Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সোলাইমানি হত্যা এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার এজেন্ডা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম

যুদ্ধ, গণহত্যাসহ কোটি মানুষকে চরম ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দেশে দেশে কিছু দল, গোষ্ঠি ও ব্যক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের নির্মম তৎপরতা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। বাগদাদ বিমান বন্দরে আততায়ী ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের জাতীয় বীর, কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ পরিস্থিতিকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন সময় তিনি এ কাজটি করলেন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার দ্বারপ্রান্তে। নিজের ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং চলতি বছরে অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি হিসেবে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির প্রয়োজনে ট্রাম্প ইরানের সামরিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুলাইমানিকে হত্যার মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও উস্কানিমূলক কাজের নির্দেশ দিয়েছেন বলে কোনো কোনো পশ্চিমা সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। কিছু মানুষের স্বভাবই এমন যে, তারা শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা ভাবতে পারে না। জাতিগত ও বর্ণবাদী ঘৃণা, অহঙ্কার, যুদ্ধংদেহী ঔদ্ধত্ব ও নির্মম পাশবিকতাই যেন তাদের এগিয়ে চলার পাথেয়। ২০১২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনের মুখোমুখী হতে যাচ্ছিলেন, তখনো ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা চলছিল, বারাক ওবামাও ডিপ্লোম্যাটিক ভাষায় ইরানকে হুমকি দিচ্ছিলেন। তারই পেক্ষাপটে সে সময় ভবিষ্যতের রিপাবলিকান ক্যান্ডিডেট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য ওবামা ইরানে হামলা করতে চলেছেন। তবে ট্রাম্পের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়নি। ওবামা ইরানে হামলা না করেই খুব সহজেই দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা পারমাণবিক প্রকল্পকে ঘিরে ইরানের সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার উত্তেজনা নিরসন ও সমঝোতায় উপনীত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি, উত্তেজনা কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্বদেশের দিকে অধিক মনোযোগ নিবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান সামনে রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ট্রাম্প একের পর এক পুরনো মার্কিন চুক্তি, নীতি ও শর্তগুলো লঙ্ঘন করতে থাকেন। ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ(টিপিপি) চুক্তি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি এবং ফিলিস্তিনি শান্তি প্রক্রিয়া এবং জেরুজালেমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সনদ থেকে সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব ও আস্থার জায়গা থেকে বিচ্যুত করেছেন। প্রায় ৬ দশক ধরে বিবদমান ও বিতর্কিত পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদিচ্ছা ও ভাবাবেগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এমন সময় তিনি এসব অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন, যখন ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী ও তাদের প্রক্সি গ্রুপগুলোকে পরাজিত হয়ে অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হচ্ছিল। আর মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বাহিনী ও প্রক্সি গ্রুপগুলোর পরাজিত করার পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের মূল কারিগর ছিলেন ইরানের বিপ্লবী গার্ড ফোর্সের অন্যতম এলিট বাহিনী কুদ্স ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সুলাইমানি।

খ্রিস্টীয় নববর্ষ ২০২০ সালের দ্বিতীয় দিন ২ জানুয়ারি বাগদাদ বিমান বন্দরের কাছে ড্রোন হামলায় সুলাইমানি এবং ইরাকের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের দ্বিতীয় কমান্ডার মুহান্দিসসহ অন্তত ৮ জন নিহত হওয়ার পর পেন্টাগনের তরফ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হামলার দায় স্বীকার করলেও এই হামলার বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ইরানি সামরিক বিশ্লেষকরা হামলার সাথে মার্কিনি ও ইসরাইলি জায়নবাদী সামরিক বাহিনীর প্রতি আঙ্গুল তুলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীল নকশাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বলয় গড়ে উঠার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাত্রদাহের মূল কারণই হচ্ছে তাদের পারপিচুয়াল পার্টনার অথবা সাম্রাজ্যবাদী লাঠিয়াল ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকি। কোনো যুদ্ধ-সংঘাতের ময়দানে বিমান হামলা চালিয়ে সুলাইমানিকে হত্যা করা হয়নি। ড্রোন হামলায় সুলাইমানি নিহত হওয়ার পর প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই হত্যাকান্ডকে ‘অ্যাসাসিনেশন’ বলে উল্লেখ করে। কোনো বাহিনী প্রতিপক্ষ বাহিনীর সাথে কনভেনশনাল ওয়ারে ব্যর্থ হয় এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লেই তারা প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামরিক ও অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিদের অ্যাসাসিনেশন বা টার্গেটেড কিলিংয়েয় আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের মোসাদ সারাবিশ্বে নোটরিয়াস বা কুখ্যাতি অর্জন করেছে। গত ৫ দশকে ইসরাইলের মোসাদ ও আইডিএফ ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, ইরান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কমান্ডার, গোয়েন্দা, বিজ্ঞানী ও অ্যাকাডেমিসিয়ানকে অ্যাসাসিন বা টার্গেটেড কিলিং করেছে। মুসলমান ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্ট ডিনায়াল এবং এন্টিসেমিটিজমের অভিযোগ তুলে বহু পশ্চিমা নাগরিককেও হত্যা করেছে মোসাদ। এবার কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার দায় নেয়ার মতো ঝুঁকি ইসরাইল নিতে চায়নি বলেই কি পেন্টাগন এই হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করল? তবে সুলাইমানি হত্যাকান্ডের পর বিশ্বের কোনো শক্তিই সরাসরি এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন করেনি। সকলেই সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতারাও বিভক্ত মত দিয়েছেন। হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটররা ট্রাম্প সারাবিশ্বে মার্কিন নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন। কংগ্রেসকে অন্ধকারে রেখে অন্যদেশে সামরিক হামলার সিদ্ধান্তকে মার্কিন আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইরাক থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সুলাইমানি হত্যাকান্ডের একদিন পর বাগদাদে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কাছে রকেট হামলায় হতাহতের খবর পাওয়া যায়। তবে একমাত্র ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বাগদাদে ড্রোন হামলা করে কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নেতানিয়াহুর এই প্রতিক্রিয়া দেখে সুলাইমানি হত্যায় ইসরাইলের সম্পৃক্ততার বিষয়টিকে যেন আরো স্পষ্ট করে তোলে। অন্যদিকে মার্কিন ডেমোক্রেট নেতা ও সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট নমিনি বার্নি সেন্ডার্স তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ১৭ বছর আগে ইরাক যুদ্ধের আগেও আমি যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলাম। এখন মধ্যপ্রাচ্যে যে নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে আবারো অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটবে, আরো লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হবে এবং আরো ট্রিলিয়ন ডলারের গচ্চা যাবে। এ অবস্থা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে।

চলমান বিশ্ব বাস্তবতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যেন মানিকজোড়। ইসরাইলের সব অপকর্মের প্রধান ইন্ধন এবং রসদদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অভিসারের যেন মূর্ত প্রতীক এই দুই নেতা। দুই জনই নিজ নিজ দেশে চরম ভরাডুবি ও অপমানজনক বিদায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন মারাত্মক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে। সুলাইমানি হত্যাকান্ডকে সামনে রেখে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইমপিচমেন্ট, দুর্নীতির অভিযোগের বিচার এবং নির্বাচনে উৎরে যাওয়ার যে পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে তাতে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর শেষ রক্ষা নাও হতে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে ৮ বছর আগে ওবামার নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মার্কিন বিশ্লেষক অ্যারন বেøইক। সে সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনে জিততে ওবামা ইরানে হামলা চালাতে চায়। ট্রাম্পের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর দুই অংশই মিথ্যা প্রমাণীত হয়েছিল, প্রথমত ওবামা ইরানে হামলা চালাননি, দ্বিতীয়ত ওবামা আগের চেয়েও বড় ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে জেতার পর ওবামা মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যাগুলোর নিরসনে কাজ করেছেন। বিশেষত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং ইরানের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ঘটনাকে ইসরাইল কখনো মেনে নিতে পারেনি। অতঃপর আইএস মোকাবেলা, সিরিয়া ও ইরাকসহ আঞ্চলিক বিরোধ মোকাবেলা এবং পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে ইরানের কুদস ফোর্সের অগ্রযাত্রা ইসরাইলিদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ইরানিদের সমর্থন নিয়ে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইয়েমেনে পশ্চিমাদের প্রক্সি বাহিনীকে পরাস্ত করা ছাড়াও গত এক দশকে পর পর দুইবার হেজবুল্লাহ ও হামাসের কাছে ইসরাইলি বাহিনীর অভাবনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সব হিসাব নিকাশ ওলটপালট হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের শাসকদের এই মুহূর্তে যে সঙ্কট তা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক সঙ্কট। এই সংকট কাটাতে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়ে ইরানের সাথে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের যে ফর্মুলা গ্রহণ করেছে তাতে শুধু দুই রাজনৈতিক নেতার ভবিষ্যত এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকা হচ্ছে কি না তাই দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইরানের নীতি ও শক্তিতে তেমন কোনো পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই। কাসেম সুলাইমানি ইরানের আঞ্চলিক সামরিক শক্তির যে ভিত্তি গড়ে তুলেছেন তার উপর দাঁড়িয়ে যে কোনো শক্তিকে মোকাবেলা করা সম্ভব। সুলাইমানি হত্যার দুই দিনের মধ্যেই ইরাক থেকে সব মার্কিনিদের চলে যাওয়ার নির্দেশ খোদ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকেই ঘোষণা করা হয়েছে। এর দুইদিনের মাথায় ইরাকের পার্লামেন্ট ইরাক থেকে সব বিদেশি বাহিনীকে চলে যাওয়ার রেজুলেশ্যন পাস করেছে। এর মানে হচ্ছে, ২০০৩ সালের পর সুলাইমানি হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যেই ইরাকে মার্কিনিদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। আল কুদস বাহিনীর নতুন কমান্ডার ইসমাইল কায়ানি দীর্ঘদিন সুলাইমানির ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি নিঃসন্দেহে সুলাইমানির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলবেন। সুলাইমানিসহ নিহতদের প্রতি ইরান ও ইরাকিদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে লাখো মানুষের ঢল, ইরানের শীর্ষ নেতার চরম প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি এবং কারবালা, তেহরান, মাশাদ, কোম, কেরমান শহরের রাজপথে লাখো কণ্ঠে সেই ঘোষণার দৃপ্ত প্রতিধ্বনি থেকে শুরু করে ট্রাম্পের হুমকির কড়া জবাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে ইরানের অবস্থান অনমনীয়। তারা ইতোমধ্যে ২০১৫ সালের পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিতে অকার্যকর ঘোষণা করে আনলিমিটেড মাত্রায় পরমাণু পরিশোধন শুরুর ঘোষণা দিয়েছে।

প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পরাজয়, ভাঙ্গন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রথম পর্ব শুরু হলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইহুদি জায়নবাদীদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের গঠনই ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরম ধাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির সাথে রাশিয়ার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের ফলাফল অবধারিতভাবে মিত্রশক্তির অনুকূলে চলে যাওয়ার ফলে আগামী বিশ্বের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ঠিক করতে উড্রো উইলসন ও উইনস্টিন চার্চিলরা যে নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার গাইডলাইন তৈরি করেছিলেন তাতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সাথে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংঘাত পারমাণবিক স্নায়যুদ্ধে রূপ নেয়। সর্বগ্রাসী পুঁজিতন্ত্রকে মোকাবেলা করার সামর্থ্যের দুর্বলতার কারণেই মাত্র ৭০ বছরের মধ্যে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তবে সোভিয়েত নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওয়ারশ’ সামরিক জোট ও পারমাণবিক জুজু নির্ভর পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট আসন্ন দেখে তাদের জন্য নতুন জুজু সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই বৃটিশ ও ফরাসি কূটনীতিকরা (সাইকস-পাইকট এগ্রিমেন্ট) রাশিয়া ও ইতালিকে আস্থায় রেখে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগি ও উপনিবেশিক দখলদারিত্ব নিশ্চিত করায় মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে পারেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় পশ্চিমাদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব খর্ব করে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। সে বিপ্লবে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি সরাসরি আক্রান্ত হয়। রেভ্যুলেশনারি ছাত্র-জনতা ইঙ্গ-মার্কিন পুতুল সম্রাট রেজা শাহের পতনের সাথে সাথে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে মার্কিন কূটনীতিকদের দীর্ঘদিন আটকে রাখে। সেই থেকেই ইরানের বিপ্লবী সরকার এবং রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনী মার্কিনি ও ইসরাইলিদের অন্যতম টার্গেট। আফগানিস্থানে দখলদারিত্ব চালিয়ে প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলেও আট বছর ধরে ইরান-ইরাক যুদ্ধসহ ইরানে রিজিম পরিবর্তন এবং বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়ার কোনো চাপ ও ষড়যন্ত্রই সফল হয়নি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে এক ধরনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পুনর্জাগণের সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পশ্চিমা দুনিয়ায় মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে মার্কিন গবেষক উইলিয়াম পি. হান্টিংটন দ্য আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা করতে গিয়ে ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন বা সভ্যতার দ্ব›েদ্বর ত্বাত্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। সেখানে বিশ্বকে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই বিভাজন রেখায় প্রথম টার্গেট হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা। প্রথম গাল্ফ ওয়ার এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে শুরু হওয়া অন্তহীন যুদ্ধে ইতোমধ্যে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ ও বলকানাইজ করে তোলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ভাবধারা গড়ে ওঠার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখা এবং জরবদখল করে গড়ে তোলা ইজরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জেরুজালেমের উপর জায়নবাদী আধিপত্য কায়েম রাখাই অন্তহীন যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যকে পূর্ণতা দিতে হলে ইরানে রিজিম চেঞ্জ ও ডি-স্ট্যাবিলাইজেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। জায়নবাদী ইহুদিদের পরিকল্পিত ইলিউমিনাতি এজেন্ডা-২১ বা ২০৩০ সালের মধ্যে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা বাস্তবায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বড় ধরনের ঝুঁকি সত্তে¡ও ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। জেরুজালেমকে ফার্সিতে কুদস বলা হয়। জেরুজালেমের উপর মুসলমানদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে কুদস ফোর্সের প্রধান লক্ষ্য। কুদস ফোর্স ও ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রায় ইসরাইলের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসী লক্ষ্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ায় জায়নবাদী ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার পুঁজিবাদী সামরিক সাম্রাজ্যবাদও চরম হুমকির মুখে পড়েছে। চরম বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গদিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্তি এবং আগামী নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসার রাস্তা তৈরি করতেই ইরানে হামলা চালিয়ে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে। আমেরিকার ন্যাটো মিত্ররা ট্রাম্পের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলেও ইরানের মিত্র রাশিয়া, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভূমিকা আগামী বিশ্ব ব্যবস্থার মূল এজেন্ডা নির্ধারণ করবে।
[email protected]



 

Show all comments
  • নীল ৮ জানুয়ারি, ২০২০, ২:২৩ এএম says : 0
    ইরান-মার্কিন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সৌদিআরব, আরব আমিরাত, ইসরাঈল, সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন,রাশিয়া
    Total Reply(0) Reply
  • Asad Nazib ৮ জানুয়ারি, ২০২০, ২:২৩ এএম says : 0
    ট্র্যাম্পের উন্মাদ আগ্রাসন থামিয়ে দেয়া হউক।
    Total Reply(0) Reply
  • জান্নাতুল নাঈম মনি ৮ জানুয়ারি, ২০২০, ২:৩৩ এএম says : 0
    আল্লাহই ভালো জানেন মুসলমানদের কপালে কি আছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন