পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আগামী পরশু ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি থাকবে সুপ্রীমকোর্টের ওপর। এখানে সম্ভবত একটি কথা খোলাসা করে রাখা দরকার। সমস্ত হাইকোর্ট ভবন তথা উচ্চ আদালতকে বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট বলে। কিন্তু ইন্ডিয়া, পাকিস্তান বা এই ধরণের ফেডারেল রাষ্ট্রে হাইকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্টের আলাদা সত্ত্বা রয়েছে। প্রতিটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠিত হয় একাধিক প্রদেশ নিয়ে। একটি প্রদেশের সর্বোচ্চ আদালতকে বলা হয় হাইর্কোট। তাই একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে যতগুলি প্রদেশ থাকে, ততগুলি হাইকোর্টও থাকে। (কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। অবশ্য এখানে সেটি এমন গুরুত্বপূর্ণ নয়)। সবগুলি হাইকোর্টের মাথার ওপর থাকে একটি কোর্ট। এর নাম সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্ট ফেডারেল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়। সুপ্রীমকোর্টের রায় ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রদেশে বা রাজ্যে পালন করা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা ঠিক সেই রকম নয়। বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা ইউনিটারী বা এক কেন্দ্রিক। কারণ এখানে একটিমাত্র প্রদেশই রয়েছে। বাংলাদেশে একটিই প্রদেশ এবং সেই একটি প্রদেশই হলো একটি দেশ বা রাষ্ট্র। জেনারেল এরশাদ যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি কয়েকটি জেলায় হাইকোর্ট স্থাপন করেছিলেন। তখন কিন্তু হাইকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্ট দুটোই ছিল। পরবর্তীতে মফস্বল থেকে হাইকোর্ট বিলুপ্ত করা হয়। নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী হাইকোর্ট ভবনে অবস্থিত সমগ্র উচ্চ বিচারালয়কেই নাম দেওয়া হয় সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়।এক ভাগ হল হাইকোর্ট বিভাগ। আরেক ভাগ হলো আপীল বিভাগ। আসলে এই আপীল বিভাগটিই হলো সুপ্রীমকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি আপীল বিভাগে আপীল করতে পারেন। আপীল বিভাগ যে রায় দেবেন সেটি হবে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং সেই রায় সংশ্লিষ্ট সকলে মানতে বাধ্য থাকবেন।
দুইটি মামলায় বেগম জিয়ার শাস্তি হয়েছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায়, বেগম জিয়ার শাস্তি হয়েছে ৭ বছর। আর অরফানেজ মামলায় বেগম জিয়ার শাস্তি হয়েছে ১০ বছর। উভয় মামলাতেই দন্ড প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। উভয় দন্ডের বিরুদ্ধেই সুপ্রীমকোর্টে অর্থাৎ আপীল বিভাগে আপীল করা হয়েছে। আগামী ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আপীল বিভাগে আপীল চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আপীলের শুনানী হবে। ধারণা করা হচ্ছে, শুনানীর দিনেই আপীল বিভাগের রায়ও ঘোষিত হবে।
দুই
সকল দেশবাসীর দৃষ্টি সুপ্রীমকোর্টের দিকে থাকবে। সেটি নিয়ে আমি কিছুক্ষণ পর আলোচনা করছি। তার আগে আমার দুটি প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন হলো, ১২ ডিসেম্বরের মামলায় জামিন পেলে বেগম জিয়া কারামুক্ত হবেন এমন ধারণা বিএনপি বা জাতীয়তাবাদী মহলের হলো কেন? যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় ১২ ডিসেম্বর বেগম জিয়া জামিন পেলেন; তাহলেও তো তিনি কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না। কারণ তার পরেও ঝুলে থাকছে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। ঐ মামলায় তার কারাদন্ড হয়েছে ১০ বছর। সেই মামলাতেও তো জামিন পেতে হবে। ঐ দুটি মামলায় জামিন পেলে তবেই তিনি কারামুক্ত হতে পারবেন। বিএনপির আইনজীবী নেতৃবৃন্দ এবং নেতা ও কর্মীবৃন্দ এই দিকটি বিবেচনা করছেন কিনা, সেটি আমরা জানিনা। বিএনপির দুজন সিনিয়র আইনজীবী বলেছেন, তারা এখনো আশা করছেন, উচ্চ আদালত থেকে বেগম জিয়া জামিন পাবেন। তাদের এই আশাবাদের ভিত্তি কি সেটি সাধারণ জনগণ বুঝতে অক্ষম।
বিএনপি এই মামলাটি আপীল বিভাগে অর্থাৎ সুপ্রীমকোর্টে নিয়ে গেল কেন, সেটি আমার বোধগম্য হচ্ছে না। বেগম জিয়াকে দন্ড দানের ব্যাপারে সরকারের যে কতখানি হাত ছিলো, সেটা বিএনপি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। সেই সরকার তাকে জামিন দেবে, এমন উদ্ভট চিন্তা বিএনপি করে কিভাবে? অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নিম্ন আদালত তাকে সাজা দিয়েছিলেন ৫ বছর। হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে আপীল নিয়ে গেলে সেই সাজা মওকুফ করাতো দূরের কথা, উল্টো সাজা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়েছে। এখন সুপ্রীমকোর্ট বা আপীল বিভাগ সেখানে তাকে জামিন দিয়ে মুক্ত করবে, এমন ভাবনা বিএনপির মাথায় আসে কি করে? এখন বিষয়টিকে উল্টোভাবে বিবেচনা করা যাক। আগামী ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্ট যদি জামিন রিফিউজ করে তাহলে বেগম জিয়ার অবস্থাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? প্রথম দফায় ৭ বছরের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আর যদি জামিন রিফিউজ হয় তাহলে পরের মামলা অর্থাৎ অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা সম্পর্কে এ্যাটিচ্যুটও পরিষ্কার হয়ে যায়।
