পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকায় আসা, ঢাকায় থাকা, ঢাকায় একবার ঘুরে যাওয়া একটা নেশার মতো। এ বড় ভয়ংকর নেশা। ঢাকায় যারা থাকে, তারা যেমন ঢাকা ছেড়ে যেতে চায় না, তেমনি ঢাকায় একবার যারা ঢুকে পড়েন, তারা আর ফিরতে চান না। ঢাকা যতই সমস্যায় জর্জরিত হোক, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা যতই কম হোক, মানুষ ঢাকাতেই থাকতে চায়। এ এক দুর্নিবার আকর্ষণ। ঢাকা ছেড়ে কিছুদিন বাইরে থাকলেই হাঁপিয়ে উঠে। কখন প্রাণের শহর, প্রিয় শহর ঢাকায় ফিরবে, এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠে। ঢাকা ছাড়ার অর্থ যেন তাদের কাছে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এটা আসলে অভ্যস্ততার ব্যাপার। অনেক সময় মানুষ চরম দুরবস্থার মধ্যেও নিজেকে মানিয়ে নেয়। ঢাকায় যারা বসবাস করেন এবং যারা ঢাকাগামী হয়, তারা ঢাকার কঠিন জীবন এবং দুরবস্থার কথা মেনে নিয়েই থাকে এবং আসে। এর কারণ ঢাকা তাদের স্বপ্ন। যারা আসে তারা মনে করে ঢাকা আসতে পারলেই তাদের জীবনধারা বদলে যাবে। স্বপ্ন পূরণ হবে। এই যে মানুষের ঢাকামুখী হওয়া, এটা যে ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগিতাকে আরও অনুপযোগী করে তুলছে এবং তাদেরকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে, এটা তাদের মাথায় থাকে না। তারা মনে করে, কোনো রকমে ঢাকায় ঢুকতে পারলেই হলো, জীবন বদলে যাবে। এর ফলে প্রতিদিন ঢাকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় মানুষের আগমণ ঘটে প্রায় ১৭০০ জন। অবশ্য এ সংখ্যাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কোনো কোনো হিসাবে সংখ্যাটি আড়াই হাজারের বেশি। এ হিসাবে ঢাকায় মাসে যুক্ত হচ্ছে, ৫০ থেকে ৭৫ হাজার মানুষ। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এত অধিক সংখ্যক মানুষের যুক্ত হওয়ার নজির নেই। বিবিএস-এর হিসাবে ঢাকার বর্তমান লোকসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। জাতিসংঘের ইউএনএফপি’র হিসাবে, পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা শীর্ষ সারিতে। তবে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর এক নম্বর জনঘনত্বের শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৩ হাজার ৫০০ জন মানুষ বসবাস করে। এ যেন মানুষের গিজগিজ করে বসবাস। যে হারে ঢাকায় মানুষের আগমণ ঘটছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে এর অবস্থা কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ঢাকার এমন দুর্দশার মধ্যেও ঢাকামুখী মানুষের আগমণ যেমন কমেনি, তেমনি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছাও কারো নেই। আবার ঢাকার এ অবস্থা দূর করার তেমন কোনো নীতি ও পরিকল্পনাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই। যেমন আছে তেমন চলতে থাকুক-এমন একটা প্রবণতা সবসময়ই রয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, ঢাকায় মানুষের এই আগমণের জন্য কি কেবল ঢাকাগামী মানুষরাই দায়ী? তারা কি সাধ করে ঢাকার কষ্টের জীবনে জড়াতে চায়? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, কেউ সাধ করে কষ্টের জীবনে জড়াতে চায় না। এর জন্য দায়ী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। কারণ রাষ্ট্র ঢাকার মধ্যেই মৌচাকের মতো সকল সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত করে রেখেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-আদালত, প্রশাসন, কলকারখানা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাকে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে মানুষ এখানে ছুটে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
দুই.
