আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান, অনুমতিদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশন একে অপরের উপর দায় চাপিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত দায় কার, তা নির্ধারণ করা হয়নি আজও। এমনকি এই অপরাধে কারও কোনো শাস্তি হয়েছিল এমন খবর পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য যে, বেশ কয়েক বছর আগে দেশে প্রথম চিকুনগুনিয়া হয়েছিল। এই ব্যাধিও মশা থেকে উৎপত্তি। তাতে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। ব্যাধিটি নতুন তাই ডাক্তারগণ বিষয়টি প্রথমে ধরতে ও চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে এ নিয়ে সারাদেশে আতংক সৃষ্টি হয়েছিল। মৃত্যুও হয়েছিল অনেক। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি নেই। চিকুনগুনিয়া হোক, আর ডেঙ্গুই হোক, তার সুচিকিৎসা করতে দেশের ডাক্তার, নার্স ও সহযোগীরা সক্ষম। কিন্তু সমস্যা চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। কারণ, দেশে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ভালো হলেও ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য জনবলের এবং যন্ত্রপাতির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টদের মান ও আন্তরিকতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। এ ছাড়া, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দও নগণ্য। তাই ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত। যেমন: হু’র গাইডলাইন মতে, একজন নাগরিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় করবে ৩২%। অবশিষ্ট অর্থ খরচ করবে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭% মিটিয়ে থাকে নিজে। অথচ এটা নেপালে ৪৮%, শ্রীলঙ্কায় ৪২%, ভুটানে ২৫%, পাকিস্তানে ৫৬%। অবশিষ্ট ব্যয় সরকারের। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশের ৫০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছে। এছাড়া, দেশে স্বাস্থ্য বীমার অবস্থাও ভালো নয়। এসডিজি অনুযায়ী দেশের সব মানুষকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনা বাধ্যতামূলক। সে জন্য ২০২১ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য বীমার জন্য বাংলাদেশকে জিডিপির ৪% ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বীমায় ব্যয় করছে মাত্র ০.০৯%। অথচ এটা ভারতে ৩.০৭%, মালদ্বীপে ৪.৭০%, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১২.৪৮%। এই অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫% বরাদ্দ হওয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু গত অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১ শতাংশেরও কম। জিডিপির অনুপাতে এটি প্রতি বছরই কমছে। তাই জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা মোকাবেলায় এ দেশ খুব দুর্বল। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচক-২০ অনুযায়ী, জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা মোকাবেলায় দুর্বল অবস্থানে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম(স্কোর ৩৫)। এ তালিকায় ভারত ৫৭তম, ভুটান ৮৫, পাকিস্তান ১০৫, নেপাল ১১১। তাই দেশের সামর্থবানরা বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা করান। তাতে বছরে প্রায় ৫শ’ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়, যা মোট জিডিপির প্রায় ৩.৫%। অন্যদিকে, দেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিও ব্যাপক। দুদক গত ১২ ডিসেম্বর এক রিপোর্টে বলেছে, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সিন্ডিকেট করে জনসাধারণের জন্য করা সরকারের বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।’ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্য ও দীনতা তুলে ধরে রিপোর্টটি সরকারের কাছে দাখিল করেছে দুদক। এই হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র। অথচ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তাই এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রধানতম। তাই দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন-২০১৮ করা হয়েছে। তথাপিও দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বড়ই করুণ। এটা আরও ব্যাপকতর হতো, যদি দেশের সব মানুষ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় থাকতো। কিন্তু তা নেই। বিবিএস রিপোর্ট-২০১৭ অনুযায়ী, ‘দেশের ৫৭% মানুষ স্বাস্থ্য সেবার বাইরে রয়েছে।’ গত ২/৩ বছরে এ সংখ্যা তেমন বাড়েনি। স্মরণীয় যে, চিকিৎসা সেবার বাইরে থাকা মানুষের কিয়দংশ হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজি, ঝাড়-ফুক-পানি পড়া ইত্যাদির দ্বারস্থ হয়। এতে হিতে বিপরীত হয় অনেকের। আর বেশিরভাগ মানুষ নানা ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে চির বিদায় নেয়। এসব মানব সম্পদ উন্নয়নের চরম অন্তরায়!
