পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত বিস্তার করেছে। বিজ্ঞানীরা এর কারণ যাই বলুক, এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালার গজব। কারণ, মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও মহানবী সা. এর হাদিসের পবিত্র বাণী অনুযায়ী পৃথিবীতে মানবজাতির অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ও গুনাহের সীমা লঙ্ঘনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারী আপতিত হয়। আল্লাহতায়ালার বিধিবিধান, আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘনের কারণে এবং শাসক গোষ্ঠির জুলুম-অত্যাচারের শাস্তিস্বরূপ পৃথিবীতে প্রাণঘাতী মহামারী ভাইরাস ও ধ্বংসাত্মক দুর্যোগ অবতীর্ণ করা হয়। বর্তমান গোটা বিশ্ব অশ্লীলতা, ন্যুডিজমে ছেয়ে গেছে। পত্রপত্রিকা ম্যাগাজিনে ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াতে অশ্লীল ছবি, ভিডিও, নারী-পুরুষের অশ্লীল দৃশ্য এখন খুবই সহজলভ্য। ইন্টারনেট, ইউটিউবসহ অসংখ্য ওয়েবসাইটের কারণে এগুলোর অ্যাকসেস পেয়ে যাচ্ছে সারাবিশ্বের মানুষ। ফলে গোটা বিশ্ব এখন অশ্লীলতায় সয়লাব। নির্দিষ্ট দু’এক প্রকার গোনাহের কারণে শাস্তি হয়, বিষয়টি এমন না, বরং জীবন ধারণের নানাদিক ও বিষয়ে আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ হলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটে।
করোনাভাইরাস চীনে উৎপত্তি হয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে যে; চাইনিজরা শূকর, কুকুর, সাপ, বাদুড়, ইঁদুর ইত্যাদি জীবজন্তু খায়। ফলে কুরআনে বর্ণীত স্রষ্টার খাদ্যনীতি না মানার কারণে তারা জীবনহানীকর এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যেসব জন্তু যা আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়।’ (সুরা মায়িদা: ৩)
করোনা থেকে বাঁচতে সতর্কতা জরুরি:
বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী স্কলার জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী বলেন, বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। অনেকেই মনে করেন, এ রোগ থেকে বাঁচতে শরয়ি বিধানের পরিপন্থী চলতে হবে, এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়।
শরিয়তের প্রবর্তক নবী করিম সা. স্বয়ং এ জাতীয় রোগ থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে তার স্পষ্ট বর্ণনা হলো, আক্রান্ত এলাকার লোকজন বাইরে যাবে না এবং বাইরে থেকে কেউ আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করবে না। এ কথার উপর আমল করাটাই মূলত শরিয়তের নির্দেশনার উপর আমল করা।
মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ের অনেক গুরুত্ব আছে। হাদিস শরিফে এ বিষয়ে তাগিদ এসেছে। এটি অবশ্যই অনস্বীকার্য। কিন্তু কখনো কখনো মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়ের বাধ্যবাধকতা শিথিল হয়ে যায়। যেমন: প্রবল বর্ষণ, ঘোর অন্ধকার, শত্রু র ভয়, মৃত্যুভয় অর্থাৎ মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এবং হিংস্র প্রাণীর ভয় ইত্যাদি। সুতরাং জুমা ও অন্যান্য ফরজ নামাজের আগে পরের সুন্নতগুলো নিজ ঘরে পড়ার চেষ্টা করা। নিজ ঘরে সুন্নত পড়ার বিষটি হাদিসেও এসেছে। এটাই উত্তম। যথাসম্ভব বাড়ি থেকেই অজু করে আসা। ইমামদেরও উচিত কেরাত সংক্ষিপ্ত করা। প্রয়োজনের সময় কেরাত ছোট করাই উত্তম। এছাড়াও মুসাফাহা না করার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের যে নির্দেশনা আছে তা মেনে চলা উচিত। ভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে ফরজ ওয়াজিব নয় এমন সব বিধান ছাড়তে কোনো অসুবিধা নেই। এটা নিজের জন্য এবং নিজের সাথীদের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনবে। মহামারীর সময় এটাই নববী নির্দেশনার অনুসরণ হতে পারে।
এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে হাদীসের নির্দেশনা হলো: রাসূল সা. বলেন, ‘কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তি হতে দূরে সরে থাক, যেমন সিংহ থেকে পালিয়ে থাকো। অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তি যেন সুস্থদের কাছে না ভিড়ে।’ (সহীহ বুখারী শরীফ)
করোনায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। মহামারী ও দুরারোগ্যব্যাধি কাফের-মুশরিকদের জন্য আযাব হলেও মুসলমনদের জন্য রহমত এবং তাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তা শাহাদাত হিসেবে গণ্য হয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে: ‘মহামারী আমার উম্মতের জন্য শাহাদাত এবং রহমতস্বরূপ। আর কাফেরদের জন্য হল আযাব।’ (মুসনদে আহমদ ৭/৩৩) রাসূল সা. আরো বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মহামারীতে পতিত হয় এবং নেকির আশায় সে ধৈর্যসহকরে সেখানে অবস্থান করে এবং এ বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহতায়ালার হুকুম ব্যতিত কিছুই হয় না, তাহলে সে শহীদের সওয়াব পায়।’ (বুখারি শরীফ : ৫৪০২ নং হাদীস)
করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য করণীয় আমল:
ইস্তেগফার ও দোয়া করা: আল্লাহর কাছে সমস্ত অপরাধ ও পাপ থেকে ক্ষমা চাওয়া এবং করোনা ভাইরাসসহ সর্বপ্রকার রোগ থেকে পরিত্রাণ চাওয়া। আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতূবু ইলাইহি। অর্থ: ‘আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকটই তাওবা করছি।’ (সহীহ বুখারী-৬৩০৭; সহীহ মুসলিম-২৭০২)
রাসূলুল্লাহ (সা.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য নিন্মােক্ত দোয়াসমূহ বেশি বেশি করে পড়তেন: ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল জুনূনি ওয়াল জুযা-মি ওয়ামিন ছাইয়্যিইল আসক্বাম।’ অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে শ্বেত রোগ, মস্তিষ্ক বিকৃতি, কুষ্ঠ রোগ ও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই। (সুনানে আবি দাউদ, হাদীস নং ১৫৫৪) ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৯১)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতিদিন ভোরে ও সন্ধ্যায় যে কোন বান্দা এ দুয়াটি তিনবার পাঠ করবে, কোন কিছুই তার অনিষ্ট করতে পারবে না। ‘বিসমিল্লাহিল লাযি লা- ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইয়্যুন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়াহুয়াস সামীউ’ল আলীম।’ অর্থ: ‘আল্লাহতায়ালার নামে যাঁর নামের বরকতে আকাশ ও মাটির কোন কিছুই কোন অনিষ্ট করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৯১)
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চলা:
পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। জীবাণুমুক্ত থাকার জন্য ঘন ঘন হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার থাকতে বলেছেন চিকিৎসকরা। মেডিকেল সাইন্সের আলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ঘন ঘন হাত, পা, মুখ ইত্যাদি অঙ্গগুলো ধোয়ার উপকারিতার প্রচার করছে। অথচ মুসলমনরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে অজু করে হাত, মুখ, পা ধুয়ে পরিষ্কার করে। এ ছাড়া ঘন ঘন অজুর মাধ্যমেও আমরা সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকতে পারি। কারণ মহান আল্লাহ অজু করার সময় এমন চারটি অঙ্গকে ধোয়া ফরজ করেছেন, যে চারটি অঙ্গের মাধ্যমে শরীরে দ্রুত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইসলামের বিধান মেনে চললে মানবদেহে করোনাভাইরাস ঝুঁকির আশঙ্কা কমবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি সবসময়েই সবারই জন্য সমভাবেই প্রযোজ্য। ১৪শ’ বছর পূর্বে মহানবী সা. যে কথাটি গুরুত্ব সহকারে বলে গেছেন, তা আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য যুগোপযোগী ব্যাখ্যা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, যখন তোমরা নামাজে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করো, মাথা মাসেহ করো এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত করো।’ (সুরা মায়েদা- ৬) এ ছাড়া অজুর শুরুতে কবজি পর্যন্ত দুই হাত ধোয়া, কুলি করা, দাঁত মিসওয়াক করা, কান ও নাকের বহির্ভাগ পরিষ্কার করাকে মহানবী সা. তাঁর সুন্নাত হিসেবে অনুসরণ করতে বলেছেন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।