ঢাকাকে বলা হয় মেগাসিটি। সাধারণত যে শহরের লোকসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেই শহর এই খেতাব লাভ করে। ঢাকার লোকসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে এর জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ডাবল মেগাসিটিতে পরিণত হবে। এই বিপুল সংখ্যক রাজধানীবাসীর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা আমরা শুনিনা। পরিকল্পনা আছে কিনা, তাও জানি না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ঢাকায় যারা থাকেন এবং আসেন, তারা নিজেরাই নিজেদের বসবাসের জায়গা করে নেন। এতে পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ছে না। অথচ যে কোনো রাজধানী গড়ে তোলা হয় পরিকল্পিতভাবে। এজন্য কর্তৃপক্ষ আছে। যে কেউ চাইলেই ইচ্ছামতো ঘর-বাড়ি বা ছাপড়া তুলে বসবাস করতে পারে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণের কাজটি করে। ঢাকাকে দেখলে মনে হবে, এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। যে যেভাবে যেদিকে পারছে ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এগুচ্ছে তো এগুচ্ছেই। থামাথামি নেই। থামানোর চেষ্টাও নেই। এই সম্প্রসারণ কাজ করতে গিয়ে নগরীর প্রাকৃতিক যে বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য, তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা পরিণত হচ্ছে ইট, কাঠ, পাথরের নগরীতে। পরিণত হচ্ছে আবর্জনার নগরীতে। এই শহরেই প্রতিদিন ৬ হাজার টন গৃহস্থলি বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে অপসারণ করা হয় ৪ হাজার টন। এছাড়া তরল বর্জ্য তো আছেই। বলা হয়, ঢাকার মতো প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত রাজধানী বিশ্বে খুব কম আছে। এটি এমন এক শহর, যার ভেতর দিয়ে এক সময় স্বচ্ছ প্র¯্রবণ বহমান ছিল। জালের মতো খাল আর চতুর্দিকে নদী। ঘর-বাড়ি, অফিস-আদালতের পাশ দিয়ে স্বচ্ছ বারিধারা বয়ে যেত। পানিতে ভবনের ছায়া ও বিদ্যুতের আলো ঢেউ খেলে যেত। এসব এখন কেবল কল্পনায় পরিণত হয়েছে। এখন কেউ কি কল্পনা করতে পারে, এই ঢাকায় একসময় ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি খাল ও অসংখ্য পুকুর ছিল? এ প্রজন্মের কাছে তো তা স্বপ্নের মতো। তারা কেবল শুনছে, এই সুউচ্চ ভবনটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বা এই সড়কটি যেখান দিয়ে গিয়েছে, এসবই খালের উপর গড়ে উঠেছে। তাদের কি বিশ্বাস করানো যাবে, আজকের যে গুলশান, সেখানে বাড্ডা এলাকা দিয়ে এক সময় নৌকা ভিড়ত? আজকের যে সুরম্য বসুন্ধরা সিটি মার্কেট, এ জায়গাটি ছিল বিশাল একটি ঝিল? সেখানে শাপলা ফুটত, নৌকা চলত। এখন ঢাকা শহরে যেসব লেক দেখা যায়, এগুলো মূলত সেসব খাল বা নদীর খন্ডিতাংশ মাত্র। এগুলো কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়নি। প্রাকৃতিগতভাবেই ছিল। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা ও বালু নদীতে গিয়ে মিশেছিল। কেবল দখলদারিত্বের কবলে পড়ে আবদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। যদি এসব খাল রক্ষা করা যেত, তাহলে ঢাকা শহরের চেহারাটা কেমন হতো? কাচ ঘেরা সুউচ্চ ভবন এবং এলইডি লাইটের আলোয় কী ঝলমলই না করতো! ঢাকার আজকের যে অসীম সমস্যা তা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যেত। বুক ভরে মানুষ সতেজ নিঃশ্বাস নিতে পারতো। মানুষকে শীষা, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড মিশ্রিত বিষাক্ত বায়ু সেবন করে হৃদরোগ, শ্বাস কষ্ট, ডায়বেটিসসহ জীবন বিনাশক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে হতো না। খুব স্বাভাবিক হিসেবে যদি ধরা হয়, প্রায় দুই কোটি মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে যে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ছে, এই বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড শুঁষে নেয়ার মতো সবুজ গাছ-গাছালি রাজধানীতে নেই। এর সাথে গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া যুক্ত হয়ে পরিবেশকে কী পরিমাণ দূষিত করে তুলেছে, তা কি কল্পনা করা যায়? এছাড়া পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্যব্যবস্থাপনার যে দুর্দশা, তাতে