পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সম্প্রতি খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জের ৪৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ২৩৯টি পয়েন্টে গাছ বা খুঁটির সাথে ৪৭৮টি ক্যামেরা বসিয়ে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ মনিটরিং করা হয়। যৌথভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে এই জরিপ পরিচালনা করে বন বিভাগ, বেসরকারী সংস্থা ওয়াইল্ড টিম ও যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান কনজারভেশন বায়োলজি ইনস্টিটিউট। তাদের মতে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। তিন বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ভারতীয় সুন্দরবনে ৮৪টি, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের অন্য বনাঞ্চল মিলে দক্ষিণ এশিয়ায় বেঙ্গল টাইগার আছে প্রায় আড়াই হাজার।
যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ বৈচিত্র্যময় এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বেশি। অন্যদিকে, বিশ্বের বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাভূমি ও কাদামাটির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবন বেঙ্গল টাইগারের বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। ২৫০ থেকে ৩০০ বছর আগে বাংলাদেশের শুষ্ক ভূভাগ থেকে সুন্দরবনে গিয়ে এরা বসবাস শুরু করে। খাপ খাওয়নোর ক্ষমতা কমে আসলে সুন্দরবন বাঘের অভয়ারণ্য না হয়ে মৃত্যুকূপও হতে পারে। বিশ্বে বাঘের যে ছয়টি উপপ্রজাতি এখনো টিকে আছে, তার সব কটি মূলত শুষ্ক এলাকায় থাকে। আর তাদের খাবার বা প্রে অ্যানিমেলও অনেক বেশি। ভারতের আসামে কাজীডাঙা বনভূমি ও উত্তরাখন্ডের করবেট সংরক্ষিত বনে বাঘের খাবারের জন্য পাঁচ থেকে ছয় প্রজাতির বড় আকৃতির প্রাণী (মহিষ, শম্বর, হরিণ, শূকর, বানর, গরু, ছাগল) আছে। সেখানকার বাঘ এসব বড় আকৃতির প্রাণী খেয়ে বড় হয়। ফলে তাদের আকৃতিও বেশ বড় হয়। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের জন্য হরিণ ও বুনো শূকর ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খাবার হিসেবে নেই। সুন্দরবনে সুন্দরী ও কেওড়াগাছের মতো যেসব বৃক্ষ বেশি লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না, সেগুলো হয় আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে অথবা মরে যাচ্ছে। বিপাকে পড়ছে এজাতীয় বেশ কিছু গাছ ও তৃণজাতীয় উদ্ভিদ, যেগুলো হরিণের খাদ্য। খাবারের অভাবে দ্রæত কমছে হরিণের সংখ্যা। চোরা শিকারিদের দাপট তো আছেই। হরিণ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনে বাঘের খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। ফুড-প্লানিং না থাকায়, সুন্দরবনের বাঘের দিনদিন দুর্বল হওয়ার প্রবণতা রয়েই যায়।
বাঘ রক্ষার জন্য ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বে বাঘ আছে এমন দেশগুলোর সম্মেলনে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য সুন্দরবনের বাইরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কিছু বাঘ থাকা বিচিত্র নয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের সাথে সাথে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।
২০১৬ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বাঘ আছে এমন ১৩টি দেশের বন ও পরিবেশমন্ত্রীদের সম্মেলনের প্রাক্কালে, প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (ডবিøউ ডবিøউ এফ) এবং গেøাবাল টাইগার ফোরামের মতে, বৈশ্বিক গণনায় বাঘের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৯০টি। ২০০০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২০০টি। বন-জঙ্গলের আশপাশের স্থানীয় মানুষ এবং সংরক্ষণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তৎপরতায় বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে বাঘের সংখ্যা কমেছে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ায়। ২০১৬ তে প্রকাশিত বন বিভাগের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। অন্যদিকে সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও বাঘের সংখ্যা কমেছে ইন্দোনেশিয়ায়। পাম তেল, কাগজের মন্ড তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ বন ধ্বংস করার কারণেই সেখানে বাঘের সংখ্যা কমেছে।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আশানুরুপভাবে বাড়ছে না। এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো কারণ জানা না গেলেও, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সুন্দরবনের ওপর স্থানীয়দের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতাই বাঘের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ। এই অঞ্চলের অধিবাসীরা জীবনজীবিকার জন্য প্রধানত বন ও বনসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কেউ কাঠ কাটে, কেউ গোলপাতা সংগ্রহ করে, কেউ মধু অন্বেষণ করে, আবার কেউবা মাছ-কাঁকড়া ইত্যাদি ধরে থাকে। লবণাক্ত পানির কারণে চাষবাস হয় না বিধায় বনই তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস। তবে চোরা শিকারিদের উৎপাত-উপদ্রবতো আছেই। তারা প্রধানত হরিণ ও বাঘ শিকার করে থাকে। মানুষের অত্যাচার আর প্রাকৃতিক কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের বাঘ। দীর্ঘদিন ধরে চোরা শিকারিরা শিকার করে চামড়া, হাড়সহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার করে আসছে। খাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ পিটিয়ে হত্যা করছে গ্রামবাসী। সিডর-আইলা-ফণীর মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগও এর জন্য দায়ী। সুন্দরবনের বাঘের প্রধান হুমকি তিনটি- বাঘ হত্যা, বাঘের শিকার প্রাণী (হরিণ) হত্যা এবং বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। এতে বনভূমি ডুবে যাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাঘের বিচরণক্ষেত্র কমে যায়। পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি পাচ্ছে না তারা। ওই পানি পান করায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে বাঘ। বার্ধক্যজনিত কারণে ও লবণাক্ত পানি পান করায় লিভার সিরোসিস রোগেও মারা যাচ্ছে অনেক বাঘ। নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় করা, খাদ্য সংকট, অপরিকল্পিত পর্যটন ও বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। তবে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বাঘের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল। সেক্ষেত্রে দু’দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময় বাঘের সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে স্থানীয়দের বিকল্প জীবন-জীবিকার পাশাপাশি, বাঘ সংরক্ষণে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে হবে ।
২০১০ সালে রাশিয়ায় ‘বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে’ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। বাংলাদেশও এ সংখ্যা দ্বিগুণ করবে। ঘটনা হলো উল্টো! দ্বিগুণ হয়নি বরং অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। বাংলাদেশ কিভাবে পরিকল্পনা করেছে? কি কি পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে? পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা? পদক্ষেপ কতটুকু বাস্তবে ফলপ্রসু হবে? এসব নিয়ে ভাবনার সময় কিন্তু বয়েই যায়। বিশ্ব বাঘ দিবসে কিছু সচেতন নাগরিককে বাঘ নিয়ে কথা বলতে শোনা গেলেও বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার বিষয়টা যেন এক কল্পনার বিষয় মাত্র। বাঘের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, প্রজনন ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাঘ সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থাসমূহ, গবেষক, উৎসাহী এবং স্থানীয় জনগণসহ সকলকে সমঝোতার ভিত্তিতে, বাঘ সমৃদ্ধ দেশসমূহের পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বাঘ প্রজাতির সুরক্ষা এবং সমৃদ্ধি আনয়ন সম্ভব।
লেখক: প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, পিলখানা, ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।