পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কবির ভাষায়, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই’। কিন্তু সুন্দর ভুবনকে আমরা কি সুন্দর রেখেছি। আজ যেন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসুন্দরের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। মানবসভ্যতার শত্রুদের অদূরদর্শী কর্মকান্ডের ফলে আজ পৃথিবী ক্রমশ মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য এক দুর্বিষহ বন্দিশালায় পরিণত হতে বসেছে। দিনকে দিন বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বদলে যাচ্ছে জলবায়ু যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এমনিতেই তথাকথিত ‘সভ্যতা’র সাথে পরিবেশের এক বৈরিতা আছে, সভ্যতার অগ্রগমন বা বিকাশ মানেই নতুন নগর, জনপদ সৃষ্টি যা পরিবেশের একটা মাত্রার ধ্বংসসাধন করেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু তা এক প্রকার নিমিত্ত মাত্র, পরিবেশের মূল বিপদ হচ্ছে পুঁজির অদম্য লালসা। পুঁজির মুনাফা তৈরি ও তার সংহতকরণ, শিল্পের জন্য পরিবেশ ধ্বংস যে মাত্রায় হয়ে চলেছে, তা এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রতি এক অশনিসংকেত বয়ে এনেছে। নির্বিচারে খনিজ আহরণ ও তার সাথে কারখানার অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য-প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমাদের পরিবেশকে ধ্বংস করে চলেছে এবং এইসব কিছুই হচ্ছে এক নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যা মানবসভ্যতার শত্রæ হিসাবেই গণ্য।
বনাঞ্চল ধ্বংস, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অপচয় ও খাদ্যের ক্ষতি, দূষণ ইত্যাদি পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা জরুরি। বিশ্বজুড়ে কার্যকর করার জন্য একটি নির্দিষ্ট থিম এবং স্লোগানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচার সংগঠিত হয়। গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব হ্রাস, অবনমিত জমির উপর ম্যানগ্রোভ উন্নীতকরণ, নতুন নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে।
২০১৫ সালে অ্যালেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশন পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় ৬.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করা হয়েছে এবং এর মধ্য প্রায় ৯০ শতাংশ কমপক্ষে ৫০০ বছরের মধ্যেও বিযুক্ত হবে না। বিজ্ঞানীদের মতে, মাইক্রো-প্লাস্টিক বা ক্ষুদ্র টুকরো মাটির মধ্যে, পানির নল, বোতলজাত পদার্থ, বিয়ার এবং এমনকি বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাসে পাওয়া যায়।
পরিবেশের সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য বিভিন্ন সমাজ ও সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে উদযাপন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে সক্রিয় এজেন্ট হিসাবে উৎসাহিত করা। নিরাপদ, ক্লিনার এবং আরো সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ উপভোগ করার জন্য লোকদের তাদের আশেপাশে নিরাপদ এবং পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য উৎসাহিত করা।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার জন্য, পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের বায়ু, খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহ করে। এটি সঠিকভাবে বলা হয়েছে যে, প্রাণি ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য হল প্রাণিরা পরিবেশের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করে, কিন্তু মানুষ নিজেদের জন্য পরিবেশ পরিবর্তন করে। পরিবেশ আমাদের আশেপাশের মতোই, এর পার্শ্ববর্তী পরিস্থিতি আমাদের প্রভবিত করে এবং উন্নত ও উন্নয়নকে সংশোধন করে।
বায়ু দূষণ দিনে দিনে বাড়ছে এবং এটি নিয়ন্ত্রণে জটিল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এটি অসম্ভব নয়, আমরা এটিকে মোকাবিলা করতে একসাথে কাজ করব। এর জন্য বিভিন্ন ধরনের দূষণ বুঝতে হবে, এটি আমাদের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, আমাদের চারপাশে বায়ু উন্নত করতে পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। আমরা শ্বাস বন্ধ করতে পারছি না কিন্তু আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ুর মান উন্নত করতে কিছু করতে পারি। পৃথিবীর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়।
বিশ্বের প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ পরিস্কার বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পায়না। প্রতি বছর, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির ব্যয় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কল্যাণ খরচ করে। ২০৩০ সালের মধ্যে, স্কুলস্তরের ওজোন দূষণের ফলে প্রধান ফসল উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাবে ২৬ শতাংশ। প্রতি বছর, প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ বায়ু দূষণের কারণে অকালে মারা যায়। প্রায় চার মিলিয়ন মৃত্যু এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘটে। এই বছর, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং সবজি প্রযুক্তির বিভিন্ন উৎসগুলো আবিস্কারের জন্য সম্প্রদায়, ব্যক্তি, সরকারি সংস্থাগুলো শিল্পগুলোকে একত্রিত করবে, যার ফলে সারা বিশ্বজুড়ে শহর এবং অঞ্চলে বায়ুর মান উন্নতিতে সহায়তা করবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে টেকসই বিকল্প অন্বেষণে রাষ্ট্রসংঘ, সরকার, শিল্প সম্প্রদায় এবং প্লাস্টিক ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর বিরুদ্ধে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে যেখানে মানুষ একত্রিত হতে পারে এবং ইতিবাচক পরিবেশগত ব্যবস্থা নিতে পারে। আমাদের এই অভিযানে অংশগ্রহণ করা উচিত এবং দূষণের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো দূর করতে এবং পরিবেশকে পরিষ্কার করতে একত্রে যোগদান করা উচিত। একসাথে আমরা পরিবর্তন করতে পারবো। পরিবেশ সচেতনতা প্রসারে তথা পরিবেশের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে, মানুষ আওয়াজ তোলে, রাস্তায় নামে, ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েও লড়াই করে, এমনকি প্রাণ দিতেও পিছপা হয় না।
আজকের দুনিয়ায় পরিবেশের জন্য সংগ্রাম আসলে এক রাজনৈতিক সংগ্রাম। কারণ তাকে লড়তে হয় রাষ্ট্র, সরকার, কর্পোরেট পুঁজি ও তার বাহিনীর সাথে। এই লড়াই তাই এক বিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান ও পরিবেশের লড়াই না থেকে সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের লড়াইয়ের অংশ হয়ে ওঠে। দাবি উঠুক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার, পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে এরূপ প্রতিটি শিল্প-কারখানা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, শিল্পবর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। পরিবেশের এ ভয়ঙ্কর পরিবর্তনে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত ও আতঙ্কিত। মানব পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে কোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আসুন, নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নির্মল, সবুজ ও আলোকিত পৃথিবী গড়ার জন্য আমাদের এ আবাসভূমিকে দূষণমুক্ত করে তোলার অঙ্গীকার করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।