পরিস্থিতিকে কী দুর্বিষহই না করে তুলছে! ফলে ঢাকা এখন বায়ু দূষণে বিশ্বের এক নম্বর শহর। এসব সমস্যা সমাধানে যে ধরনের কর্তৃপক্ষ এবং তার সুষম পরিকল্পনা থাকা দরকার, তা ঢাকা শহরে নেই। যারা আছেন, তারা তাদের সক্ষমতা আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেননি। তারা নিজেরাই নানা অপরিকল্পনা ও সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে আছে। তাদের অজুহাতের শেষ নেই। এই সক্ষমতার অভাব এবং অজুহাত দিয়েই বছরের পর বছর তারা পার করে দিচ্ছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের কাজটুকু যথাযথভাবে করত এবং তদারকি করত, তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতো। বিশেষ করে দুই সিটি করপোরেশন, যাদের উপর ঢাকার অধিকাংশ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব, তারা যদি একটু তৎপর ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করত, তবে ঢাকা যে দুরবস্থা কিছুটা হলেও সহনীয় হতো। ঢাকাবাসীর চোখে এ ধরনের আশাব্যঞ্জক কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। একটি আধুনিক রাজধানীর কি সুযোগ-সুবিধা থাকে, তা তারা যেমন জানে না, তেমনি সমস্যাকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েই তারা বসবাস করছে।
তিন.
ঢাকার অসংখ্য সমস্যার মধ্যে যেটি প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে যানজট। প্রতিমুহূর্তে এ সমস্যায় পড়ছে না, এমন মানুষ নেই। যানজটে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে যানজটে ক্ষতি হয় বছরে ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার কোটি থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা। যানজটে প্রতিদিন মানুষের নষ্ট হয় ৯ হাজার কর্মঘন্টা। চলাচলরত যানবাহন ঘন্টায় যেতে পারে ৬.৪ কিলোমিটার। অথচ হেঁটেই ঘন্টায় যাওয়া যায় ৫ কিলোমিটার। যানজটে বছরে যে ক্ষতি হয় তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর একটি করে পদ্মাসেতু নির্মাণ করেও অতিরিক্ত অর্থ উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণে যেভাবে নিজস্ব অর্থায়ন এবং দ্রæত গতিতে কাজ সমাপ্ত করার দিকে মনোযোগী হয়েছি, এ মনোযোগ যদি যানজট নিরসনের দিকে দিতাম, তাহলে আমাদের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো! যে বিনিয়োগ নিয়ে এতো হা-হুতাশ ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন এবং জনগণের পকেট থেকে নানা উপায়ে সরকারের পয়সা বের করে নেয়ার ফন্দি-ফিকির, তা করার দরকার পরত কি? এমনকি যে ঘাটতি নিয়ে লাখ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়, সে ঘাটতি কি থাকত? সরল হিসেবে যদি ধরা হয়, তবে যানজটের ক্ষতি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে, চার বছরের মধ্যে ঘাটতি বিহীন একটি বাজেট ঘোষণা দেয়া সম্ভব হতো। যাই হোক, যানজটের ক্ষতির মাত্রা বলে শেষ করা যাবে না। এর ক্ষতি বহুমাত্রিক। যানজটে পড়ার ভয়ে কর্মজীবী মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের স্বাভাবিক জীবন ও কর্মকান্ড প্রতিদিনই ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকায় যারা বসবাস করেন, তারা জীবনযাত্রা পরিবর্তন করে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা ঢাকায় আসেন, তাদের জীবনযাত্রা অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন করতে হয়। যেখানে কর্মস্থলে যাওয়ার স্বাভাবিক সময় আধাঘন্টা, সেখানে তাকে দুই ঘন্টা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তানাহলে কোনোভাবেই চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো চালানো সম্ভব নয়। যানজটের কারণ মোটামুটি সবারই জানা। