প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
বন্দর শিপিং খাত। দারুন সুসময় অতিবাহিত করছে। অর্জন অনেক। কখনও সরবে। কখনও নীরবে। ‘অর্জন’ এখন অবধি অধরাও রয়ে গেছে অনেক। বন্দর শিপিংয়ে সরকারি উদ্যোগের সাফল্য আছেই। তারচেয়ে বেশি দৌঁড় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো উদ্যোগে সাধারণত বড় বাধা ও জট তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালকে ঘিরে। অন্যদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ সেদিক থেকে মুক্ত। তবে নিজেরা ‘মুক্ত’ হলেও আমলাতান্ত্রিক দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বিড়ম্বনার তারা কমবেশি শিকার এতে কারও সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, খাত-উপখাতে অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও অর্জনের ভেতরে সামনের কাতারে অবস্থান করে নিয়েছে সমুদ্রবন্দর, শিপিং সেক্টর। এই খাতে বলতে গেলে সুদিন। তেমনি সম্মুখে রয়েছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অনেক ধরনের দিক। পোর্ট-শিপিং সার্কেলের অভিজ্ঞজনেরা জানান, আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ হয়ে সক্ষমতা ও দক্ষতায় এগিয়ে চলাই এই খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যেমন-দীর্ঘদিনে প্রত্যাশা পূরণ করে বন্দর-শিপিং-কাস্টমসের স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন এখনও হয়নি। যা হওয়া অপরিহার্য। তাছাড়া আমদানি-রফতানি অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমাগত চাপ ও চাহিদা সামাল দেয়ার লক্ষ্যে বন্দর-শিপিং-কাস্টমসের অবকাঠামো, যান্ত্রিক, কারিগরি সুযোগ-সুবিধার অভাব পরিপূরণ এবং জনবলের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা যথাযথ মানে উন্নীত করা জরুরি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সামগ্রিকভাবে বন্দর-শিপিংয়ের যুগোপযোগী আধুনিকায়ন এবং বর্তমান সীমিত অবকাঠামো সুবিধাসমূহ প্রসার কিংবা সম্প্রসারণের এখনই উপযুক্ত সময়। সরকারি খাতের শিপিং প্রতিষ্ঠান শিপিং বিভাগ, নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে (বিএসসি) মান্ধাতা আমলের ‘ঢিমেতালে চলো’ অবস্থা থেকে উত্তরণ চাই। এরজন্য আমূল ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
বিএসসির জন্য বাণিজ্যিকভাবে নিশ্চিত লাভজনক ও উপযুক্ত প্রযুক্তি মানসম্পন্ন জাহাজ-ট্যাংকার সংগ্রহ করতে হবে। এ ধরনের সমস্যা-সীমাবদ্ধতা অতিক্রম নিশ্চিত করা গেলে বন্দর-শিপিং সেক্টরে আছে অপার সুযোগ-সম্ভাবনার হাতছানি। আর এরজন্য প্রয়োজন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি এবং সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার।
দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এ মুহূর্তে সুনামের স্বীকৃতি নিয়ে একটি কর্মচঞ্চল আন্তর্জাতিক বন্দর। চট্টগ্রামে আজ কন্টেইনার বন্দর। যা ১৯৭৬ সালে ৬টি মাত্র কন্টেইনার হ্যান্ডলিং দিয়ে সূচনা। আমদানি-রফতানিমুখী পণ্যসামগ্রী উঠানামায় ব্যস্ততা এখন বছরজুড়ে। প্রতিটি টার্মিনাল, জেটি বার্থ, ইয়ার্ড-শেড, অফডক, পরিবহন অবকাঠামোর স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই হিমশিম অবস্থায় পড়ছে বন্দর-শিপিং-পরিবহন সেক্টর।
এতোসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও বন্দর-শিপিং সেক্টরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে বার্ষিক ৯ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ঘটছে, যা ধারাবাহিক এবং বিস্ময়করও বটে। বন্দর-শিপিং খাত উপখাতসমূহের সামগ্রিক কর্মকা-ের মধ্যদিয়ে বার্ষিক প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের জোগান আসছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের থিম অর্থাৎ অগ্রযাত্রার প্রতিপাদ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার- চট্টগ্রাম বন্দর’। ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। এটিকে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির হৃৎপি-। চট্টগ্রাম হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় হাজার বছরের নিরাপদ পোতাশ্রয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে প্রায় দেড়শ’ বছরের পথচলা। শতরকম সমস্যা-সীমাবদ্ধতার মাঝেও বিদায়ী ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রযাত্রায় অর্জিত সাফল্যের পালকে নতুন এবং স্মরণীয় সংযোজন হাতের মুঠোয় আনতে সক্ষম হয়েছে।
