পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আইনজীবীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এর আগে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা রাজপথ দখল করে যানবাহন চলাচলে ক্ষণিকের জন্য হলেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিল, তাদের সে দিনের বুকভরা স্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার মৃত্যুতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে অশ্রুভরা নয়নে এই একই দাবি ছিল, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ জাস্টিস বা বিচার দু’ প্রকারের হতে পারে। একটি লোক দেখানো বিচারের নামে প্রহসন; অন্যটি বিবেকসম্মত বিচার। সাধারণত যেখানে প্রহসন সেখানেই ন্যায়বিচারের দাবি ওঠে। অন্যদিকে সংক্ষুব্ধ হলেও বিচারিক সিদ্ধান্ত ও পদ্ধতির বিষয় নিয়ে কথা উঠে। রাজপথে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয় বলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মুখ থেকে রাজপথেই আওয়াজ উঠে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ দেশের সর্বোচ্চ আদালত, যেখানে বিবেক সম্পন্ন বিচার পাওয়াই সকলের শুধু প্রত্যাশা নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের ন্যায্য ও মৌলিক অধিকার, সেখানে কেন তিন ঘণ্টা ব্যাপী অনবরত বিচার অর্থাৎ ন্যায়বিচারের দাবি জানাতে হয়? ন্যায়বিচারের সন্দেহ দৃশ্যমান বা লুকাইত ছিল বলেই কি হতাশা থেকে সমবেত স্বরে এ ধ্বনি? সার্বিক মাপকাঠিতে বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে।
বিষয়টি বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে দেখছেন। প্রধান বিচারপতি ঘটনায় হতবাক হয়ে বলেছেন, ‘বাড়াবাড়ির সীমা থাকা দরকার।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘এ ঘটনা ন্যাক্কারজনক, বিএনপির আইনজীবীরা ফ্যাসীবাদী আচরণ করেছেন।’ সুপ্রিমকোর্ট বারের নির্বাচিত সভাপতি (সরকার পন্থী) বলেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনা জীবনে দেখিনি।’ বিভিন্ন টক শোতে আলোচনা হয়েছে যে, ‘অনুরূপ ঘটনা পূর্বেও ঘটেছে।’ বিএনপি আইজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘সরকারের চাপে মেডিকেল রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেলের এক পেশে বক্তব্যের কারণে ঘটনার উদ্ভব।’ আইনমন্ত্রী বলেছেন ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ খোন্দকার মাহবুব হোসেন (বিএনপি) বলেছেন, ‘সব দায় অ্যাটর্নি জেনারেলের।’ তবে আইনাঙ্গনের অভিবাবক হিসাবে অ্যাপিলেট ডিভিশন বিষয়টি ধৈর্য্যরে সাথে সামলে নিয়েছেন, যা দৃষ্টান্তমূলক।
গত ২৮ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চেয়ে মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট তলব করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রতিবেদন আপিল বিভাগে দাখিল করতে বলা হয় এবং একই তারিখে জামিন আবেদনের ওপর শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা শুনানিতে বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া বয়স্ক একজন নারী, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবে চলা ফেরা করতে পারছেন না, মানবিক কারণে আমরা তার জামিন চাই।’ উল্লেখ্য, ৭ বছর সাজার মধ্যে জেলকোড অনুযায়ী ইতোমধ্যে তিনি প্রায় ২ বছর যাবৎ জেল খাটছেন। বিচার চলাকালে তিনি জামিনে থেকে রায় ঘোষণার দিনও বিচারিক আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বিচার চলাকালে জামিনে থাকাও আপিলে জামিন পাওয়ার একটি গ্রাউন্ড হিসাবে বিবেচিত হওয়ার অনেক নজির দেশ বিদেশের উচ্চ আদালতের রয়েছে।
আদালত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল, অ্যাপিলেট ডিভিশনের পরে আশ্রয় লাভের জন্য কোথাও যাওয়ার আর কোনো স্থান বা অবস্থান নাই, এ কথা আইনজীবীদের জানা এবং এটাই মানুষের বিশ্বাস। যুগ যুগ ধরে ‘দেশ বৈরী তো দেশান্তরী, হাকিম বৈরী তো প্রাণে মরি’ প্রবাদটি চলে আসছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আদালত একদিকে যেমন অত্যন্ত আস্থার প্রতীক, অন্যদিকে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সম্মানজনক। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নিকট মাথা ঝুঁকিয়ে কথা বলার নিয়ম নাই, যা রয়েছে বিচারপতিদের সামনে আদালতের এজলাসে। বিচার ব্যবস্থার সূচনালগ্নের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিচার করার অধিকার ছিল একমাত্র সার্বভৌম রাজার। পরবর্তীতে কালক্রমে রাজার দায়িত্ব পালনের পরিধি বিপুল পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় রাজারা বিচারের দায়িত্ব ধীরে ধীরে তার নিয়োজিত একদল অভিজ্ঞ বিশ্বস্থ ব্যক্তির হাতে অর্পণ করেন। বিচারপতিগণ রাজার প্রতিভূ বা প্রতিনিধি হিসাবে বিচার কাজ পরিচালনা করতেন। কিন্তু ন্যায়বিচারের তাগিদে আধুনিক বিচার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য লাভ করে এবং যেখানে সার্বভৌম রাজতন্ত্র নাই সেখানে সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতাসীন থেকে বিচারের আওতাভুক্ত হতে হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সীমানায় ক্ষমতাসীন ব্যক্তির যে কোনো সিদ্ধান্তের উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার বিচার বিভাগের উপর অর্পিত হয়েছে, যদিও ক্ষেত্র বিশেষে এর ভিন্নতা দেখা যায়। কোনো কোনো রাষ্ট্রে এর ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, বিচার বিভাগ কর্তৃক সরকারের তাবেদারীর দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কিছু কিছু রাষ্ট্রে থাকলেও প্রকৃত বাস্তবসম্মত গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে এমন রাষ্ট্রে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানও বিচার বিভাগের নিকট জবাবদিহিতার আওতায় রয়েছে। যেমন, আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত। সেনাশাসকদের প্রভাব রয়েছে এমন রাষ্ট্রেও বিচার বিভাগ আস্থা ও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে, যেমন, পাকিস্তান।