যা’হোক, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল মন্ত্র হচ্ছে: রোগ প্রতিরোধ। সর্বোপরি এবার সারাদেশে চলছে করোনা নিয়ে মহাআতংক। হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীরা এটা নিয়েই ব্যস্ত। সর্বোপরি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও করুণ। এই অবস্থায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে তা সামাল দেওয়া কঠিন। তাই ডেঙ্গু বন্ধ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন মশা নির্মূল করা। কিন্তু শুধুমাত্র মশা নির্মূল করলেই চলবে না, সে সাথে মশার উৎপত্তিস্থলও ধ্বংস করতে হবে। নতুবা সেখান থেকে পুনরায় বিস্তার ঘটবে। বিষয়টি সরকারও অনুধাবন করেছে। তাই গত ২ এপ্রিল স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভার সিদ্ধান্ত স্থানীয় সরকার বিভাগের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘সম্ভাব্য ডেঙ্গু মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার দায়িত্বশীল প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের করণীয় নির্ধারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর স্বাক্ষরে একটি আধা সরকারি পত্র প্রেরণ করা হবে। সম্মিলিত উদ্যোগের অংশ হিসাবে দুই সিটি কর্পোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ একযোগে মশক নিধন অভিযান শুরু করবে।
সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, সরকারি ভবন, লেক, পার্ক, খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু মশা মারার কাজ করবে সিটি কর্পোরেশন। দীর্ঘ ছুটির সময় বন্ধ থাকা অফিসগুলো থেকে এডিস মশার উৎপত্তি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।’ অপরদিকে, গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা ২ সিটি নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলরগণ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মশা নিধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। উপরন্তু তাদের শপথকালে প্রধানমন্ত্রীও মশা মারার কথা বলেছেন। এই খবরগুলো আশাব্যঞ্জক। কিন্তু তবুও সংশয় রয়েছে। কারণ, আমরা সবক্ষেত্রেই শুরু করি দেরিতে। হয়তো বুঝিও দেরিতে। আবার যখন কোনো কিছু শুরু করি, তখন সেটা নিয়ে লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে ফেলি। কিন্তু সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই রণে ভঙ্গ দেই। সেদিকে আর ভুলেও ফিরে থাকাই না। এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। সরকারও এ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু এবার মশা নিধনের ক্ষেত্রে যেন তা না হয় সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা দরকার। নতুবা চরম মাশুল দিতে হতে পারে দেশের এই চরম দুর্দিনে। যা কাম্য নয়।
শুধু ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারলেই শতভাগ সাফল্য পাওয়া যাবে না, শতভাগ সাফল্য পেতে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে এবং সে অবস্থা সার্বক্ষণিক রাখতে হবে। দেশে মশার উৎপত্তিস্থল রয়েছে ব্যাপক। যেমন: পত্রিকান্তরে প্রকাশ, রাজধানীতে প্রায় ১০ কিলোমিটার জলাশয় এবং অন্তত ৩০০ কিলোমিটার কার্পেটিং ড্রেন রয়েছে। যা পরিষ্কার করা হয় না। এছাড়া, রাজধানীর বেশিরভাগ দুই বাড়ির মাঝের সার্ভিস লেন ময়লার ভাগাড় হয়ে আছে। উপরন্তু প্রায় সব এলাকায় আবর্জনার স্তূপ হয়ে থাকে প্রায় সময়ই। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ মতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১০% এলাকা ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব এলাকায় অতিরিক্ত মাত্রায় ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। অপরদিকে, রাজধানীর যত্রতত্রই ব্যাপক প্লাস্টিকের পণ্য ও পলিথিন ব্যাগ পড়ে থাকে। যার অনেকগুলোর মধ্যে থাকে পানি। এছাড়া, নানাস্থানে পড়ে আছে অসংখ্য গাড়ির পুরানো/নষ্ট টায়ার-টিউব। বাড়ির ছাদে ও বারান্দার ফুলের অনেক টব আছে। এসবের প্রত্যেকটিই মশার উৎপত্তিস্থল। এছাড়া, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেক প্রকল্পের কারণে রাস্তা ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। সে কাজগুলো শেষ হয়নি। সেখানেও পানি ও ময়লা আবর্জনা জমে থাকে। এসবও মশার উৎপত্তিস্থল। একই অবস্থা কমবেশি সারাদেশেই বিদ্যমান। তাই মশার উৎপত্তিস্থল একসাথে ধ্বংস করতে হবে এবং সে সাথে ময়লা-আবর্জনা যেন কোথাও পড়ে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুমাত্র ঢাকায় মশা নিধন ও এর উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করে দেশের অন্যস্থানে এসব করা না হলে সেসব স্থানের মশা ঢুকে পড়বে ঢাকায়। কোনো কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। ফলে ‘যাহা পূর্বং তারা পরং’ হবে। তাই সারাদেশে একসাথে মশক নিধন ও এর উৎপত্তিস্থল ধ্বংস এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে এবং তা সার্বক্ষণিক বজায় রাখতে হবে। এ কাজে সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, বাড়ির চতুর্দিকে সার্বক্ষণিক পরিষ্কার রাখা এবং ছাদে ও বারান্দায় ফুলের টবে পানি জমে থাকতে না দেওয়া সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। সে কাজটি তারা না করলে, তা করার জন্য বাধ্য করতে হবে। অপরদিকে, গত বছর ডেঙ্গুর টেস্ট ও চিকিৎসা নিয়ে বাটপারী হয়েছিল। এবার যেন তা না হয়, সে জন্য তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।