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ট্র্যাফিক আইন না মানা ও সঠিকভাবে প্রতিপালন না করা, যত্রতত্র কার পার্কিং এবং কার পার্কিংয়ের জায়গায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করা, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল, ট্র্যাফিক পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি। এর বাইরে মূল যে সমস্যা তা হচ্ছে, রাজধানীর রাস্তার তুলনায় অধিক সংখ্যক গাড়ি চলাচল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যেখানে একটি আদর্শ শহরে ২৫ ভাগ সড়ক থাকে, সেখানে ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। আবার এই ৭ ভাগের মধ্যে কার্যকর রাস্তা হচ্ছে আড়াই ভাগ! এই কার্যকর রাস্তা দিয়ে সোয়া দুই লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারলেও এখানে চলছে ৯ লাখ। তার উপর প্রতিদিন ৩১৭টি গাড়ি রাস্তায় নামছে। এ যদি হয় পরিস্থিতি, তবে যানজট সৃষ্টি না হয়ে উপায় আছে? আরও কারণ রয়েছে। নগরীতে লোকসংখ্যার অনুপাতে যে পরিমাণ গণপরিবহণ থাকার কথা তা একেবারেই নেই। অথচ যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য এবং লোকজনের যাতায়াতে পর্যাপ্ত গণপরিবহণের বিকল্প নেই। সারা বিশ্বেই গণপরিবহণের উপর বেশি জোর দেয়া হয়। বাংলাদেশই কেবল ব্যতিক্রম। এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নগরীতে ৬০ ভাগ মানুষ হেঁটে চলে। রিকসায় চলে ১৯ ভাগ। বাস ও অটোরিকসায় চলে ১৬ ভাগ। আর প্রাইভেট কারে চড়ে মাত্র ৫ ভাগ। অর্থাৎ ৫ ভাগ মানুষের প্রাইভেট কারের জন্য ঢাকার যানজট তীব্র হয়ে রয়েছে এবং প্রাইভেট কারেরই অনুমোদন দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। একটি প্রাইভেট কারে ড্রাইভারসহ দুইজন থেকে পাঁচজন চড়তে পারে। বেশিরভাগ সময় শুধু দুইজনই চড়েন। বাকি তিনজনের জায়গা খালিই পড়ে থাকে এবং রাস্তার বিরাট একটা অংশ দখলে চলে যায়। আবার এসব গাড়ি রাস্তার উপর পার্কিং করার কারণেও যানজট সৃষ্টি করে চলেছে। এ পরিস্থিতি যদি হয়, তবে যানজট কোনো কালেই কমবে না। ঢাকার যানজট কমাতে হলে প্রাইভেট কারের অনুমোদনের সংখ্যা কমাতে হবে। যাদের একাধিক প্রাইভেট কার রয়েছে, তাদেরকে একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন এবং তার জায়গায় আধুনিক, আরামদায়ক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণপরিবহণ সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি। একবার যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন এক পরিবারের এক প্রাইভেট কার নীতির। এ ঘোষণা ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নীতিটি খুবই ভালো ছিল। বাস্তবায়ন করা গেলে যানজট কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসত। কেন এর বাস্তবায়ন হলো না, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
চার.
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার তাকিদ নগরবিদরা বহুদিন ধরেই দিচ্ছেন। তাদের এ পরামর্শ শুনতে ভাল লাগে। তবে যাদের শোনার কথা এবং বাস্তবায়ন করার কথা, তারা শোনে না। যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বর্ধনে এক ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে কত কী ঘটে গেল, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গুলিস্তানের ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে এক ধরনের ইঁদুর বেড়াল খেলা আমরা প্রায় সময়ই দেখি। ফুটপাত আর দখলমুক্ত হয় না। দখলকারীরা কত শক্তিশালী যে সিটি করপোরেশনও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। সরকার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক কিছুই করেছে। আমরা মনে করি, ঢাকাকে হালকা এবং আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হলে সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজধানীকে মানুষের চাপমুক্ত রাখতে এবং ঢাকাগামী মানুষের স্রোত ঠেকাতে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং সেবাসহ প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি। অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও প্রধান প্রধান জেলা শহরগুলোতে ঢাকার মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকায় আর কোনো কলকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া যাবে না। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান সৃর্ষ্টি হয় এবং জীবিকার সন্ধানে মানুষকে ঢাকামুখী না হতে হয়। এজন্য ব্যাপক পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। তা নাহলে আমরা যে উন্নতি করছি, ঢাকার দুরবস্থা দেখে কেউই তা মনে করবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।