চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
এহসান বিন মুজাহির
বছরের চাকা ঘুরে মুক্তির বার্তা নিয়ে আবারও এলো মাহে রমজান। আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মোৎসর্গের মাস রমজান। রহমত, বরকত, মাগফিরাতের উর্বর মওসুমে আমরা সকলেই উপনীত। মহান আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে আমাদের দান করেছেন পুণ্যে ভরা মওসুম, অসীম রহমত ও সীমাহীন বরকতপূর্ণ পবিত্র রমজানুল মোবারক। আল্লাহতায়ালার নিয়ম অনুযায়ী কোনো মাসকে অন্য মাসের উপর কোনো দিবসকে অন্য দিবসের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর পবিত্র রমজানুল মোবারক হলো উৎকৃষ্ট মাসের মধ্যে অন্যতম একটি মাস। এ মাসে রাতদিন সর্বদা আমাদের উপর রহমত বর্ষিত হতে থাকে।
রমজান শব্দের বিশ্লেষণ : রমজান শব্দটি আরবি। ‘রমজুন’ শব্দ থেকে উৎগত হয়েছে। শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া, ভষ্মীভূত হওয়া ইত্যাদি। যেহেতু রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষের মনের ক্রোধ, কুপ্রবৃত্তি, হিংসা-বিদ্বেষ সবকিছু ভষ্মীভূত হয়ে যায় তাই রোজার এ মাসকে রমজান মাস বলা হয়। রোজা হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি স্তম্ভ। রোজার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বিরত থাকা। পরিভাষায় রোজা বলা হয় মহান আল্লাহর ফরজ নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সওয়াবের প্রত্যাশায় সুুবহে ছাদেক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া ও যাবতীয় পানাহার, স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস তথা যৌনাচার ইত্যাদি প্রভৃতি হতে বিরত থাকাকেই রোজা বলে। মহান আল্লাহতায়ালা দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাসে ‘মদিনাতুল মুনাওয়ারায় রমজান মাসের রোজা ফরজ করেছেন।
রোজার ফজিলত : মহান আল্লাহতায়ালা কোরআন কারীমে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পার’। (Ñসুরা বাকারা-১৮৩)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, রমজান মাস, যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়েত এবং সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর হক্ব-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে। (Ñসূরা বাকারা ১৮৫
হাদিস কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আসসাওমু-লী ওয়া আনা আজযীবিহি’ অর্থাৎ রোজা আমার জন্য এবং আমি তার প্রতিদান দেব।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, রমজান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া এবং শয়তানদেরকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়’। (বুখারি হাদিস নং-১৮৯৮)
হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের প্রত্যেক দিবস ও রাত্রিতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দোয়া কবুল করেন। (Ñমুসনাদে আহমদ, হাদিস ৭৪৫০)
হজরত কা’ব ইবনে উজরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বললেন, তোমরা মিম্বরের নিকট সমবেত হও। আমরা সকলেই তথায় উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন, তখন বললেন, আমীন, যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমিন, যখন তিনি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলেন বললেন, আমীন। হজরত কা’ব ইবনে উজরা (রা.) বলেন, যখন তিনি (মিম্বর থেকে) অবতরণ করলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ আমরা (মিম্বরে উঠার সময়)আপনাকে এমন কিছু কথা বলতে শুনেছি, যা ইতোপূর্বে কখনো শুনিনি। উত্তরে তিনি বললেন, জিব্রীল (আ.) আমার নিকট আগমণ করেছিলেন, যখন আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন তিনি বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে রমজান মাস পেল, তবুও তার গুনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমিন। যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম তখন বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যার নিকট আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। আমি বললাম আমিন। যখন তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তখন বললেন, ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তারা উভয় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। অর্থাৎ তাদের খেদমতের মাধ্যমে নিজেকে জান্নাতবাসী করতে পারল না। আমি বললাম, আমিন। (Ñমুসলিম, হাদিস-২৫৫১ ও তিরমিযী, হাদিস-৩৫৪৫)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রমজান মাস লাভকারী ব্যক্তিÑ যে উত্তমরূপে সিয়াম ও কিয়াম (রোজা, তারাবি ও অন্যান্য আমল) পালন করেÑ তার প্রথম পুরস্কার এই যে, সে রমজান শেষে গুনাহ থেকে ঐ দিনের মতো পবিত্র হয় যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (Ñমুসলিম, হাদিস-৮৯৬৬)
হজরত সালমান ফারসী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, মহানবী (সা.) শা’বান মাসের শেষদিন আমাদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনে রাখ, তোমাদের সামনে এমন একটি মাস সমাগত। যে মাস মহাপবিত্র, রহমত-বরকত ও নাজাতে ভরপুর। এই মাসের রোজাকে আল্লাহতায়ালা তোমাদের উপর ফরজ করেছেন। যে লোক এই মাসে আল্লাহর সন্তোষ ও তার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে রোজা রাখবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। (Ñবুখারি শরীফ)
যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে সত্তরটি ফরজের সওয়াব পাবে, আর যে ব্যক্তি একটি সুন্নাত আদায় করবে সে একটি ফরজের সওয়াব পাবে, আর যে একটি নফল আদায় করবে সে একটি সুন্নাতের সওয়াব পাবে। এই মাসে আল্লাহতা’য়ালা পুণ্যকে বর্ধিত করতে থাকেন। এই মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহতা’য়ালা তার গুনাহ মাফ করে দিবেন, আর সে ব্যক্তিকে রোজাদারের সওয়াব দিবেন। কিন্তু সে জন্য প্রকৃত রোজাদারের সওয়াবের মধ্যে কোনো কমতি করা হবে না। (Ñবুখারি)
মহনবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আসসাওমু জুন্নাতুন মিনাননার’ অর্থাৎ রোজা প্রকৃত ঈমানদারের জন্য ঢালস্বরূপ। (Ñমিশকাত শরীফ)।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাসের প্রথম রাত উপনীত হলেই মহান আল্লাহতা’য়ালা শয়তান ও দুষ্ট জিনগুলোকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেন’। (Ñতিরমিজি শরীফ)
হজরত সাহল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য বেহেশতের একটি দরজা ‘রাইহান’ যা দিয়ে তাদেরকে সর্বপ্রথম প্রবেশ করতে দেয়া হবে। রোজাদার ছাড়া আর কেউ উক্ত দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (Ñতিরমিজি শরীফ)
হজরত যায়েদ ইবনে খালেদ আলজুহানী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) আলাইহি ইরশাদ করেনÑ যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোজাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোজাদারের প্রতিদান হতে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।
(Ñতিরমিজি, হাদিস-৮০৭)
হজরত আবু হুরায়রা (রা:) হইতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকে আম্বরের সুগন্ধের চেয়েও অনেক উৎকৃষ্ট’। (Ñবুখারি শরীফ)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।