Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নারী নির্যাতন বন্ধে সকলের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে

পারভীন রেজা | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আজকাল খবরের পাতা খুললেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যা অথবা গুম, যৌতুকের বলি, এসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিবাহ, নারী পাচার, পতিতাবৃত্তি, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নানামুখী অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনা যেন প্রতিদিনের স্বাভাবিক খবরে পরিণত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী মানুষরূপী নরপশুদের হাতে নিযার্তিত হচ্ছে। নিযার্তিতদের মধ্যে কেউ প্রতিকারে আইনের আশ্রয় নিলেও অনেকেই অর্থ, শক্তি ও সামর্থ্য না থাকায় এবং পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও আইনের আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকছে, যা দুঃখজনক। অনেকে আবার এধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানায় ও আদালতে যাওয়াকে মানহানিকর ও চক্ষুলজ্জা ভয় করে। ফলে অনেকেই এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিযার্তিত নারীর অভিভাবকদের যৎসামান্য অর্থ দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, প্রভাবশালী, রাজনীতিবিদ বা গ্রামের পঞ্চায়েত, কমিশনার ও মাতব্বরদের মাধ্যমে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশেষ করে এই সমাজে ওইসব বিকৃত অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যুগ যুগ ধরে নারী তার প্রাপ্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় প্রাপ্তির খাতা প্রায় শূন্য। নারী ক্ষমতায়নের ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হলেও নির্যাতন ও সহিংসতার ক্ষেত্রে ক্রমেই অবনতি ঘটছে। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, মিডিয়ায় চলার পথে নারী বঞ্চনা আর অশালীন আচরণের শিকার। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা আদর্শিক, জাতিগত সহিংসতা থেকেও মুক্ত নয়। আজ নারী নির্যাতন শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুই নয়- ঘরে বাইরে কোথাও তারা নিরাপদ নয়।

আমাদের সমাজে নারী নির্যাতিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। যদিও আমরা ঘটা করে প্রচার করছি যৌতুক একটা সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া দুটোই অপরাধ। কিন্তু আমাদের প্রচার-প্রচারণা আদৌ সুফল বয়ে আনছে কি? বরং দেখা যাচ্ছে, অভিভাবকরা মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে সর্বসান্ত হচ্ছেন। যৌতুকের টাকা হাতে না পেলে কিছু পশু স্বভাবের পুরুষ স্ত্রীকে বেদমভাবে প্রহার করছে। কখনো বা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে স্ত্রীর মুখে এসিড মারতেও দ্বিধা করছে না। দ্বিতীয়ত, কারো ভালোবাসার ডাকে সাড়া না দিলেও নারীকে হতে হচ্ছে লাঞ্ছিত। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।

দেশের সংবিধান অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমান অধিকারী। কিন্তু এই অধিকার নারীরা কতটুকু পান? তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পুরুষ শাসিত এই সমাজে নারীদের কোনো কর্মকান্ডই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। অথচ আমাদের জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষ পদে থেকে বিগত দুই দশক ধরে নারীরা দেশ পরিচালনা করছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশ নারী নির্যাতনের মূল হোতা আরেকজন নারী। যেমন বলা যায়, একজন মেয়ে বিয়ের পর সর্বপ্রথম শাশুড়ি বা ননদের কাছেই অনেক সময় নিগৃহীত হয়। এ ছাড়া গৃহকর্ত্রীর কাছে মেয়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা সবার জানা।

