পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুর্নীতি বিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা, তাদের আয় ও আয়ের অর্থ পাচার সম্পর্কিত ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ২১ খাতে কমবেশি ৪৪ দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার বিদেশি কাজ করছেন। এদের মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মালেয়শিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীনের নাগরিক উল্লেখযোগ্য। বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। দেশে কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে ২ লাখ ৪১ হাজারই অবৈধ এবং কর প্রদানকারীর সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৫০০ জন। দেশে কর্মরত বিদেশিরা বেতনের নামে দেশ থেকে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন, যা পদ্মাসেতুর মোট ব্যয়ের সমান। কর্মানুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) না নিয়ে পর্যটক ভিসায় এসে বাংলাদেশে কাজ করেন ১ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি। এরা কোনো কর না দিয়েই আয়ের অর্থ দেশে পাঠান। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। বৈধভাবে কর্মরত বিদেশি কর্মীর বেতন প্রাতিষ্ঠানিক নথিপত্রে প্রকৃত বেতন অপেক্ষা কম দেখানো হয়। এদের বেতনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৈধভাবে ব্যাংক হিসাবে পরিশোধ করা হয় এবং বাকি টাকা অবৈধভাবে নগদ দেয়া হয়। অবৈধভাবে কর্মরত কর্মীর শতভাগ বেতন নগদ বা অন্য কোনো দেশের (দুবাই বা সিঙ্গাপুর) ব্যাংক হিসাবে দেয়া হয়। নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কর্মীর নিয়মিত হাত খরচ, আবাসন ও পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে।
বৈধ-অবৈধ উভয়ভাবে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যাক বিদেশির কাজ করা, কাজ করে প্রাপ্ত আয়ের বড় অংশ পাচার ওপেনসিক্রেট। কত সংখ্যক বিদেশি বাংলাদেশে কর্মরত আছেন, কত টাকা তারা বেতন-ভাতা বাবদ পান, কী পরিমাণ অর্থ তারা দেশে পাঠান তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। বিদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশিরা দেশে কতদিন থাকছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, তা দেখভাল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশিদের কাজের অনুমতি স্বরূপ ওয়ার্ক পারমিট দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের অধীন বিনিয়োগ বোর্ড, বিদেশিদের কর্মক্ষেত্রের সুযোগ-সুবিধা দেখে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিদেশিদের উপার্জিত অর্থের আয়কর আদায়ের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের (এনবিআর)। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশে অবস্থানকারী এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা ও আয়ের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বিরাজমান অবস্থায় জানাতে পারবে কী না তা নিয়েও সংশয় আছে। ২০১৫ সালের শেষের দিকে রাজধানীর গুলশান ও রংপুরে দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার পর দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের তালিকা তৈরির একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে উদ্যোগ এক পর্যায়ে হিমঘরে চলে গেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১২ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না হলেও নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বিদেশি বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, এদের বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে কাজ করছেন এবং বিপুল অংকের অর্থ বেআইনী পথে তাদের নিজ দেশে পাচার করছেন। বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিদের বড় অংশ ভারতীয় তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দীর্ঘ স্থল সীমান্ত থাকায় বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ভিসা ছাড়াই চোরাপথে বাংলাদেশে আসেন এবং তাদের একটা অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয়রা সহজলভ্য- তুলনামূলক সাশ্রয়ী হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধিকসংখ্যক ভারতীয় নিয়োগ পান। পৃথিবীর সবদেশেই বিদেশিদের কাজের সুযোগ দেয়া হয়। কোনো দেশে অন্য দেশের কেউ কাজ করতে চাইলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিতে হয়; ওয়ার্ক পারমিট নেয়া বাধ্যতামূলকও। বাংলাদেশেও এ নিয়ম কার্যকর। তবে বাংলাদেশে এ নিয়মের তেমন একটা তোয়াক্কা করা হয় না। ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশিদের কাজের সুযোগ থাকাতে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা এবং বিদেশিদের আয় সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তথ্য অজানা থাকে। পৃথিবীর সবদেশেই বিদেশিদের গতি-বিধি, অবস্থান আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থা পর্যবেক্ষণে রাখে। বাংলাদেশে বিদেশিরা নির্বিঘ্নে যেভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেআইনীভাবে কাজ করে তাতে মনে হয় আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এক্ষেত্রে কোনো দায়িত্ব নেই। বাংলাদেশে পার্লারে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, সংবাদ মাধ্যমে, শো-রুমেও বিপুল সংখ্যক বিদেশি ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া প্রকাশ্যে কাজ করতে দেখা যায়। অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায়ও বিদেশি নিয়োগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে গতবছর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর। সরকারের ‘উদার মনোভাব’ই দেশে বিপুল সংখ্যক বিদেশির অবৈধ অবস্থান এবং অবৈধভাবে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে।
অবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিরা বেআইনীভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আয় করা মোটা অংকের অর্থ চোরাপথে দেশে নিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই। বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) সুফল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বিদেশিদের বিপুল অংকের অর্থ পাচারের কারণে। বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করে তার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি দেশে নিয়ে যায় বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা। ২০১৮ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বিদেশি কাজ করে, এতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক তথ্যমতে, গড়ে ২২ জন প্রবাসীর আয় নিয়ে যায় বাংলাদেশে কর্মরত একজন বিদেশি। ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ব্যাঙ্গালুরভিত্তিক একটি নিউজ পোর্টাল ২০১৩ সালে ‘ফিফটিন নেশনস সেন্ডিং হাইয়েস্ট রেমিট্যান্স টু ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৫ লাখ ভারতীয় অবস্থানের তথ্য দিয়েছে।
দরিদ্র ও বেকার মানুষের অভাব নেই বাংলাদেশে। বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১১ কোটির এবং বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখের বেশি। প্রতি বছর নতুন ২০ লাখ শ্রমশক্তি শ্রম বাজারে যোগ হয়। প্রতিবছর ৬ লাখের বেশি গ্রাজুয়েট বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ হাজারের কর্মস্থান করা সম্ভব হয়। স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকার প্রায় ৩৭ শতাংশ। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ৩৪ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণ-তরুণীর মধ্যে বেকারের হার যথাক্রমে ২৭ ও ২৮ শতাংশ। এমন দেশে বিপুল সংখ্যক বিদেশি বেআইনীভাবে অবস্থান করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের, বেতন-ভাতা বাবদ প্রাপ্ত বিপুল অংকের অর্থ পাচারের অবারিত সুযোগ বিস্ময়কর। অবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিরা প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থার নাকের ডগাতেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বিদেশিদের অবৈধ অবস্থান, ওয়ার্ক পারমিট না নিয়ে কাজ করা, অবৈধ অবস্থানকারী বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজের সুযোগ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধ কারো চোখে পড়ে না। বিদেশি নাগরিকদের অবৈধ অবস্থান, ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজের সুযোগ দেশের অর্থনীতি, স্থানীয়দের কর্মসংস্থানেরই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও অনিষ্টকর হচ্ছে। দেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের অনেককেই রাষ্ট্রবিরোধীসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকতেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদেশি নিয়োগ দেয়া হয় জাতীয় স্বার্থে। স্থানীয় লোকবল সংকট, দক্ষ লোকবলের অভাবে বিভিন্ন দেশ বিদেশি নিয়োগ দেয়। বিদেশিদের ঢালাও নিয়োগ দুনিয়ার কোনো দেশ দেয় না। বাংলাদেশেও বিদেশিদের কাজের সুযোগ দেয়া যেতে পারে আবশ্যক হলে। কোনো পদে বিদেশি নিয়োগের আগে ওই পদে বিদেশি নিয়োগের প্রয়োজন কতটা আছে তা দেখে প্রয়োজন থাকলেই কেবল ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে বিদেশি নিয়োগের সুযোগ দেয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও বেকার সংখ্যাধিক্যের দেশে লাখ লাখ বিদেশির অবৈধ অবস্থান করে বিনা ওয়ার্ক পারমিটে কাজের, বেতন-ভাতার অর্থ বেআইনী পথে দেশে পাচারের সুযোগ দেশ-জাতির স্বার্র্থেই বন্ধ করা দরকার। বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও বেকারের দেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থানের বাজার তৈরি হয়েছে যার ফল আদৌ ভালো হওয়ার কথা নয়।
লেখক: কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।