Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বইমেলা ও আমাদের সংস্কৃতি

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৩২ এএম

বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আমাদের আবেগিত মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা অমর একুশে বইমেলা। আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তন্মধ্যে অমর একুশে বইমেলা হলো সর্বোকৃষ্ট মেলা; যেখানে জ্ঞানের বিনিময় ঘটে বইয়ের মাধ্যমে। বইপড়া ব্যতীত জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ নেই। তাই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বই হলো মানুষের জাগতিক, মনোস্তাত্মিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে উপনীত হওয়ার প্রধান সোপান। যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত। আর শিক্ষার জন্য বই-ই আলোকিত জগতের দিশারী। বইমেলা

যেকোনো জাতির জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় ও ঘনিষ্টতর হবে, সেই মানুষ তত উন্নত চিত্তের অধিকারী হবে। বিশ্বের যত জ্ঞানী-গূণি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিপ্লবী এবং স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, প্রত্যেকের জীবনই বইয়ের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বিশ্বের ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবী নেতা চে’গুয়েভারা সবসময় বন্দুকের সাথে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’ বইটি রাখতেন; বিশ্বখ্যাত আলেকজেন্ডার দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বই পড়ে অতিবাহিত করতেন।
এবারের বইমেলা জ্ঞানপিপাসু বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বাংলা একাডেমি তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কবি, লেখক, পাঠক এবং দর্শনার্থীর পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠছে মেলাপ্রাঙ্গন। নতুন বইয়ের তাজা ঘ্রাণে আমোদিত স্টলে স্টলে বইকেনা, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান, বই হাতে নিয়ে মোবাইলে ছবি ওঠানোর ধুম, ব্যস্ত কবি-লেখকগণের অটোগ্রাফে প্রশংসা ও আশীর্বচনে আসলেই বাঙালির প্রাণ চঞ্চল না হয়ে পারে না।

অমর একুশে বইমেলার পথিকৃৎ হিসেবে যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তিনি হলেন মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী মান্যবর প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা। যিনি সর্বপ্রথম আনুমানিক ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গনের বটতলায় মাটিতে চট বিছিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ত্রিশ-বত্রিশটি মতো বই বিক্রি শুরু করার মধ্যদিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এরপর থেকে তিনি একাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বইমেলা চালিয়ে যান। তিনি ১৯৭৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বই বিক্রির অনুমতি লাভ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুনমাত্রা লাভ করতে সক্ষম হন, ১৯৭৬ সালের দিকে অন্যান্যরাও অণুপ্রাণিত হয়ে তার সাথে যোগ দিতে শুরু করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে সরকার একে পূর্ণাঙ্গ বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সাথে সম্পৃক্ত হয় চিত্তরঞ্জণ সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য সরকারিভাবে আইন পাস করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ হওয়া সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেক শহীদদের স্মরণে নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মহাসমারোহে চলেছে গ্রন্থমেলার পথচলা। শুরু থেকে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজকে কেন্দ্র করেই বইমেলার বিস্তৃত ছিল, ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারণ করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা সংস্থা তাদের নিজস্ব বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে; তন্মধ্যে ভারত, রাশিয়া ও জাপানসহ আরও অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়।

বইমেলায় বইয়ের পাশাপাশি স্থান করে নিচ্ছে বিভিন্ন ডিজিটাল প্রকাশনা, যেমন- মোবাইল ফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, সিডি, ডিভিডিসহ আর কত ইন্টারনেট সংস্থা। পাশাপাশি লেখক বলছি কর্নার, তথ্যকেন্দ্র ও নিরাপত্তাদানকারী সংস্থাসমূহের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। এ সময় বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংস্থাসমূহ সাড়ম্বরে আয়োজন করে কবিতা পাঠের আসর, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রেডিও টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের কর্মীরা সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে বইমেলার অনুষ্ঠানাদি।

বাংলা একাডেমির আয়োজনে এ গ্রন্থমেলা দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। আর এমন একটি নক্ষত্রময় প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ । তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে।

প্রতি বছরের মতো এবারের বইমেলায়ও পাঠক ও দর্শক সমাগম আশাতীত। ১৫ ফেব্রুয়ারির দিন আমি বইমেলাতে উপস্থিত হয়েছিলাম। উপচেপড়া মানুষের উপস্থিতি থাকলেও সেই মোতাবেক বই বিক্রি হচ্ছে না বলে জানা যায় প্রকাশকগণের কাছ থেকে। বিক্রিত বইয়ের মধ্যে কাব্য, প্রবন্ধ ও অনুবাদ গ্রন্থের চেয়ে গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানা যায়। এবারে পহেলা ফাগুন ও ভ্যালেন্টাইন্স ডে ছুটির দিনে হওয়ায় মেলায় উপচেপড়া মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। কাব্যের চেয়ে গল্প ও উপন্যাস সহজবোধ্য হওয়ায় পাঠকগণ গল্প ও উপন্যাসের প্রতি বেশি ঝোক বলে ধারণা করা যায়। প্রবীণ ও খ্যাতনামা কবি-লেখকগণের পাশাপাশি নতুন লেখকদের বইও এবারের বইমেলায় বেশ প্রকাশিত হয়েছে।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে এবারের বইমেলায় বাস্তব মুক্তিযুদ্ধের ঘটনানির্ভর আমার লেখা একটি উপন্যাস ‘তুলসী ঘাটের বৃত্তান্ত’ বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলবাংলা প্রকাশন। উপন্যাসটি মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তিতাস নদীর তীরবর্তী তুলসী ঘাটে(বর্তমান পঞ্চবটি) সংঘটিত রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধ এবং ওই যুদ্ধে শহীদ হওয়া মনির(বাচ্চু) নামের এক বীর বাঙালির জীবন ইতিহাসকে কেন্দ্র করে রচিত। একজন অলিখিত মুক্তিযোদ্ধার বয়ানে ওই সময়ের গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়েওঠা সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন ঘটনা ওঠে এসেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালি বিশেষ করে মাঝি, জেলে, কৃষকগণ যেভাবে লাঠিশোঠা হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল মুক্তির চেতনায় তার বহুবিধ ঘটনার পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক অত্যাচার, নির্যাতন এবং গ্রামের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাসমূহ বাস্তবতা থেকে বেশ চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন- শ.ই মামুন এবং মূল্য- ২৫০ টাকা।

এবারের বইমেলায় আরেকটি বিষয় বেশ আলোচিত হচ্ছে, তা হলো- অন্যান্য বছরের তুলনায় বইয়ের দাম অনেক বেশি। বইয়ের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ‘বেহুলাবাংলা’র প্রকাশক চন্দন চৌধুরী এবং শুদ্ধপ্রকাশ’র প্রকাশক হিরণ্ময় হিমাংসু একই বক্তব্য তুলে ধরেন। তা হলো- বই ছাপাতে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে চীন থেকে আমদানীকৃত মালামাল হ্রাস পাওয়ায় এবং অন্যান্য মালামালামালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের মূল্য বেশি ধরতে হয়েছে।

বইয়ের দাম দাম যতই বেশি হোক না কেন, বই কিনে তো কেউ দেউলিয়া হয় না। তবুও সকলে বইমেলায় আসছে, আসবে, বই কিনবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা সকলের।



 

Show all comments
  • অাতিক অালতাফ ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১:৫২ পিএম says : 0
    অসাধারণ লেখা! পড়ে ভাল লেগেছে। তথ্যভিত্তিক লেখা কিন্তু পড়তে একঘেয়েমি অাসে নি! লেখায় সাবলীলতা অাছে । সুন্দর একটি লেখার জন্য ধন্যবাদ!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বইমেলা

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন