পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘কচু ছাড়া সব কিছুতেই এখন ফর্মালিন।’ বরাবরই তিনি সত্যকথা অকপটে বলেন। সত্যিই, সব খাবারেই এখন ভেজাল। ভেজাল খেয়ে আমরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। ভেজালের এমন মহোৎসব দেখে আমার চাচা বলতেন, ‘কম খাবারে কম ভেজাল। তিনি আমাদের কম খাবার খেতে পরামর্শ দিতেন। তিনি বেঁচে নেই, অর্ধজীবন পার না করতেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চাচার কথার মর্মার্থ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। যখন কলেজে পড়ি, তখন এক বন্ধুর সাথে খুব ভাব হয় আমার। সে ছিলো আমার জানের দোস্ত। ফুসফুসে ক্যান্সারে প্রাণের সেই দোস্ত মারা গেছে। আমার এলাকার (নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ) এক সাবেক জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান মোবাইলে কান্না জড়িত কণ্ঠে আমার কাছে ক্ষমা চাইছিলেন। কী হয়েছে বলতেই তিনি জানালেন, ডাক্তার তাঁকে জনিয়েছেন, ৮০ ভাগ লিভারই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। বলা বাহুল্য, খাদ্যে ভেজালের জন্যই এমন হচ্ছে। ভেজালে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। বোধ করি খাদ্যে এমন ভেজাল আর কোনো দেশে নেই।
খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট তিন বছরের খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ৫০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল পেয়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গবেষণা জরিপ করে দেখেছে যে, দেশের মোট খাদ্যের ৩০ শতাংশে ভেজাল রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৬৬ শতাংশ রেস্তোরাঁর খাবার, ৯৬ শতাংশ মিষ্টি, ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি, ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি। এসব খেয়ে দেশের মানুষ আর সুস্থ নেই। গোটা দেশটাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
মাঝে মাঝে ভাবী, এসব কী হচ্ছে দেশে। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে না তো? কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার মাথার চুলে চোখ পড়তেই চোখ যেন ছানাবড়া। সাদা চুলে আটকে গেল চোখ। অসংখ্য চুলে পাক ধরেছে। ভাগ্নেটার চোখে মোটা পাওয়ারওয়ালা চশমা। বিছানায় কাতরাচ্ছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত চাচি। কান্সারে মারা গেছেন বড় মামা, চাচা। লিভার নষ্ট হয়ে অকালেই দুনিয়া ছেড়েছেন ভগ্নিপতি। খাবারে ভেজালের জন্যই এমন হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? মাছ, ফলমূল, তরকারিতে কোথায় নেই এই জীবন হন্তারক ফরমালিন। তেলে ভেজাল, এমনকি নুনেও ভেজাল। কেউ কেউ তো বলেনই বিষেও নাকি ভেজাল। তাই যা হওয়ার নয়, তাই হচ্ছে। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, ক্যান্সার আর হার্টস্ট্রোকে অহরহ মানুষ মরছে। বিষ খেয়ে এভাবে মানুষ মরছে; আমরা চুপ করে থাকি কী করে? যারা ভেজাল খাবারমুক্ত দেশ গড়ার ক্ষমতা রাখেন তারা কি করে চুপ থাকতে পারেন? মনে রাখবেন, আপনি, আমি, আমরা, আমাদের সন্তান, পিতা-মাতা, স্বজন কেউ এখন আর নিরাপদ নন। সব কিছু শেষ হয়ে যাবার আগেই আমাদের ভাবতে হবে।
ভেজাল রোধে কোনো সরকারই সচেষ্ট নয়। ফরমালিনের ব্যাপারে বর্তমান সরকার কঠোর হলেও থেমে নেই ফরমালিনের ব্যবহার। তাই ভেজাল খাদ্যে ভরে গেছে দেশ। আমরা যা খাচ্ছি তার অধিকাংকই ভেজালে ভরা। সেদিন রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এক ছাত্রের প্রশ্ন ছিল এমন- ‘বাবা! কচুতে মাছি, ফলে নেই কেন?’ বাবার কাছে প্রশ্নটা করলেও উত্তরটা কিন্তু তার ঠিকই জানা। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক এক গবেষণার তথ্য মতে, এদেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি খাবারে ভয়ংকর সব রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। যারা ভেজাল মেশায় তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। খাদ্যে ভেজালে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। সেই সঙ্গে অপরাধীদের ধরে সাজা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে সরকারকে আরও অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে একজন স্যানেটারি ইন্সপেক্টর দিয়ে কখনই ভেজাল রোধ হবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের গতি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও সকল পৌরসভা তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল স্যানেটারি ইন্সপেক্টরকে যুক্ত করলে অতি দ্রুত ভেজালের বিরুদ্ধে উদ্যোগটি সফলতার মুখ দেখবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সরকারি ও বেসরকারি যেসব সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে তাদের সাথে নাগরিক সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
