পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোনো মুসলমান মহিলা শিক্ষকতা করছেন, কিংবা মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছেন, এটা আজ আর বিস্ময় জাগাতে পারেনা। অথচ আজ থেকে ৮০/৮৫ বছর আগে যখন মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল নামের স্কুলটি আরম্ভ করেছিলেন, তখন তাঁকে প্রচন্ড বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর এ হেন কান্ড দেখে মুসলিম সমাজ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ড রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে, সমস্ত নিন্দা গ্লানি হাসি মুখে মাথায় তুলে নিয়ে মহীয়সী এ নারী সে দিন মুসলিম মেয়েদের মুক্তির জন্য, তাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে অবিচল চিত্তে, দৃঢ়ভাবে কাজ করে গেছেন।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর বাবা জহিরুদ্দিন মহম্মদ পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন বটে তবে মেয়েদের শিক্ষা দেবার প্রশ্নে ছিলেন উদাসীন। রোকেয়া তাঁর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ পান। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের উচ্চশিক্ষিত, উদারমনস্ক পুরুষ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হলে রোকেয়া সেখানেই চলে যান। রোকেয়ার মতো সৈয়দ সাখাওয়াতও চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি, নারী সমাজে শিক্ষাবিস্তার তথা নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি। বেগম রোকেয়ার বিবাহিত জীবন মাত্র ১৩ বছরের। সাখাওয়াত হোসেনের অকালমৃত্যু হয় ১৯০৯ সালে। অকালেই তাঁদের দুটো কন্যা সন্তানেরও মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর সঞ্চিত টাকা থেকে স্ত্রী রোকেয়ার জন্য দশ হাজার টাকা সাহায্য হিসাবে আলাদা করে রেখে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ভাগলপুরের বাড়িতেই রোকেয়া মাত্র ৫/৬ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ১লা অক্টোবর সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সদ্য প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি ও উদ্দেশ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এ নাম। কিন্তু নানা কারণে একাকী তাঁর পক্ষে ভাগলপুরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়লে রোকেয়া কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন, শতকরা ১০০ জন অশিক্ষিত মুসলিম নারীর মধ্যে জাগৃতি আনতে হলে এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, আপনারা বিবেচনা করে দেখুন, হযরত মোহাম্মদ (স.) তেরশত বৎসর পূর্বে শিক্ষার উপকারিতা সম্বন্ধে কী বলেছিলেন- বিদ্যাশিক্ষা কর, যে বিদ্যাশিক্ষা করে সে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হয়, যে বিদ্যাচর্চা করে সে আমার স্তব করে, যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে উপাসনা করে। ... বন্ধু সভায় বিদ্যা অলংকার স^রূপ, শত্রু সম্মুখে অস্ত্রস্বরূপ। ... যাঁহারা মোহাম্মদের (সা.) নামে প্রাণদানে প্রস্তুত হন, তারা তাঁর সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? ... কন্যাকে শিক্ষা দেওয়া আমাদের প্রিয় নবী ফরজ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলিয়াছেন, তবু কেন তাঁহার কন্যারা শিক্ষায় উদাসীন? (মতিচুর ২য় খন্ড)।
বেগম রোকেয়া পর্দা প্রথার বিরোধী ছিলেন না। তবে গোড়ামির বিরোধী ছিলেন। তিনি উগ্র নারীবাদীদের মতো বোরকা ছিঁড়ে ফেলে দেননি বরং তিনি সমাজের কথা চিন্তা করে বোরকা প্রথা মেনে চলতেন কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে আগে জাগিয়ে তোলা। তিনি সওগাত সম্পাদককে লেখা চিঠিতে বলেছেন, আমি যে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অবরোধবাসিনী হয়েছি তার কারণ আছে। আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম-কানুনগুলোও পালন করেছি। অবস্থা এরূপ এখন যে আমি পর্দার আড়ালে থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এটাও হয়তো দোষণীয় হয়ে পড়ছে। আমি বাড়িতে বাড়িতে ক্যানভাস করে মেয়ে আনতে যাই, কিন্তু অভিভাবকরা আমাকে আগেই জিজ্ঞেস করেন, পর্দাপালন করা হয় কি না? অতটুকু ছোট মেয়ের বেলায়ও এ প্রশ্ন। এখন বুঝুন, কী পরিস্থিতির মাঝে স্কুল চালাচ্ছি, আর ব্যক্তিগতভাবে আমার অবস্থাই বা কীরূপ? স্কুলের জন্য আমি সমাজের সকল অবিচার, অত্যাচার সহ্য করেছি।’ পর্দা প্রথা সম্বন্ধে বোরখা প্রবন্ধে লিখেছেন ‘আমরা পর্দার অপ্রয়োজনীয় অংশ ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। রোকেয়া কথাগুলো যে যুগে দাঁড়িয়ে বলেছেন ে স যুগে নারীরা, বিশেষত মুসলিম নারীরা ছিলেন অন্তঃপুরচারিণী, অসূর্যস্পর্শা। শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং ঘরের অভ্যন্তরীন কাজ চালানোই ছিল তাদের কাজ। কোনও অভিযোগ কিংবা আকাঙ্খা ব্যক্ত করার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না তারা। তার ওপর ছিল যখন তখন তালাক-এর নির্মম আঘাত। এ তালাক প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনের শেষ প্রবন্ধ নারীর অধিকার -এ লিখছেন, আমাদের উত্তরবঙ্গে দেখেছি গৃহস্থ শ্রেণীর মধ্যে সর্বদা তালাক হয়, অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীকে সামান্য অপরাধে পরিত্যাগ করে। মেয়েটির কোনও ত্রুটি হলেই স্বামী দম্ভ করে প্রচার করে আমি ওকে তালাক দেব, আজই দেব। এ রকম ঘটনা সবসময়ই ঘটত। এ সময়ে পুরুষটিকে খুব প্রফুল্ল দেখা যায়। বোধহয় নতুন পত্মী লাভ হবে তাই এ আনন্দে। যুগের সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও রোকেয়ার চিন্তাধারা কত আধুনিক ছিল তার প্রমাণ মিলে নারী সমাজের শৃঙ্খলিত হওয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি লিখেছেন, আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজে বন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোনও অজ্ঞাত কারণ বশত মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করতে লাগল, অপর অংশ (নারী) তার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করতে পারল না বলে পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিনী না হয়ে দাসি হয়ে পড়ল। আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলংকারগুলো এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। এখন ইহা সৌন্দর্য বর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মতে অলংকার দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ (Originally badges of slavery)। তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায়ে লৌহ নির্মিত বেড়ি পরে, আমরাও (আদরের জিনিস বলে) স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ মল পরি। উহাদের হাতঘড়ী লৌহ নির্মিত, আমাদের হাতঘড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত চুড়ি। ... আমরা দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করেও আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করি- গর্বে ফীতা হই।’ (মতিচুর-১) এ প্রসঙ্গে রোকেয়া তথাকথিত নারীবাদী নন, যাঁরা নারী স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দেন, যাঁদের কাছে নারী স্বাধীনতার অর্থ হল, পুরুষের মতো সিগারেট খাওয়া কিংবা ‘রক্ষিতার পরিবর্তে ‘রক্ষিত রাখার কথা চিন্তা করা।
বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ হল মতিচুর (১ম ও ২য় খন্ড), সুলতানার স্বপ্ন, পদ¥রাগ, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ হল বাসিফুল শশধব নলিনী ও কুমুদ কাঞ্চনজঙ্খা আপীল চাঁদ ইত্যাদি। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের কাহীনি নিয়ে পদ¥রাগ নামের একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন রোকেয়া। ষোলটি প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯১৬ সালে তিনি নারীদের সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম নামের নারী সমিতি গঠন করেন। তাঁর সমিতিতে হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। সমাজের উঁচু তলার, লেডি ফারুকি, লেডি অবলা বসু যেমন এ সংগঠনের সদস্য ছিলেন তেমনি সমাজের অবহেলিত অশিক্ষিত নারীরাও ছিলেন।
জীবনের শুরুতে দাদী করিমুন্নেসার উৎসাহে আর উদারমনস্ক দাদা ইব্রাহিম সাহেবের কাছে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল। উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তিনি দক্ষতা লাভ করেছিলেন। তাঁর এ শিক্ষার উৎসাহ ও যাত্রা অব্যাহত থাকে উদারমনস্ক পুরুষ, তাঁর জীবনসঙ্গী সাখাওয়াত সাহেবের জন্য, আর বেগম রোকেয়া তাঁর এ অর্জিত শিক্ষার আলো সমস্ত নারী সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে, নারী মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে মাত্র ৫২ বছর বয়সে হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর এ মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয়। ১১ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এক বিরাট শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন এক শোকবার্তায় তাঁকে pioneer of higher education among Muslim girls in this province বলে আখ্যায়িত করেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।