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) মোতাবেক রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে নিতে হয়। উক্ত অনুচ্ছেদ যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ: ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেনঃ তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’
সেদিন আইনজীবীদের উই ওয়ান্ট জাস্টিস ধ্বনি ছিল হতাশার একটি বহিঃপ্রকাশ। সরকারি ডাক্তারগণ বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কি সঠিক তথ্য প্রদান করতে পারবে? প্রেক্ষাপট কী বলে? আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক ভাবধারায় লালিত। এ দেশের প্রশাসন আদর্শে চলে না, বরং চলে আদেশে। রোবটের মতই আমলাদের আচরণ। একই বিষয়ে সরকারি দল বা ক্ষমতাসীনদের প্রতি আমলাদের একরকম আচরণ, সে অনুরূপ বিষয়েই বিরোধী দলের প্রতি আচরণ একেবারেই ভিন্ন রূপ। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র একটি বিবেকহীন রোবট মাত্র। চাকরিতে প্রমোশন বা সুবিধাজনক লোভনীয় পদে পোস্টিংয়ে আঘাত হানতে পারে এমন কোনো ঝুঁকি আমলারা নেন না। আমলারা ক্ষমতাসীনদের সেবাদাসে পরিণত হতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তিতে জনগণের ভাগ্যে যা হবার তাই হচ্ছে। আমলাতন্ত্র জাতির জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসাবে জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি সুবিচারের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এ. এস. এম. আকরামের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর ৬ জন বিচারপতি সমন্বয়ে ঢাকা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা হাইকোর্ট তথা পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট অনেক জটিল জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, যা সরকার সমাধান দিতে পারে নাই, নীতিমালা প্রণয়ন পূর্বক সিদ্ধান্ত দেওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। কিন্তু শাসকদলের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণত মুখোমুখি অবস্থান নিতে পারে নাই, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। যেমন, তাৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানের শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বিচার বিভাগের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ভ‚মিকা থাকলেও বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকীর মতো দৃৃষ্টান্ত কোথায়?
বিচার ও আইন পাশাপাশি রাখলে বিচার বা বিচারকের জবাবদিহিতা ও দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ আইন প্রণীত হয় শাসক শ্রেণী দ্বারা, যারা নিজেদের শাসন ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেই আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও প্রয়োগ করে। নিজেদের তৈরি আইন ক্ষেত্র বিশেষে শাসকগণ কোথাও প্রয়োগ করে, কোথাও করে না। কিন্তু বিচার বা বিচারককে তাড়িত হতে হয় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিবেক দ্বারা। শাসক সৃষ্ট আইনের চেয়ে বিচারকের বিবেকের পরিধি অনেক বড়, স্বচ্ছ ও কল্যাণকর। কিন্তু বিবেকের স্বাধীনতা যেখানে প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ হয়, সেখানেই সৃষ্টি হয় বিপত্তি, আপত্তি ও বিশৃঙ্খলা। এ জন্যই গণমানুষের বদ্ধমূল ধারণা, ‘বিবেকই পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ আদালত।’
আইনজীবী হিসাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শুনানিতে উপস্থিত থাকার জন্য সচেষ্ট থাকি। সে কারণেই ২৮ নভেম্বর ও ৫ ডিসেম্বর অ্যাপিলেট ডিভিশনে শুনানির সময় উপস্থিত ছিলাম বিধায় প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমার হয়েছে। বিএনপি’র একজন কর্মী হিসাবে হতে পারে অবচেতন মনে আমার পর্যালোচনা ভুল বা এক পেশে, তথাপি বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো একজন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে, আদালতের ভাবমর্যাদা সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে। একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে উপলব্ধি করায় আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও পর্যবেক্ষণটি যাতে উদ্দেশ্য প্রণোদিত না হয়, এ জন্য সচেতন থাকারও চেষ্টা করেছি।
লেখক: চেয়ারম্যান, গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলন
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।