ভেজাল ঠেকাতেই দেশে বিএসটিআই রয়েছে। জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেই বা কী করছে? এ প্রতিষ্ঠানটির সুফল আশান্বিত হওয়ার মতো নয়। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়। তারপরও ভেজাল রোধ হয় না কেন? এ বিষয়ে দেশে আইন আছে; সেই আইনে কারও কখনো শাস্তি হয় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে কখনোই সচেতন হয়ে ওঠে না। জনগণও না। দেশে বছরজুড়েই নানা ইস্যুতে আন্দোলন হয়, হরতাল-অবরোধ হয়; কিন্তু ভেজালের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দেয়া হয় না কখনো। আন্দোলন তো দূরের কথা ভেজালের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করে না কেউ। তাঁরা (রাজনৈতিকরা) চাইলে কয়েক মাসেই ৮০ থেকে ৯০ ভাগ খাদ্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব। প্রকৃতই ভেজালকারীদের সংখ্যা এত বেশি যে, ভেজালের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমাদের রাজনৈতিকদের উল্টো না ভেজালে জড়িয়ে পড়তে হয় এ ভয়ে হয়তো তারা একদম রা (শব্দ) করেন না। ফলে আজ ভেজাল খেয়ে আমাদের এ কী অবস্থা! হাসপাতালগুলোতে কত ধরনের রোগ-বালাই নিয়েই না ছুটছে মানুষ। মানুষ যত না বাড়ছে তুলনামূলক হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে। যে উপজেলায় আমার জন্ম সেখানে ১০ বছর আগে ২ লাখ লোকের জন্য ছিল সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দ’ুটি হাসপাতাল। এখন তিন লাখ লোকের জন্য হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ১১টি। আমি নিজেও একটি হাসপাতালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি। গত দশ বছরে ওই হাসপাতালের আয় ৪ গুণ বেড়েছে। এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ নয়। রোগবালাই রেড়েছে তাই রোগির ভিড় বেড়েছে। এ কথা সত্য যে, ভেজাল খেয়ে মানুষ শুধু অসুস্থই হচ্ছে না, প্রতিদিন মরছে অসংখ্য মানুষ। ভেজাল রোধ না হলে, খাদ্যে ভেজালের গতি এমনটাই যদি থাকে তাহলে যে হারে মানুষ মরবে তা শুধু দেশবাসীকেই নয়, যারা সারাবিশে^ স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন তাদেরও মাথাব্যথার কারণ হবে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে ভেজাল রোধ করা যায়? মাত্র ৬ মাসের কর্ম-পরিকল্পনায়ই ৮০ ভাগ ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব বলে আমরা মনে করি। কীভাবে?
(১) দেশে ভেজালবিরোধী জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে। এ কমিটিতে সৎ এবং যোগ্য চলতি দায়িত্বে থাকা এবং অবসরপ্রাপ্ত আমলারা থাকবেন। অবসরপ্রাপ্ত সৎ ব্যক্তিদের এ কমিটির আওতাভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এক সময়ে রাজধানী ঢাকার ভেজালের বিরুদ্ধে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলাদের মতো ব্যক্তিদের বেশি কাজে লাগানো যেতে পারে। কারো সাথে ভেজালের ব্যাপারে আপোস করেননি বলেই রোকন-উদ-দৌলা অল্প সময়ে ভেজালকারবারীদের হৃদপিন্ডে কম্পন ধরাতে সক্ষম হন।
(২) খাদ্যে ভেজালে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। সেই সঙ্গে অপরাধীদের ধরে সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
(৩) প্রকাশ্যে সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। সাজা হতে হবে শারীরিক এবং আর্থিক। প্রয়োজনে মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) র্যাবের সৎ কর্মঠ অফিসারদের ভেজালের বিরুদ্ধে অতিরিক্তি দায়িত্ব দিয়ে ৬ মাস মাঠে রাখা যেতে পারে।
(৫) ৬ মাস পরীক্ষামূলক প্রতিটি উপজেলায় বিশেষ ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যকর থাকতে হবে। এ ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজালবিরোধী জাতীয় কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি র্যাব-পুলিশের ভূমিকা রাখতে হবে।
(৬) অন্য কোনো ইস্যুতে যেহেতু সম্ভব নয়, অন্তত দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং জীবনের কথা ভাবনায় এনে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেজালের ব্যাপারে ঐকমত্য হতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।