পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকার বাল্যবিয়ে রোধে নানা উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তানের বয়স লুকিয়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। রাতের আঁধারে গোপনেই সারা হচ্ছে বিয়ের আয়োজন। জন্মসনদে অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের বয়স বাড়িয়ে কৌশলে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব বিয়ে থামালেও গোপনে আয়োজন করায় অনেক ক্ষেত্রেই তা থামানো সম্ভব হচ্ছে না।
বাল্যবিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ গত বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ শতাংশ কিশোরীর তাদের ১৮ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর ১৫ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে দেওয়া হয় ২২ শতাংশ কিশোরীকে। ‘গার্লস নট ব্রাইড’ নামে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা ২০১৭ সালে প্রকাশিত তথ্যে, রংপুরে গড়ে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর রাজশাহী ও খুলনায় ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দরিদ্র পরিবারগুলোতে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মেয়ের চেহারার আকর্ষণ কমে যাবে আর তখন বিয়েতে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিতে হবে, এ ধারণা থেকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে বিয়ের আগে মেয়েরা যাতে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে এবং পরিবারের সুনাম বজায় রাখতে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার পরিবারগুলো, বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারগুলো সংসারের খরচ বাঁচাতে এবং কন্যাসন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পেরে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু ইউনিয়ন ও জেলাকে বাল্যবিয়েমুক্ত ঘোষণা করেছে।
দেশে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে নারী সংগঠনগুলো সর্বদাই সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ। বাল্যবিবাহ নিয়ে কিছু আইনকানুনও আছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও মাঝে মধ্যে এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়। কিন্তু বাল্যবিয়ের প্রকোপ কমছে না। রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে এ বিষয়ে কিছু জনসচেতনতা লক্ষ করা গেলেও বস্তি অঞ্চল, গ্রামাঞ্চল ও চরাঞ্চলে অবস্থা ভিন্নতর। উত্তরাঞ্চলেও বাল্যবিয়ের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে যেসব বিষয়কে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: মেয়েদের ক্ষেত্রে শিক্ষার সুযোগের অভাব, অর্থনৈতিক সুযোগ ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, চরম দারিদ্র্য, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা ও আইনগত প্রক্রিয়া, সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি। উদ্বেগজনক তথ্য হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ কর্তৃক যৌন নির্যাতন ও চরম জেন্ডার অসমতাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা এবং যৌক্তিক বলে মেনে নেয়া অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে। সে অবস্থায় শৈশব ও কৈশোরে একটি মেয়ে স্কুলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিজেকে অনিরাপদ বোধ করবে সেটাই স্বাভাবিক। সে অবস্থায় একটি মেয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অথবা তার পরিবার থেকে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন, প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও সরকার তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজে অতি প্রাচীন একটি রোগ। শিক্ষা ও সভ্যতার আলো বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ থেকে সমাজ ক্রমশ মুক্তি লাভ করছে। কিন্তু সমাজে এখনো এমন মানুষের সংখ্যা অনেক, যাঁরা এই রোগ থেকে মুক্ত নন। তাঁরা মেয়ের জন্য ভালো কোনো ‘সম্বন্ধ’ এলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মেয়ের বয়সের দিকে না তাকিয়েই ‘উপযুক্ত’ পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া শুরু করেন। অথচ এই কাজটির মাধ্যমে মেয়ের কত বড় ক্ষতি করতে যাচ্ছেন, তা একবারও ভাবেন না। মেয়ের শারীরিক বৃদ্ধি বা পরিবর্তন পূর্ণতা পাওয়ার আগে বিয়ে দিলে কী ধরনের ক্ষতি হয়, সে সম্পর্কেও তাঁদের বিশেষ জ্ঞান নেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সমাজের অগ্রসর নাগরিকদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে রোধে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চাই, বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ দ্রুত মুক্তি পাক।
লেখক: সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।