চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ দুই ॥
হজরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারায় এমন দুটি আয়াত দ্বারা খতম করেছেন যেগুলো তিনি আমাকে আরশের নিচের অমূল্য রতœভা-ার থেকে দান করেছেন। সুতরাং তোমরা নিজেরা এই আয়াতগুলো শেখ এবং তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে শেখাও। কারণ এ দুটি আয়াত সালাত, কোরআন ও দোয়া।-মুসতাদরাকে হাকেম
হেদায়াতের ওপর অবিচলতার দোয়া : সুদৃঢ় ও পরিপক্ব জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিরা বলেন, কোরআনের সকল আয়াতই আমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে আগত, এর সবগুলোই আমরা বিশ্বাস করি। তারা আল্লাহপাকের নিকট প্রার্থনা করে আরও বলে, ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য-লঙ্ঘনকারী করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। হে আমাদের রব, আপনি মানব জাতিকে একদিন একত্রে সমাবেশ করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই আল্লাহ নির্ধারিত সময়ের ব্যতিক্রম করেন না।” -আলো ইমরান ৮-৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি কোনো বস্তু হারানোর পর দ্বিতীয় আয়াতখানি পাঠ করে এ দোয়াটি পড়ে তবে সে ওই হারানো জিনিস ফিরে পায়।
গুনাহ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দোয়া : কোরআন মাজিদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহভীরু মুত্তাকীদের পরিচয় প্রদান করা হয়েছে। একস্থানে বলা হয়েছে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র জীবন এবং আল্লাহপাকের পূর্ণ সন্তুষ্টি। তাকওয়া অবলম্বনকারী তারাই, যারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, আল্লাহপাকের অনুগত, আল্লাহর পথে ব্যয়কারী এবং ঊষাকালে আল্লাহপাকের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। যারা আল্লাহপাকের নিকট বলে- ‘‘রাব্বানা আমান্না মাগফির লানা ওয়াক্বিনা আযাবান নার’’ ‘‘হে আমাদের পালনকর্তা আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। Ñআলে ইমরান ১৬”
সংকট রাব্বানীদের দোয়া : উহুদ সত্তরজন মুসলিমের শাহাদাত লাভ এবং অনেকের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো মুসলমানের মন দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহপাক সকলের মনে সাহস সঞ্চার এবং করণীয় ও বর্জণীয় নির্ধারণের উদ্দেশে বলেন, বিভিন্ন যুগে বহু নবী যুদ্ধ করেছেন। তাদের সঙ্গে অনেক আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের কখনও বিপর্যয় ঘটলে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয়নি এবং নতও হয়নি। কঠিনতর পরিস্থিতিতেও তারা ধৈর্যধারণ করেছে। তখন এ আল্লাহওয়ালাদের একমাত্র প্রার্থনা ছিল ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের পাপ এবং আমাদের কার্যে সীমা লঙ্ঘন ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন। -আলে ইমরান ১৪৭
ভয়ভীতির সময়ের দোয়া : তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসের পনের তারিখ উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর মুশরিকগন একে অপরকে ভর্ৎসনা দিতে থাকে যে, তোমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারনি। তোমরা তাদের শক্তি-সামর্থ্য ধ্বংস করেছ, তাদেরকে হত্যা ও আহত করেছ, কিন্তু তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করতে পারনি। অতএব পুনরায় মদিনায় আক্রমণ করতে হবে।
হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে এ কথা জানতে পেরে পরদিন ষোলই শাওয়াল রবিবার সকালে হুকুম দেন, গতকাল যারা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদেরকে পুনরায় প্রস্তুত হয়ে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। অথচ তখন সবাই ছিলেন ক্লান্ত, আহত ও অবসন্ন। তৎসত্ত্বেও সবাইকে বিপুল উদ্দীপনাসহ প্রস্তুত হয়ে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সবাই বিপুল-উদ্দীপনাসহ প্রস্তুত হয়ে শত্রুবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে রওয়ানা হন। তারা মদিনা থেকে আট মাইল দক্ষিণে অবস্থিত ‘হামরাউল আসাদ’ নামক জায়গায় অবস্থান করেন। এ সংবাদ জানতে পেরে মুশরিকদের যুদ্ধের খায়েশ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তখন তারা মুসলিমদেরকে ভীতি প্রদর্শনের এক কূটকৌশল অবলম্বন করে। তাদের কাফেলা মদিনায় আসছিল। এ কাফেলার লোকদেরকে ওরা বলল, আমরা মুসলিমদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি। অচিরেই তাদের ওপর হামলা চালাব। এ সংবাদ পৌঁছানো মাত্র সব মুসলমান অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে একমাত্র আল্লাহপাকের প্রতি নির্ভরতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক।’ Ñআলে ইমরান ১৭৩। হাদিস শরিফে এ দোয়াটির অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজরত ইবরাহীম (আ.)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তাঁর সর্বশেষ কথা ছিল ‘হাসবুনাল্লাহ ওয়ানি’মাল ওয়াকীল।’ Ñসহীহ বুখরী। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিন্তা বৃদ্ধি পেলে তিনি মাথায় ও দাড়িতে হাত বুলাতেন। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস নিতেন ‘‘হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিলু’’ এবং পাঠ করতেন। হজরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ ‘হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিলু’ দোয়াটি সব ভীতিকর বিষয় থেকে নিরাপত্তা দেয়।
বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণের দোয়া : আল্লাহতায়ালা কোরআন পাকে ইরশাদ করেছেন, আমি মুমিনদেরকে ভয়, ক্ষুদা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। এরূপ কঠিন পরীক্ষার সময়ও যারা ধৈর্যধারণ করবে, তাদের জন্য শুভ-সংবাদ। তাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অশেষ দয়া বর্ষিত হয় এবং এরাই সৎপথে পরিচালিত। ধৈর্যশীল তারাই যাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ ‘আমরা সকলে তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই আমরা প্রত্যাবর্তনকারী।’-বাকারা ১৫৬
বিপদে আপদে এই দোয়া পাঠ করার অনেক ফজিলত রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হজরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে কোনো বান্দা বিপদগ্রস্ত হয়ে যদি পাঠ করে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ তবে আল্লাহতায়ালা তাকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করেন এবং সেই মুসিবতের পরিবর্তে উত্তম বদলা দান করেন উম্মুল মুমিনীন বলেন, আমার স্বামী আবু সালাম মারা যাওয়ার পর আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথামতো আমল করেছি। পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে আল্লাহপাক আমাকে উত্তম বদলা দান করেন। হজরত আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মালাকুল মউত, তুমি কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করেছ? তুমি কি তার নয়নের মণি ও কলিজার টুকরাকে কবজ করেছ? ফেরেশতা বললেন হ্যাঁ। আল্লাহপাক বলেন, আমার বান্দা কী বলেছে? মালাকুল মউত বলেন সে আপানার প্রশংসা করেছে এবং ‘‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’’ পাঠ করেছে। আল্লাহতায়ালা তখন বলেন, জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং সে গৃহের নাম রাখ বাইতুল হামদ।-জামে তিরমিযী; মুসনাদে আহমদ হোসাইন ইবনে আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, কোনো মুসিলম নর-নারী বিপদগ্রস্ত হওয়ার অনেক দিন পর বিপদের কথা স্মরণ করে যদি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’’ পাঠ করে তবে আল্লাহপাক তাকে বিপদের দিন পাঠ করার সওয়াব দান করবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।