চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বাংলাদেশ। হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণ ও লালনকারী একটি দেশ। যে দেশের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি-স্বকীয়তা। আছে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য। সংস্কৃতি একটি জাতির পরিচয় বহন করে। সংস্কৃতি দিয়েই একটি জাতি অন্য জাতি থেকে আলাদা হয়। নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা একটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিক। গ্লোবালাইজেশনের এই সময়ে যে জাতির সংস্কৃতি যতটুকু স্বতন্ত্র, সে জাতি ঠিক ততটুকুই স্বাধীন। কেউ যদি একটি দেশের বা জাতির স্বাধীনতা ধ্বংস করে দিতে চায়, তাহলে আধুনিক এই যুগে সশস্র হামলার খুব বেশী প্রয়োজন নেই। যদি সেই জাতির স্বকীয়তা ও সংস্কৃতিতে বিজাতীয় ধ্বংসাত্মক অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তবে সেই জাতি এমনিতেই তাদের গোলামে পরিণত হবে।
কেননা, সংস্কৃতি একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে। একটি জাতির মানুষ যা করে, যেভাবে করে, যা দেখে, যেভাবে দেখে, যা চিন্তা করে, যেভাবে চিন্তা করে, যা পরে, যেভাবে পরে, সেটাই একটি জাতির সংস্কৃতি। যেমন ইংরেজ জাতি ও আমাদের সংস্কৃতিতে বিস্তর ফারাক। উদাহরণ সরূপ দুয়েকটি বলা যেতে পারে। যেমন ইংরেজদের সংস্কৃতিতে তাদের ড্রেস কোড হলো, কোর্ট-টাই, ব্লেজার ইত্যাদি। মদ্যপান হলো তাদের প্রধান পানীয়, তাদের আচার-অনুষ্ঠান কোনকিছুই শুরু করা হয় না যতক্ষণ না তারা শ্যাম্পেনের বোতলে গলা না ভেজায়। এদিকে এদেশের সংস্কৃতি হলো লুঙ্গি, শাড়ী ও টুপি পাঞ্জাবী। মদ্যপান এদেশের ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই পরিত্যাজ্য।
হাজার বছর ধরেই বাংলা মুসলমানদের একটি দেশ। তাই এ দেশের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে মুসলমানিত্ব ও ধর্মীয় আবেশে। এই বাংলার বেশীর ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলার সংস্কৃতিতে গৃহস্থের উৎসবগুলো অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে। সে উৎসবগুলো বাদ দিলে বাংলার ঐতিহ্য বলে কিছু থাকে না। মুসলমান হিসাবে এদেশের মানুষের প্রধান উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এবং ধর্মীয় আচারগুলোই হলো এদেশের প্রধান সংস্কৃতি।
৬০-৭০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর ও গৃহস্থ হওয়ায় গ্রামীণ উৎসবগুলোও এদেশের সংস্কৃতিতে স্বমহিমায় উজ্জল হয়ে আছে। আজ থেকে ১০ বৎসর পূর্বেও যে উৎসবগুলো ছিল এদেশের সংস্কৃতির প্রধান অনুসঙ্গ, ১০ বছরের ব্যবধানে এখনকার ছেলেমেয়েরা নামও হয়তো জানেনা। আন্তঃজালের এই সেবা আমাদের জন্য কতটুকু আশির্বাদ আর কতটুকু অভিশাপ তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। যে জাতির বিনোদন ছিল নবান্ন, পিঠা আর গ্রামীণ মেলার মতো উৎসব। যে জাতির জীবনে বছরের দুইটি ঈদ ছিল সবচেয়ে আকাক্সক্ষার দিন। সে জাতি আজ নিজেদের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে পালন করে বিদেশ থেকে আমদানি করা অপসংস্কৃতি।
আমরা দেখতে পাই দেশ ও ইসলাম বিরোধী কিছু নাস্তিকদের হাত ধরে এদেশে প্রবেশ করে ভ্যালেন্টাইনস ডে নামক চরিত্র ও ইমান বিধ্বংসী তথাকথিত পশ্চিমা কালচার। জাতি যখন ভালবাসা দিবস নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কোমার পর্যায়ে চলে গেছে তখন ইন্টারনেটের হাত ধরে এদেশে আমদানি হচ্ছে কিস ডে, রোজ ডে, প্রপোজ ডে, চকলেট ডে, টেডি ডে নাম সমূহের মতো জঘন্য সব নামের দিবস, যা শুধুমাত্র যৌন সুরসুরি নয়, সরাসরি যিনার আমন্ত্রন।
আজ ইউরোপ আমেরিকায় মায়ের পরিচয়ে সন্তানের পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু ইসলাম সন্তানকে বাবার পরিচয়ে পরিচিত করে। বংশ ধারা বাবার বংশের সাথেই নির্ধারিত করে। পশ্চিমা বিশ্বে মায়ের পরিচয়ে সব কাজ করতে হয়। কারণ অধিকাংশ ছেলে মেয়েই জানে না তাদের জন্মদাতা আসলে কে। আর সেই জন্মপরিচয়হীন জারজ কালচার মুসলমানের অভয়ারন্যে চালু করতে ৯০ দশকের শুরুর দিকে এক নাস্তিক তার বিদেশী প্রভুদের ছত্রছায়ায় এদেশে আমদানি করে ভালবাসা দিবস।
আমার পুতঃপবিত্র এই মাটিকে নষ্ট করার চক্রান্তে এই নাস্তিক গোষ্টি অনেক এগিয়ে গেছে। এই যে আমাদের চরিত্রের আজ অবক্ষয়, রাস্তা ঘাটে বেওয়ারিশ শিশু। কুকুর শিয়ালে টানাটানি করছে নাম পরিচয়হীন মানব সন্তান, তার সবকিছুই ভ্যালেন্টাইনস নামক ক্যান্সারের অবদান। বিলিভ ইট ওর নট। এটাই সত্যি যে, এদেশের টিনএজরা এই চরিত্র বিধ্বংসী তথাকথিত দিবসগুলো খুব ঘটা করেই পালন করছে আর গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে নিজের চরিত্র, ইমান ও সমাজ ধ্বংস করছে।
এগুলো ছাড়াও হাল আমলে এদেশে আরও কিছু দিবস পালন করা হচ্ছে। বন্ধু দিবস নামক একদিনে একজন আরেকজনের হাতে সুতা বেঁধে দেয় অন্য ধর্মের একটি অনুষ্ঠানের আদলে। ওই ধর্মে হাতে সুতা (রাখি) বেঁধে দেয়, কারণ তারা বিশ্বাস করে এই কাজটি করলে তাদের বন্ধন চিরদিন থাকবে। আর এটাই তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। তেমনিভাবে বন্ধুদিবসেও একই বিশ্বাস নিয়ে একে অন্যের হাতে সুতা বেঁধে দেয়। যা সরাসরি একটি শিরকী চিন্তা।
কয়েকবছর যাবত ‘রং খেলা’ নামক একটি খেলায় মুসলমান ছেলে-মেয়েদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করার মতো। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপকভাবে সেই অনুষ্ঠান পালন করছে। আবার কোনো কোনো স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য করা হচ্ছে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিছু কিছু জায়গায় শোনা গেছে যে স্কুলের গেইট বন্ধ করে দিয়ে জোরপূর্বক উক্ত খেলায় অংশগ্রহন করানো হচ্ছে। আরও উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা গেছে এই দিন আবার অন্য একটি ধর্মের ধর্মীয় উৎসব। সেই উৎসবেও রং দিয়ে রাঙ্গিয়ে দেয় একে অপরকে। সেটি তাদের ধর্মীয় উৎসব। ঠিক একই দিনে মুসলমান ছেলে মেয়েদের একই রকম অনুষ্ঠান পালন করা কি পরিকল্পিত না কাকতলীয় সেটি ভাবার বিষয়। আল্লাহর উপর বিশ্বাসস্থাপনকারী কোনো মানুষ এইসব অনুষ্ঠান, উৎসবে যোগ দিতে পারে না। তাই জাতিসত্বার দোহাই দিয়ে কৌশলে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের শিরকে লিপ্ত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না সেটা কে বলবে? এই বিজাতীয় কালচার আমাদের সংস্কৃতি কবে থেকে হলো তা খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবী।
ষড় ঋতুর এই বাংলাদেশে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন নিয়ে গ্রাম বাংলায় উৎসব পালন করা হতো। কিন্তু ইদানিং এই উৎসব আর গ্রামে গঞ্জে পালন করা হয় না। এই উৎসব এখন শহুরে উৎসব। বসন্তকে বরণ করার নামে এখন সমাজে বেহায়াপনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে আমাদের ভাষার মাস, শোকের মাস ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ মেলামেশা আর অবৈধ সম্পর্কের প্রধান মাস হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে। এখন ফেব্রুয়ারি আর শোকের মাস নেই। ফেব্রুয়ারি এখন যৌনতা আর রুচিহীন সংস্কৃতির মাস।