এখন বেগম জিয়ার বয়স ৭৫ বছর। আগামী ১০ বছর পর তার বয়স হবে ৮৫ বছর। ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কি জেলের ঘানি টানতে থাকবেন? সুপ্রীমকোর্ট যদি জামিন প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন, তাহলে জেলের ঘানি না টেনে বেগম জিয়ার উপায় কি? সেই জন্যই প্রশ্ন তুলেছি যে, কোন বিবেচনায় বিএনপি মামলাটি সুপ্রীমকোর্ট বা আপীল বিভাগে নিয়ে গেল? অন্যভাবে চিন্তা করলে এর একটি কারণ থাকতে পারে, যেটি খালেদা ভক্তদের কাছে মোটেই পছন্দনীয় হবে না। সেটি হলো, সরকারের সাথে গোপন সমঝোতা। সেই গোপন সমঝোতা হলে তিনি জামিন পেতে পারেন। তবে তাকে দেশে থাকতে দেওয়া হবে কিনা, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তিন
গত ৫ ডিসেম্বর খালেদার জামিন নিয়ে এজলাসে যে হট্টগোল হয় সেই ব্যাপারে সুপ্রীমকোর্টের মন্তব্য হলো এই যে, এই ধরণের ঘটনা সুপ্রীমকোর্ট আর ঘটেনি। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের উদ্দেশ্য করে সুপ্রীমকোর্ট থেকে বলা হয়েছে, বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সুপ্রীমকোর্টে সেদিন যেটা ঘটে গেল সেটি যদি বাড়াবাড়ি হয় তাহলে বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ যেটা করেছিল সেটাকে তারা কি বলবেন? সেদিন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ওমরের প্রাডো গাড়ী ভাঙ্গা হয়েছিল এবং সেটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রধান বিচারপতির চেম্বারে একাধিকবার লাথি মেরে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতির চেম্বারের যারা হানা দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরবর্তীকালে তিনি আপীল বিভাগের বিচারপতি হয়েছিলেন এবং প্রধানবিচারপতি সিনহার সাথে দ্ব›েদ্ব জড়িয়েছিলেন।
বেগম জিয়ার প্রতি সরকারের এ্যাটিচুডের পটভ‚মিতে বিএনপি কেন সুপ্রীমকোর্টে গেল? যদি বেগম জিয়ার জামিন সেখানেও অস্বীকার করা হয় তাহলে বিএনপি পরবর্তী কর্মসূচি কি হবে? আইনের সমস্ত রাস্তা তো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন খোলা থাকবে মাত্র দুটি রাস্তা। এক, প্যারোলে মুক্তি ভিক্ষা করা। দুই. প্যারোলে মুক্তি ভিক্ষা না করলে দুর্বার গণআন্দোলনে তাঁকে মুক্ত করা। প্যারোল দেওয়ার জন্য সরকার তো এক পায়ে খাড়া। বিএনপির আপোষকামী অংশ, যারা আন্দোলন ভয় পায়, তারা প্যারোলের চেষ্টা করেছিলেন। বেগম জিয়া রাজী হননি। তাঁর নিকট আত্মীয়রাও প্যারোলের চেষ্টা করেছিলেন। বেগম জিয়া সেখানেও রাজি হননি। এখন কি তিনি রাজী হবেন?
সেক্ষেত্রে খোলা থাকে একটিই মাত্র পথ। আর সেটি হলো দুর্বার গণআন্দোলন। সেটি হতে হবে যেসে গণআন্দোলন নয়,একেবারে গণঅভ্যুত্থানের মত আন্দোলন। বিগত ১১ বছরে বিএনপি নেতৃবৃন্দের কথাবার্তা এবং কার্যকলাপে মনে হচ্ছে, দুর্বার গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে তাদের হয় কোনো অভিজ্ঞতা নাই অথবা ধারণা নাই। থাকলে এই ১১ বছরে তারা এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতেন। কারণ, তারা তো এই ১১ বছরে শত শত ইস্যু পেয়েছিলেন। একটি ইস্যুও ক্যাচ করতে পারেননি। উল্টো তারা নেতৃত্বের জন্য ছুটে গেছেন ড. বি চৌধুরীর দুয়ারে। ধর্ণা দিয়েছেন ড. কামাল হোসেনের দ্বারে। ফলাফল কি হয়েছে সেটিতো তারা পেয়েছেন হাতে হাতে। মাত্র ৬টি সংসদ আসন পেয়ে খুশি থাকতে হয়েছে।
২০১৫ সালে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল আজ ২০১৯ সালে একই ভূমিকা আছে। এই সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে ততদিন তাই থাকবে। অনেকেই বলেন, সরকার টিকে আছে পুলিশ, র্যাব এবং সিভিল প্রশাসনের জোরে। গণআন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হলে র্যাব, পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসন অবশ্যই প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সেটি ভাঙার মত সাহস বা ইচ্ছা কি বিএনপির আছে?
সর্বশেষ অবস্থায় মনে হচ্ছে , বিএনপি গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথেই হাঁটছে। ছাত্রদল, যুবদল, বিএনপি গত সপ্তাহে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বেগম জিয়ার জামিন রিফিউজ হলে এই ডিসেম্বরেই রাজপথ উত্তপ্ত হবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।