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত আইন ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-২০০৮, হাইকোর্ট নির্দেশিত যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা-২০০৮ পাস হয়েছে। এখন কথা হলো, এত ধরনের আইন বা নীতিমালা থাকা সত্তে¡ও কেন বন্ধ হচ্ছে না নারীর প্রতি সহিংস ঘটনা। তা ছাড়া দেশের নারী সমাজের আন্দোলন তো থেমে নেই। মনে রাখতে হবে, নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু আইন করেই বন্ধ করা যাবে না, এ জন্য চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও রাষ্ট্রকে অধিকতর আন্তরিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নিরাপত্তা জোরদার করাটা জরুরি, সে সঙ্গে রাজনীতি থেকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দূর করতে হবে। সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনয়ন করা প্রয়োজন। নারীর এ সহিংসতা রোধে আমাদের আরো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ব্যক্তি থেকে সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। এ ক্ষেত্রে নিজে নির্যাতন থেকে দূরে থাকলেই চলবে না, সে সঙ্গে আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া যে কোনো নির্যাতনেরই প্রতিবাদ করতে হবে। সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমার কথা, এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সচেতন নারীরা এবং তারা ক্রমাগত আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এ আন্দোলনের সঙ্গে সচেতন পুরুষরাও এগিয়ে এসেছেন। যদিও সংখ্যাগত দিক থেকে তা অনেক কম। একটা সময় ছিল নারীকে নির্যাতন করা যে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেটা অনেকেই জানত না। তখন নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না বা নির্যাতনের কথা জানানোর কোনো জায়গা ছিল না। এখন গণমাধ্যমের সুবাদে মানুষ এ বিষয়গুলো সহজে জানতে পারছে। যদিও তা সংখ্যায় অনেক কম। যেমন ১০০ জন নারী নির্যাতিত হলে রিপোর্ট হচ্ছে ১০ জনের। দেশের তিনটি রপ্তানিকারক পণ্যের অধিকাংশ শ্রমিক নারী। এর মধ্যে চা, গার্মেন্ট ও হিমায়িত খাদ্যে ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক কাজ করেন। ৭০ ভাগ নারী কৃষিক্ষেত্রে কাজ করছেন। সুতরাং নারীকে বাদ দিয়ে কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে নারী অধিকার ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুগুলো যুক্ত করতে হবে। আমাদের ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, যানবাহন প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে তার পরিবার ও নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে প্রচলিত যে আইন রয়েছে পারিবারিক সহিংসতা রোধে তা যথেষ্ট নয়। বেশিরভাগ পরিবারে পারিবারিক সহিংসতাকে খুব হালকাভাবে দেখা হয়। অথচ এটি যে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে সেটি অনেকেই জানেন না। এ সহিংসতা নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। হরহামেশাই নারী শারীরিক মানসিক, অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হন। এ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য অর্থাৎ ঘরের ভেতরে নারীর সম্মানজনক অবস্থানে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা, পারিবারিক সহিংসতা যে একটি গুরুতর অপরাধ এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়গুলো খুব জরুরি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারে, সেই সঙ্গে পারিবারিক শিক্ষা। নৈতিক-সামাজিক শিক্ষা পুরুষদের জন্য সবচেয়ে জরুরি, এমন ধারণা তৈরি করতে হবে যে, নারী ভোগ্যপণ্য নয়, এক সারিতে নারী-পুরুষ সমমর্যাদায় সমাজে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব প্রশাসনের ও বিচার বিভাগের, যাতে নারী নির্যাতন অপরাধের সঠিক তদন্ত ও সুবিচার হয়। যৌণ হয়রানি প্রতিরোধে এখন প্রয়োজন নতুন আইন প্রণয়ন ও আদালত প্রতিষ্ঠা এবং নারী নির্যাতনের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা।

নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে প্রথমত নারী ও পুরুষ উভয়েই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। লিঙ্গ সমতার প্রতি সকলের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পুরুষদের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন, নৈতিকতার ও চারিত্রিক দিকের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নারীকে তার যোগ্য মর্যদা দিতে হবে। মেয়েরা ঘরে এবং বাহিরে সচেতন থাকতে হবে। পিতা, মাতা তার সন্তানের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কর্মমুখী নারীদের কর্মস্থল সম্পর্কে পূর্ব ধারনা নেওয়া আবশ্যক। একজন নারী যখন বুঝবে শ্বশুর বাড়ী তার জন্য নিরাপদ নয়, তবে জেনেশুনে অত্যাচারিত হওয়ার কোনো মানে নেই। সে হয় আইনের আশ্রয় নিবে অথবা শ্বশুর বাড়ী ত্যাগ করবে।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুধু নারীদের সচেতন হলেই হবে না। একজন পুরুষকেও নারী নির্যাতন বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরী। নারী নির্যাতনের ধরন, এর কুফল এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দেশে যে আইন আছে তা জানা, মেনে চলা ও আশপাশের সবাইকে সচেতন করে তোলা জরুরী। সবার আগে নিজ পরিবারকেই নারী নির্যাতনমুক্ত করতে হবে। কোনো ভাই, বন্ধু, সহপাঠী বা সহকর্মী যদি কোনো নারীর প্রতি নির্যাতনমূলক আচরণ করে, তবে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে বোঝাতে হবে। চুপ করে না থেকে সবাই মিলে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং পুলিশের সহায়তা নিতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যহীন ও সম্মানজনক আচরণ করে অন্যদের, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এবং তাদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠতে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যারা কাজ করছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।



 

Show all comments
  • jack ali ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৪:৪৭ পিএম says : 0
    There is only solution that we have to rule our beloved country by the Law of Qur'an..
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন