পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমার মনে হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের পলিসি শুরু থেকেই অপরিকল্পিত ছিল এবং এখনো অপরিকল্পিতই আছে। একাধিক ঘটনা এর জ¦লন্ত সাক্ষী। এর মধ্যে সর্বশেষ ঘটনাটি হলো গত ৪ এপ্রিলের ঘটনা। এই ঘটনাটি ৪ এপ্রিল ঢাকার একাধিক দৈনিক পত্রিকার অন লাইন সংস্করণে ছবিসহ ছাপা হয়েছে। ডেইলি স্টারের শিরোনাম ছিল, Thousand returning to Dhaka avoid shutdown. রিপোর্টে বলা হয় সাভার, মানিকগঞ্জ, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গাজীপুর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষকে দেশব্যাপী ছুটি বা বন্ধ সত্তে¡ও ঢাকা আসতে দেখা গেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সরকার গত ২৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে ছুটি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এই ছুটির মেয়াদ আরো বাড়ানো হয়েছে। ৫ তারিখ থেকে ৯ এপ্রিল সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১০ ও ১১ এপ্রিল শুক্রবার ও শনিবার থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি ছুটি এবং সাধারণ ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ১১ এপ্রিলের পর কী হবে সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। ১১ এপ্রিলের পর সরকারি ছুটির মেয়াদ কি বৃদ্ধি পাবে? নাকি ছুটি শেষ হয়ে যাবে এবং ছুটি উঠে যাবে? এমন একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঢাকা অভিমুখে ছুটে আসে। সাধারণ ছুটির কারণে গণপরিবহন সাময়িক বন্ধ থাকায় ঢাকাগামী মানুষের অনেকে পিকআপ ভ্যান, ট্রাক, ভ্যানগাড়ি ইত্যাদিতে আরোহী হয়। যারা এসব পরিবহনের কোনটাতেই জায়গা করতে পারেনি তারা পায়ে হেঁটেই ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেয়। ঢাকায় আগমনের সময় মানুষজনের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেসব নির্দেশ অমান্য করে তারা দল বেঁধে রওয়ানা হয়।
যারা ঢাকায় আসছিল তাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অনেকেই নিজেদের পরিচয় দেয় গার্মেন্ট কর্মী হিসাবে। তারা ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক হয়ে ঢাকা আসে। ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা মন্তব্য করেছে যে, স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে যে দৃশ্য দেখা যায়, শনিবারের দৃশ্যটি ছিল তদ্রুপ। স্থানীয় প্রশাসন বলে যে, ঐসব যাত্রীকে অনেক অনুরোধ করেও তারা ঘরে ফেরাতে পারেননি অথবা নির্ধারিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেনি। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে হাজার হাজার লোককে ট্রাক এবং ছোট ছোট পিকআপে আসতে দেখা যায়। তাদের অনেকে বলে যে, তারা কারখানার শ্রমিক। রবিবার তাদের কারখানা খুলবে। গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়) শত শত মানুষকে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। কিন্তু কোনো গাড়িঘোড়া না পেয়ে অনেকে পদব্রজে ঢাকা রওয়ানা হয়। ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ শত শত শ্রমিক রিকশা এবং হিউম্যান হলারে করে ঢাকা রওয়ানা হয়।
দুই
এটি অবশ্যই একটি সুখকর সংবাদ নয়। এটি সরকারের জন্য এবং দেশবাসীর জন্য একটি অশ্বস্তিকর সংবাদ। হাজার হাজার মানুষ যখন ঢাকায় ঢুকে পড়েছে তখন এত মানুষকে কি আর মফস্বলে ফেরত পাঠানো সম্ভব? শনিবার বিকেলে এই নিবন্ধ লেখার সময় একটি উদ্বেগজনক সংবাদ পাওয়া গেল। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি’র ৪ এপিল অনলাইন রিপোর্টের শিরোনাম হলো, ‘ঢাকার মিরপুরে করোনা আক্রান্ত বেশি।’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৯টি জেলায় এ পর্যন্ত ৭০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৬ জন সনাক্ত হয়েছে ঢাকায়।’ এনটিভির ঐ সংবাদে বলা হয়েছে যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সর্বশেষ পরিসংখ্যান নিয়ে আইইডিসিআরের ওয়েব সাইটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও আক্রান্ত জেলাগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর, কুমিল্লা ও গাজীপুর।
