Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুবান্ধব বিচার ব্যবস্থা জরুরি

পারভীন রেজা | প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম

দেশে অনেক শিশু ও কিশোর চুরি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও কেনাবেচা, খুন, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক ও অস্ত্র পাচার, ইভ টিজিং ইত্যাদি ধরনের বিভিন্ন দন্ডনীয় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে এসব শিশু-কিশোরদের জন্য কোনো একক শিশুবান্ধব বিচার ব্যবস্থা নেই। শিশুদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইন হলো শিশু আইন ১৯৭৪ ও শিশু বিধি ১৯৭৬। এ আইনগুলো আর্ন্তজাতিক মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য নয়। এমনকি ১৯৭৪ সালের শিশু আইন দ্বারা শিশু-কিশোরদের ‘কিশোর আদালতে’ বিচার করা হচ্ছে না। দেশের বেশিরভাগ আদালতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অধীনে বড়দের সাথে তাদের বিচার হচ্ছে। বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ না করে শিশু আইনের সাথে সাংঘর্ষিক আইন (বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, ভবঘুরে আইন ১৯৪৩ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা) অনুযায়ী এদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শিশু ও কিশোরদের বিচারসহ স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিপূর্ণ কোনো আইন নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মঙ্গলের বিষয়টি বিবেচনায় না এনে এবং কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে তাদেরকে কারাগারে আটক রাখা হচ্ছে। পৃথক আইন ও আদালতে শিশু আইনের অধীনে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু-কিশোররা। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের শৈশব, কৈশর, এবং স্বাভাবিক সুস্থ জীবন।

আমাদের দেশে শিশু আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী ৩টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র যথা- টঙ্গী, কোনাবাড়ী ও যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ৩টি কিশোর আদালত আছে। তবে টঙ্গী ও যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ‘কিশোর আদালত’ শুধুমাত্র ছেলে শিশুদের জন্য। সারাদেশের মেয়ে শিশুদের বিচারের জন্য কোনাবাড়ি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে একটি মাত্র ‘কিশোরী আদালত’ রয়েছে যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। একজন প্রথম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যজিস্ট্রেট, আদালত কর্মকর্তা, এবং অন্যান্য স্টাফ নিয়ে এই আদালত গঠিত। অন্য আরেকটি সমস্যা হলো, কিশোর আদালতসমূহের বিচারক পদটি স্থায়ী হলেও বিচারক স্থায়ী নয়। সংশি¬ষ্ট জেলার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কিশোর আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সপ্তাহে সাধারণত একদিন বা দুইদিন বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত উক্ত আদালত বসে। এছাড়া কিশোর আদালতের এলাকাভিত্তিক এখতিয়ার জেলার মধ্যে সীমিত। ১৯৯৯ সালের গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট -এই তিনটি বিভাগ টঙ্গী কিশোর আদালতের অর্ন্তভুক্ত এবং খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল- এই তিনটি বিভাগ যশোর কিশোর আদালতের অর্ন্তভূক্ত। অর্থাৎ ভৌগলিক বন্টন অনুযায়ী প্রতি তিনটি বিভাগের জন্য একটি করে কিশোর আদালত রয়েছে। দূরত্বের কারণে এ আদালত ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত শিশু-কিশোরদের আদালতে উপস্থাপন ও সাক্ষী উপস্থাপন করাসহ নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

শিশু আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টসহ ৬৪ জেলার ৬৪টি দায়রা আদালত, জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট আদালত, চীফ জুডিশিয়াল মেট্রোপলিটন আদালত কিশোর আদালত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। দেশে প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতসহ অন্যান্য সকল আদালত শিশু বিষয়ক মামলা পরিচালনার সময় কিশোর আদালত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সব জেলায় সঠিকভাবে এটি পালন করা হয় না। প্রতি জেলায় শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের সব ধরনের মামলা পরিচালনার জন্য পৃথক কোনো কিশোর আদালত না থাকায় অপরাধ সংঘটনের স্থানে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় শিশু-কিশোরদের বড়দের সাথে বিচার হচ্ছে। বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর প্রায় ৩ বছরেও কোনো আদালতকে শিশু আইনের আলোকে ‘কিশোর আদালত’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়নি।

গ্রেপ্তারের পর থেকে শিশু-কিশোদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কোনো শিশুকে গ্রেফতার করার সময় শিশুটির বয়স লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ফরমে নির্দিষ্ট করে বয়স লিপিবদ্ধ করার পৃথক কোনো ঘর থাকে না। ফলে পুলিশ অফিসারদের শিশুর নামের পাশে বয়স লিখতে হয়। শিশুর বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরে এখনো পুরোনো ফরম প্রচলিত থাকায় বয়স সংক্রান্ত বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে, আমাদের দেশে জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রচলনে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। এছাড়াও বিভিন্ন আইনে শিশুর বিভিন্ন বয়স উলে¬খ থাকায় অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুর বয়স নির্ধারণে পুলিশ অফিসারদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে প্রায় অনেক মামলায় নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী এড়িয়ে চলার জন্য শিশুটির বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার নজির দেখা যায়। ফলে বেশিরভাগ সময় শিশুদের কারাগারে আটক থাকতে হয়।