‘থ্রি মিলিয়নিয়ারস ক্লাব’র গর্বিত মেম্বার আজ চট্টগ্রাম বন্দর। ৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার সক্ষমতা সম্পন্ন সমুদ্রবন্দর-শিপিংয়ের মর্যাদাপূর্ণ ‘ক্লাবে’ চট্টগ্রাম নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ২০১৯ পঞ্জিকা বছর যখন শেষ তখন চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি ও রফতানিমুখী কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমান ৩০ লাখেরও বেশি। বিশে^ তিন মিলিয়ন কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করছে এ ধরনের শীর্ষ ৬০টি সমুদ্র বন্দরের অন্যতম চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশের সমগ্র আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৮৫ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাফল্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরেকটি স্বীকৃতি। বার্ষিক কন্টেইনার পরিবহনের পরিমানগত সক্ষমতায় চট্টগ্রাম বন্দর বৈশি^ক ক্রম তালিকায় সুনাম অর্জনের পাশাপাশি উন্নতির ধাপে আরও এগিয়েছে। গত আগস্ট’১৯ইং মাসে লন্ডনভিত্তিক শিপিং সেক্টর বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবাদমাধ্যম ‘লয়েডস লিস্ট’-এ প্রকাশিত তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ১০০টি কর্মব্যস্ত বন্দরের কাতারে ৬৪ তম বন্দর হিসেবে সুনামের আসন অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
এক্ষেত্রে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ছয়টি ধাপ অতিক্রম করে গেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১৮ সালে বিশ্বের বন্দরসমূহের কন্টেইনার পরিবহনের সংখ্যা বা পরিমানগত হিসাবের ভিত্তিতে লয়েডসলিস্ট প্রণীত হয়। লয়েডসলিস্টে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৭০তম। ২০১৬ সালে ছিল ৭১তম।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২০ ডিসেম্বর’১৯ইং পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে ৩০ লাখ ২ হাজার ৪২ ইউনিট কন্টেইনার হ্যান্ডেল করা হয়। আগের বছর ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ২৯ লাখ ৩ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে। ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার, ২০১৬ সালে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবহারকারীগণ বলছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন, টার্মিনাল ও ইয়ার্ডসহ কিছু অবকাঠামো সুবিধা বৃদ্ধি, সুষ্ঠু তদারকি ও সমন্বয়, শ্রম পরিবেশের উন্নতি ও শৃঙ্খলা, জাহাজের গড় অবস্থানকাল আগের তুলনায় হ্রাস পাওয়া, ব্যবস্থাপনায় উন্নতিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকা-ে উত্তরোত্তর সাফল্য আসছে।
তবে সময়ের প্রয়োজনে কর্ণফুলী নদীর ওপারে বন্দর সুবিধার সদ্ব্যবহার ও সম্প্রসারণ, বে-টার্মিনাল নির্মাণ, পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন, ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ, নতুন নতুন জেটি-বার্থ, টার্মিনাল নির্মাণসহ বন্দরের চলমান এবং প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ অতিদ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তাহলে প্রধান এই সমুদ্রবন্দর দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের চাপ বা চাহিদা সামাল দিয়ে অগ্রসর হতে সক্ষম হবে। অন্যথায় অবকাঠামোর অভাব কিংবা ঘাটতির কারণে হোঁচট খেয়ে প্রত্যাশিত গতিশীলতা হারাবে।
আঙ্কটাড শিপিং কনভেনশনস, রুলস ও সুপারিশমালা অনুসারে, পৃথিবীর কোনো সমুদ্র বন্দরে স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কন্টেইনার ধারণক্ষমতা বা অবকাঠামো ব্যবস্থা খালি রাখা অপরিহার্য। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে অধিকাংশ সময়েই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কিংবা সমান সমান কন্টেইনার এবং খোলা সাধারণ পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং, মজুদ করা হচ্ছে। এ কারণে সুচারুরূপে বন্দর কার্যক্রম পরিচালনা কখনও কখনও ব্যাহত হয়।
বন্দরে জাহাজ ও কন্টেইনারের জট পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঝেমধ্যে বন্দরে কনজেশন সারচার্জও আরোপ করা হয়ে থাকে। এ অবস্থা এড়ানোর জন্য বন্দরের অবকাঠামো সুবিধাসমূহ বৃদ্ধি এবং আধুনিক মানে সজ্জিত করার বিকল্প নেই। এসব দিক নিশ্চিত করা হলে দেশের বন্দর-শিপিং সেক্টর অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার যে হাতছানি দিচ্ছে তাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। খুলে যাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার।
তবে পোর্ট-শিপিং সার্কেলের অভিজ্ঞমহল সতর্ক করেন, রোজ সকালে একটি করে সোনার ডিম পাড়েÑ ঈশপের গল্পের অতি লোভী কৃষকের সেই হাঁসের ঘটনার মতো অর্থাৎ একদিনেই সবগুলো ডিম একসঙ্গে পেতে গিয়ে সেই হাঁসটি শুদ্ধ জবাই করে সবগুলো সোনার ডিম একত্রে পেতে চাওয়া থেকে শুভ ফল আসে না। তা চাইলেও পাওয়া যায় না। উদার প্রকৃতির অপার মহিমাময় দান সমুদ্রবন্দর সম্পদ। তাকে নিজের স্বার্থেই প্রতিদিন সেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই সুরক্ষা করতে হবে। তাই বলা হয়ে থাকে, ভাবিয়া করিও কাজ- করিয়া ভাবিও না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।