রাজধানী মিরপুরে সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মনিপুরে ৫ জন, সেনপাড়ায় ২ জন, মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বরে ১ জন করে রোগী আছে। অন্য দিকে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় ৪ জন, পুরান ঢাকা বাংলাবাজার এলাকায় ৩ জন, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, হাজারীবাগ, মগবাজার, উত্তরা ও উত্তরখানে ২ জন করে রোগী আছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী, আজিমপুর, কলাবাগান, রামপুরা, মহাখালী, বনানী-গুলশান, বারিধারা ও খিলখেত এলাকায় ১ জন করে রোগী সনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, বিদেশ ফেরত মানুষের মাধ্যমেই দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ঘটেছে। সর্বশেষ সোমবার বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, করোনাভাইরাসে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩ জন্য এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১২ জনে উন্নীত হয়েছে।
রবিবার ৫ এপ্রিল এই লেখাটি যখন শেষের পর্যায় তখন একাধিক টেলিভিশন নিউজ বুলেটিন দেখলাম, অনেক গার্মেন্ট কারাখানা খুলেছে এবং শ্রমিকরা সেখানে কাজ শুরু করেছে। অথচ আগের দিন ৪ এপ্রিল শনিবার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বিশেষ করে পোশাক শিল্প শ্রমিক যখন রবিবার কারখানার কাজে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা আগমন করে তখন প্রশাসন এবং সরকারের গুরুতর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কারণ, এর আগে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেছেন যে, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটির আওতায় পোশাক কারখানাও বন্ধ থাকবে। ৪ তারিখের পর ৫ এপ্রিল থেকে যেসব মালিক কারখানা খুলতে চান তারা খুলতে পারবেন এবং যারা বন্ধ রাখতে চান তারা বন্ধ রাখতে পারবেন। তবে যারা কারখানা খুলবেন সেসব কারখানার মালিককে এই ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করতে হবে যে, করোনার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেন নিশ্চিত করা হয়।
৩ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো পোশাক কারখানার মালিক বলেননি যে ৫ তারিখের পরেও তাদের পোশাক কারখানা বন্ধ থাকবে। সুতরাং শ্রমিকরা ধরে নিয়েছিলেন যে, তাদের কারখানা ৫ তারিখ থেকে খুলছে। সে জন্যই চাকরি রক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ৫ তারিখে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসেছে।
তিন
ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই জটিল আকার ধারণ করে। সমগ্র বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ও র্যাব টহল দিচ্ছে। মাইকিং করে জনগণকে বলা হচ্ছে, ঘর থেকে বের হবেন না। আরো বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। পুলিশ ও র্যাবকে সহায়তা করার জন্য রাস্তায় নেমেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাইকিং করে বলছেন, আপনারা ঘর থেকে বের হবেন না এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। অথচ যে লক্ষ লক্ষ জনগণ কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ভ্যান গাড়ি, সিএনজি, হিউম্যান হলার, পিকআপ, ট্রাক এবং পদব্রজে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে ঢাকায় এল তার ফলতো পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনীর বক্তব্য, অনুরোধ এবং নির্দেশ উপেক্ষিত হলো। কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?
এখানে একটি বিষয় খুব মনোযোগের সাথে খেয়াল করা দরকার। সরকার কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করেছেন এবং গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে। সরকার কিন্তু বাংলাদেশে লকডাউন ঘোষণা করেনি। এমন কি সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করেনি। লকডাউন বা সাধারণ ছুটি এই শব্দগুলি মিডিয়াই ব্যবহার করছে। যদি লকডাউন ঘোষণা করা হতো তাহলে কোনো ধরনের কলকারখানা খোলার কোনো অবকাশই থাকতো না। ভারতের মতো সাড়ে ১৩ লক্ষ বর্গ মাইলের ১৩০ কোটি অধিবাসী অধ্যুষিত সমগ্র দেশটিতে যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা যায় তাহলে বাংলাদেশের মতো ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দেশে লকডাউন ঘোষণা করা যায় না কেন?
যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কারখানা খোলা থাকার জন্য করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থবিধি লংঘন করে ঢাকায় আসতে বাধ্য হলো তাদের কারণে ঢাকায় যদি করোনার সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে যায় তাহলে তার জন্য দায়ী থাকবে কে? সম্ভবত আসন্ন ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা করেই বিজেএমই’র সভাপতি রুবানা হক ৪ এপ্রিল রাতেই সমস্ত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার জন্য সমস্ত কারখানার মালিকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। অথচ ২৬ মার্চ এই বিজেএমই’র সভাপতি বলেছিলেন যে, সাধারণ ছুটির সময় কেউ কারখানা খোলা রাখতে চাইলে তিনি খোলা রাখতে পারবেন।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, ৫ তারিখ সকাল থেকেই বিভিন্ন কারখানায় মাইকিং করা হয় যে, ১১ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। কোনো কোনো কারখানায় নোটিশ টাঙিয়ে বলা হয়েছে যে, আগামী ১২ এপ্রিল কারখানাসমূহ যথারীতি খোলা থাকবে। সবাইকে খোলার তারিখে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এখন শ্রমিকরা বলছে, গণপরিবহন বন্ধ, তারা দেশে ফিরে যাবে কীভাবে? তারা তো ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনও পায়নি। এখন তারা খাবে কী? কবে বেতন দেওয়া হবে সে কথাও তো বলা হয়নি। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের অনেকেই ঢাকায় মেসে থাকত। সেই মেসও তারা ছেড়ে দিয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা তাদের বাড়িতে মেস হিসাবে আর ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। কারণ মেসের একটি রুমে ৪ থেকে ৬ জন বোর্ডার থাকে। বাড়ির মালিকরা মনে করছেন যে, এখন যদি তিনি তাদের বাড়িকে মেস হিসাবে ভাড়া দেন তাহলে সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘিত হতে পারে এবং ব্যাপক আকারে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
শ্রমিকদের মাইকিং করে এবং নোটিশ দিয়ে ১২ এপ্রিল আসতে বলা হয়েছে কেন? সরকার অথবা মিল মালিকরা কি নিশ্চিত যে, ১২ এপ্রিলের মধ্যে করোনা ভাইরাস বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেবে? তারা কি খেয়াল করেছেন যে আমেরিকায় ১ ফেব্রæয়ারি করোনায় সনাক্ত হয়েছিলেন মাত্র ৭ ব্যক্তি। কিন্তু এক মাস পর অর্থাৎ ১ মার্চ ৭ ব্যক্তি ছাড়িয়ে ১ লক্ষ ৯০ হাজার ব্যক্তিতে উন্নীত হয়। অনুরূপভাবে মাত্র ১ মাসের মধ্যে ইটালীতে করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১ লক্ষ, স্পেনে ৯৫ হাজার, ইংল্যান্ডে ২৫ হাজার, জার্মানীতে ৭০ হাজার, ফ্রান্সে ২২ হাজার। এমনকি ভারতেও ১ মাসে করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪০০ জন এবং পাকিস্তানে ১৯০০ জন। বাংলাদেশেরও যে আগামী ১ মাসে করোনা রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? শ্রমিকসহ ছিন্নমূল মানুষরা কিন্তু বলছে, করোনায় মারা যাওয়ার আগে তো আমরা না খেতে পেয়ে মারা যাবো।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।