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য উৎসব নবান্ন, পিঠা উৎসব এখন আর আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি বলে মনেই হয় না। বাঙ্গালী জাতি স্লোগানের ধোয়া তুলে বৈশাখি উৎসব নামে মুসলমানদের এখন সরাসরি মূর্তিপূজায় অংশগ্রহন করানো হচ্ছে। বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম, অজপাঁড়া থেকে শহুরে অট্টালিকা, কোথাও এখন আর হিন্দি গানের ডিজে ছাড়া অনুষ্ঠান আশা করা যায় না। সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠানেও এখন বিজাতীয় অশ্লিল গানের সাথে ছেলে-মেয়েদের নৃত্য যেন বাধ্যতামূলক। যুবসমাজ মেতে আছে বলিউড নিয়ে। যারা বুঁদ হয়ে থাকে আনুশকা, ক্যাটরিনা আর অরজিত সিংদের নিয়ে। ঘরের মা-মেয়েরা আছে স্টার জলসা, জি বাংলা আর স্টার প্লাসের কূটনামী, পরকীয়া আর চরিত্র বিধ্বংসী সব সিরিয়াল নিয়ে।
যেখানে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে একত্রে বাবা ছেলে দুই বোন কে বিয়ে করার মতো জঘন্য কাহিনী। প্রমোট করা হচ্ছে লিভ টুগেদার নামে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে। পৃথিবী না চেনা শিশুরা মা বাবাকে চেনার আগেই ডোরিমন আর মুটো পাতলুকে চিনে ফেলে। মা-বাবা ডাকা শেখার আগে হিন্দি ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারে। আমাদের ধর্মীয় উৎসবেও এখন ভিনদেশী সংস্কৃতির অপচ্ছায়া। ঈদে এখন অন্য দেশের লেহেঙ্গা, কিরণমালা বা পাখি ড্রেস না হলে চলে না। কোনো কোনো জায়গায় নাকি সেইসব ড্রেসের জন্য আত্মহত্যাও করার খবরও মিডিয়ায় আসে। জামা-কাপড় না পরে থাকা এ্যক্টরের নামে ড্রেসের নামকরণ করা হয়। আমাদের মেয়েরা আবার সেইসব ড্রেস ছাড়া ঈদ উদযাপনই করতে পারে না।
যেখানে আমাদের সংস্কৃতি বছরে দুইটি ঈদ ছাড়াও ছিল শবে বরাত-শবে কদরে রাত জেগে ইবাদত করা। রমজান মাসে সবাই মিলে সেহরি-ইফতার করা। শুক্রবারদিন জুমার নামাযে সবার মনে ঈদের আনন্দ বিরাজ করা। গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ-মাহফিল। সেই মাহফিল উপলক্ষে আগে পরে সাতদিন গ্রামীণ মেলা ছিল আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। সেখানে মঙ্গল প্রদীপ, তীলক-ঢোলক, হোলি আর রাখি বন্ধন কোত্থেকে এলো? কেন এলো? কেন একটি স্বাধীন জাতিকে মননে-মস্তিষ্কে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে?
মোহাম্মদী চেতনা-আদর্শে বেড়ে উঠা এদেশের সংস্কৃতিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির এই নগ্ন আগ্রাসন কেন? কেন আমাদের সংস্কৃতিতে শিরকী অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল? কারা আমাদের সহজ সরল মুসলমানদের মুশরেক বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে, আর কারা নর্দমা সংস্কৃতির নীল বিষ এই সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে? এসব কিসের আলামত, তা যদি এখনই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তাহলে সেইদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন আমরা আমাদের স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে ভিনদেশী হয়ে যাবো। পতাকা থাকবে কিন্তু স্বাধীনতা থাকবে না। অবয়ব মুসলমানের থাকলেও ঈমান আকীদায় মুসলমানের চিহ্নও থাকবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।