শিশু-কিশোরদের অপরাধের বিচার কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অপরাধের কারণ ও ধরন এবং তাদের অধিকার, মানবিক মর্যাদা, সংশোধণের সুযোগ ও অন্যান্য কল্যাণকর দিকগুলো আইন মোতাবেক অবশ্যই বিবেচনা করা প্রয়োজন। শিশু আইনের ১৫ ধারায় বর্ণিত আছে আদালত কর্তৃক আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে: (ক) শিশুর চরিত্র ও বয়স (খ) শিশুর জীবন ধারণের পরিবেশ (গ) প্রবেশন অফিসার কর্তৃক প্রণীত রিপোর্ট এবং (ঘ) শিশুটির স্বার্থে যে সকল বিষয় বিবেচনা করবে বলে আদালত মনে করেন সে সকল বিষয়। আইনের সংস্পর্শে জড়িত শিশু-কিশোরদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আদালতকে অবশ্যই এ ধারায় বর্ণিত বিষয়সমূহকে বিবেচনায় আনতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালত শিশু ও কিশোরদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রবেশন অফিসারের রির্পোটের ভিত্তিতে না নিয়ে পুলিশ অফিসারের রির্পোটের ভিত্তিতে নিয়ে থাকেন। এসব আদালতে শিশু ও কিশোরকে পরিণত মানুষের মতোই ভাবা হয় এবং তাদের বিচার সেভাবেই করা হয়ে থাকে। তাছাড়া একই আদালতে বড়দের ও শিশুদের ভিন্ন মানসিকতায় বিচার করার বিষয়টি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে শিশু-কিশোরদের বিচার নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পাদিত হয় না।

বিচারাধীন অবস্থায় শিশু-কিশোরদের মুক্ত করার একমাত্র ব্যবস্থা হচ্ছে জামিন। এ বিষয়ে শিশু আইনের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধির চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭(১) ধারা অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচের বয়সী শিশু-কিশোরদের আদালত জামিন দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন। কিন্তু শিশু আইনের ৪৮ ধারা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারকে জামিনের ক্ষমতা দিয়েছে। এই ধারার প্রয়োগে গ্রেপ্তার হওয়ার সাথে সাথেই অনেক শিশু ও কিশোর সহজেই মুক্ত হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, জামিনে শিশু-কিশোরদের মুক্ত করার ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রয়োগ না করে বরং তাদেরকে প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন- যে শিশু-কিশোররা আইন ভঙ্গ করে তাদের কারাগারে বা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কিছু শিশু-কিশোরকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রে কারা আইন, ১৮৯৪ এর ২৭ ধারা অনুযায়ী ১৬ বছরের কম বয়সীদের বড়দের থেকে পৃথক রাখার ব্যবস্থাও মেনে চলা হয় না। ফলে শিশুরা কারাগারে থেকে ভাল হওয়ার চেয়ে পেশাদার অপরাধীদের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে তারা বড় অপরাধী হয়ে উঠে এবং তাদের মানসিক বিকাশও প্রতিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

শিশু-কিশোরদের আইনগত ব্যবস্থার মূল কথা হচ্ছে, তাদেরকে সংশোধন করে সুশীল নাগরিক হিসেবে পরিবারে এবং সমাজে পুন:প্রতিষ্ঠা করা। এদের অপরাধ সামাজিক উপায়ে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি বড়দের থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে শিশু আইনের ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে প্রচলিত কিশোর আদালত ও ফৌজদারি আদালত কোনো ব্যবস্থাতেই শিশু-কিশোরদের সুরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অসংখ্য শিশু-কিশোর ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। তাই যত দ্রæত সম্ভব আগামীর ভবিষ্যৎ এই শিশু-কিশোরদের সুরক্ষা, তত্ত¡াবধান ও সংশোধনের জন্য প্রতিটি জেলায় পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে একটি করে কিশোর আদালত প্রতিষ্ঠা করা বা সাধারণ আদালতে সম্পূর্ণ পৃথক মনোভাব নিয়ে শিশু বান্ধব পরিবেশে শিশুদের বিচার সুনিশ্চিত করা আবশ্যক। আটকাবস্থাকে সর্বশেষ পন্থা এবং যথাসম্ভব স্বল্পতম মেয়াদের জন্য প্রয়োগ করার পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থায় শিশু-কিশোরদের সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া শিশু-কিশোর গ্রেফতার হলে, তদন্তকালীন, বিচারাধীনকালে, আটকাবস্থায়, রায় প্রাপ্তিতে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। শিশু-কিশোর অপরাধীদের পরিসংখ্যান রাখা এবং পর্যবেক্ষণেরও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তবেই ভবিষ্যতে অপরাধ বাড়ছে না কমছে, তা হিসাব করে পরবর্তী বিকল্প কর্মসূচী নেওয়া সহজ হবে। মূলত: দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক উভয় আইনেই সকল অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী শিশু-কিশোররা যেন হতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা, শিশু আইন ১৯৭৪ এর সংশোধিত শিশু আইন (খসড়া) ২০১০ তৈরী হয়েছে। আইনটি শিশু-কিশোরদের সবোর্চ্চ স্বার্থ রক্ষায় শিশুবান্ধব বিচার ব্যবস্থার সূত্রপাত করুক, আংশিক নয়; পুরোপুরি- এটিই কাম্য।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন