পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আর ব্যয় কর আল্লাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৯৫)
সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষমাত্রই একে অপরের সাহায্য-সহযোগিতার কোনো না কোনো রকমে মুখাপেক্ষী এবং পরস্পরের উপকার ও কল্যাণ সাধন করা মানুষের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে, যার ভিত্তিতে মানবতার সেবার বুনিয়াদ রচিত হয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, এই উপকার সাধনের নাম ‘এহসান’। তাই কোরআনে মোমেন- বিশ্বাসীদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টির সেবা করে। আর এই সেবা যেন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, এতে কোনো প্রকার লৌকিততা থাকতে পারবে না। একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এ সেবা পরিচালিত হলে স্বয়ং আল্লাহই এর প্রতিদান দেবেন।
উল্লেখিত আয়াতে যে এহসান বা উপকার-অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে অনেক প্রকারের দান-খয়রাত অন্তর্ভুক্ত, যা মানব সমাজের কল্যাণার্থে ব্যয় করার প্রয়োজন ও গুরুত্ব প্রমাণ করে। আল্লাহতাআলা মুসলমানদের প্রতি যেসব বিধিবিধান আরোপ করেছেন সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত অর্থ-সম্পদ হতে একটি নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট শ্রেণীর লোকদের মধ্যে ‘যাকাত’ হিসাবে বণ্টন করা, যাকে ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ফরজটির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানব সমাজের কল্যাণ সাধন করা। মুসলমানদের উপর ফরজ হিসাবে আরোপিত ‘যাকাত’ ছাড়াও আরও নানা দায়-দায়িত্ব ও ব্যয় করার খাত নির্ধারিত রয়েছে। এগুলোর পরিমাণ অনির্ধারিত হলেও প্রয়োজন অনুযায়ী অবশ্যই দান করতে হবে। জিহাদের প্রয়োজন দেখা দিলে তাতে ব্যয় করাও ফরজ। আলোচ্য আয়াতে ‘নিজের জীবনকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করার’ যে কথা বলা হয়েছে তাতে ‘জিহাদ’ পরিত্যাগ করাকে বুঝানো হয়েছে বলে তফসীরকারগণ উল্লেখ করেছেন। মুসলমানদের ধ্বংসের কারণগুলোর মধ্যে জিহাদ পরিত্যাগ করাও একটি। এ কারণেই দেখা যায়, বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু আইয়ূব আনসারী (রা.) সারা জীবন জিহাদে কাটান এবং শেষ জীবনে ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে ইন্তেকাল করেন, তার মাজার সেখানে বিদ্যমান।
‘এহসান’ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শাব্দিক অর্থে অনুগ্রহ, উপকার ইত্যাদি বুঝানো হলেও এর বিশেষ অর্থও রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে এবং সুন্দর রূপে কোনো কাজ সম্পাদন করাকে কোরআন ‘এহসান’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছে। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার অর্থটি স্বয়ং ‘এহসান’ শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কেন না ‘হাসান’ বা ‘হুসন’ শব্দ থেকেই ‘এহসান’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থই হচ্ছে সুন্দর, মনোরম, আকর্ষণীয়।
‘এহসান’ বহু প্রকারের হতে পারে। যেমন, ইবাদতে, বৈষিক ক্ষেত্রে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এবং এজাতীয় বহু ক্ষেত্রে। ইবাদতের ‘এহসান’ সম্পর্কে স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সা.) ‘হাদীসে জিবরাঈল’ এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর যেন তুমি তাকে স্বচক্ষে দেখছ। আর যদি তুমি সে পর্যায়ে পৌঁছতে না পার এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, স্বয়ং আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। হজরত জিবরাইল (আ.) রসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহর পক্ষ হতে এরূপ শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং এ সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনাও রয়েছে। এ কারণে এটি ‘হাদীসে জিবরাইল’ নামে পরিচিত।
‘এহসান’ এর অপরদিকটি অত্যন্ত ব্যাপক, যা মানুষের দৈনন্দিন ও ব্যক্তিগত জীবন থেকে আরম্ভ করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে হজরত মাআয ইবনে জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু পছন্দ কর, অন্যা লোকদের জন্যও তাই পছন্দ করবে। আর যা তোমরা নিজেদের জন্য অপছন্দ কর অন্যের জন্যও তা অপছন্দ করবে।’
কোরআন শরীফের বহু স্থানে ‘এহসান’ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং নানাভাবে ‘এহসান’ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহতাআলা ‘এহসান’কারীদেরকে ভালবাসেন। কোরআনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রত্যেক মুসলমান সমস্ত সৃষ্টির জন্য নিজের শক্তি সমর্থ অনুযায়ী উত্তম আচরণ প্রদর্শন করবে। অর্থাৎ মানবতার সেবায় মুসলমান তার উত্তম আচরণের মাধ্যমে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করবে এবং এটা হবে তার আদর্শ ও অনুকরণীয় আচরণ।
বস্তুত, সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে মানবের পরিচিতির পর তার আর কোনো উত্তম পরিচয় হতে পারে না। মানবের এটি আল্লাহ প্রদত্ত উপাধি। অর্থাৎ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে মুসলমানের কৃতিত্বই হবে সর্বাধিক, আল্লাহ তাই চান। কেননা মুসলমানকেই আল্লাহ তাঁর পছন্দনীয় ও মনোনীত এবং পরিপূর্ণ ধর্মের অধিকারী করে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ ধাপে উপনীত করেছেন। সুতরাং, মানবতার সেবায় মুসলমানের আদর্শই অনুকরণীয় অনুসরণীয়।
মানবশ্রেষ্ঠ নবী, মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ আল কোরআনের বাহক ও প্রচারক। মানবতার সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে লালন পালনে কোরআনকে মানুষের সর্বোত্তম জীবন বিধান হিসাবে রসূলুল্লাহ (সা.) এর মাধ্যমে সমগ্র মানব জাতির মুক্তির সনদ হিসাবে দুনিয়ার সামনে পেশ করা হয়েছে, তাতে মানব কল্যাণের সব কিছুই পরিপূর্ণভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যারা আল্লাহকে মানে, তার প্রেরিত রসূলকে মানে, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কোরআনকে মানে এবং এই ঐশী গ্রন্থকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে, তারাই প্রকৃতপক্ষে সেই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হওয়ার সঠিক দাবিদার হতে পারে। আর তা লক্ষ্য করা যায় সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। কেননা রসূলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র সাহচর্য লাভ করে তারা ধণ্য হয়েছিলেন এবং তারাই ছিলেন সরাসরি কোরআনের উপর আমলকারী ও বাস্তবায়নকারী।
মানবতার ধর্ম হিসাবে ইসলামকে ব্যক্ত করতে এবং তাকে যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা ও তার যথার্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের আদর্শ শিক্ষা বাস্তবায়নে ইসলামের মহান খলিফাগণ নিরলস চেষ্টা করে গেছেন এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তাদের শাসন ব্যবস্থা মহানবী (সা.) এর নির্দেশিত পথেই পরিচালিত করেছেন। মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রকৃত গণতান্ত্রিক, নাগরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষের জন্মগত ও রাষ্ট্রীয় অধিকারসমূহ তারা যথার্থভাবে প্রদান ও প্রয়োগ করেছেন। বিশেষত: আলোচ্য গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারসমূহ প্রদানের ক্ষেত্রে এখানে আমরা কেবল হজরত ওমর (রা.) এর শাসনামলের কয়েকটি দিক উদাহরণ হিসাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই, যাতে বিক্ষিপ্তভাবে এসব অধিকারের পরিচয় মিলে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর মত যোগ্য শাসক পৃথিবীর বুকে খুব কমই জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাই আমরা এই নিবন্ধে তারই জীবনের কতিপয় টুকরো ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শূরা বা পরামর্শকে গণতান্ত্রিক অধিকারের মূলনীতি রূপে তিনি গ্রহণ করেছিলেন।
‘খেদমতে খালক’ বা জনসেবা ইসলাম ধর্মের একটি চিরন্তন, আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ হিসাবে সুপরিচিত। এই ধর্মে মানবতাবোধের এটি অন্যতম নিদর্শন, যাকে মানবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গণ্য করা হয় আর এই জনসেবার মাধ্যমে মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে। মানব সমাজের জন্য যা কিছু হিতকর, কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক অথবা মানবতার কল্যাণসাধনে সহায়ক তাই সমাজ সেবার অন্তর্ভুক্ত। সমাজ সেবা তথা মানবতার কল্যাণ সাধন ব্যতীত মানুষ যেমন মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে না, তেমনি মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে হলেও সমাজ কল্যাণ বা জনসেবার বিকল্প কিছু নেই, রাষ্ট্র পরিচালনা হচ্ছে এর সর্বোচ্চ স্থান।
অভাব-অনটন, দারিদ্র তথা অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দান-খয়রাত ও যাকাত আদায়ের মাধ্যমে দারিদ্র শ্রেণীর সাহায্য-সহযোগিতায় ধনী শ্রেণীর এগিয়ে আসা। সমাজ সেবার এই মূলনীতির অনুসরণ করা হলে ভিক্ষার ন্যায় নিন্দনীয় অভ্যাস অনেকেরই থাকবে না। অর্থশালীদের এই বদান্যতা ও অনুগ্রহ সামাজিক জীবনধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। পরোপকারের জন্য ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার আলোকে মানবতার স্বার্থে কাজ করার বহু ক্ষেত্র রয়েছে, বিত্তশালীরা সে সব ক্ষেত্র নির্ণয় করে তাদের সেবাধর্মী কর্মকান্ড জোরদার করলে দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে বিরাট ভ‚মিকা রাখতে পারেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ‘এহসান’ অনুগ্রহের মধ্যে সকল দিকই নিহিত রয়েছে।
‘এহসান’ এর যথাযথ প্রয়োগ ব্যবহার খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে কিভাবে হত তার বর্ণনা ইতিহাসে রয়েছে। বিশেষত, খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর খেলাফত আমলে জনসেবার যে মহান আদর্শ তিনি স্থাপন করেছিলেন তা চিরকাল ইতিহাসে অমর আদর্শ হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকবে। কোরআনে আল্লাহতাআলা স্থানে স্থানে ‘এহসান’ বা অনুগ্রহের প্রতি উৎসাহিত করেছেন মানবতার সেবার জন্য, যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে অভাবমুক্ত ও সুসংহত করার অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, ‘এহসান’ প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলমানের উচিত এক ইসলমী আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা!
পতন্মুখ মুসলিম সমাজকে অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার হতে মুক্ত করে সমাজে সঠিক আদর্শ শিক্ষা যথার্থভাবে বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিতদের প্রতি সুনজর দেয়া তথা পরোপকারের মাধ্যমে উত্তম ও উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব সৎ ও নিষ্ঠাবান সমাজপতি, জনদরদি ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব। ইসলামের উত্তম আদর্শ ও শিক্ষা বাস্তবায়নে তাদের ভ‚মিকা অপরিহার্য, গুরুত্বপূর্ণ। বিভ্রান্ত, বিপথগামীদের সুপথে আনা এবং সঠিকভাবে পরিচালিত করা বর্তমান সময়ের এক বড় চাহিদা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।