Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রিয়নবীর (সা.) রাষ্ট্রতত্ত্ব ও বৈদেশিক নীতি

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মানবিক সাম্য, সামাজিক শান্তি, ন্যায় বিচার, সমঅধিকার, সুষমবণ্টন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, পারষ্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের স্বীকৃতি ইসলামের বিঘোষিত অঙ্গিকার। আর তা রক্ষা করা মহান আল্লাহ্র আদেশ ও প্রিয়নবীর (স.) আদর্শ। এ জন্যই হিজরতের পর প্রিয়নবী (স.) ঝড়পরধষ পড়হঃৎধপঃ বা ‘সামাজিক চুক্তি’র মতো সম্প্রীতিমূলক এক মহাসনদ প্রণয়ন করেন, যাকে বলা হয় ‘মদীনা সনদ’।

প্রিয়নবী (স.) মদীনায় হিজরতকালে (সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রি.) পাঁচ ধরনের মানুষ সংশ্লেষের এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হন। যথা: মুহাজির, আনসার, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক। তখন তাঁর প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হয় ভ্রাতৃবিরোধ-বিদ্বেষের অবসান ঘটান। এ লক্ষ্যেই মদীনা সনদের প্রধান অর্জন: (ক) তাওহীদ ভিত্তিক লিখিত সনদের আলোকে সংঘাতের স্থলে সার্বজনীন নিরাপত্তা, (খ) প্রিয়নবীর (স.) নেতৃত্বে শান্তি ও রাজনৈতিক ঐক্য এবং (গ) সাম্য ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা।

মদীনা সনদের মাধ্যমে প্রিয়নবী (স.) তাঁর ‘ইসলামি রাষ্ট্র দর্শনে’র ভিত্তি রচনা করেন। ফলে অসাম্প্রদায়িকতা, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতার পরিবেশ গড়ে ওঠা সহজতর হয়। মদীনা সনদকে মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান বলা হয়।

মদীনা সনদের ৬৩টি ধারা বা বিধি-বিধান পাওয়া যায়। তবে, হাদিসের ব্যাখ্যাকারী, সিরাতপ্রণেতা, ঐতিহাসিক ও গবেষকের আলোচনায় মদীনা সনদের ৪৭টি ধারার কথা সমধিক প্রসিদ্ধ হলেও সনদের প্রথমাংশে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বিষয়ে ২৪টি ধারা এবং দ্বিতীয়াংশে মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য মদীনাবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে ২৯টি ধারা পাওয়া যায়।

মদীনা সনদের সার-সংক্ষেপ: (ক) মুসলিম, ইয়হুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। (খ) রাসুল (স.) হবেন, নব গঠিত ‘মদীনা প্রজাতন্ত্রে’র প্রধান ও সর্বোচ্চ বিচারালয়ের (ঈড়ঁৎঃ ড়ভ অঢ়ঢ়বধষ) সর্বময়কর্তা। (গ) সবার পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, এতে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। (ঘ) কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায়ে তার সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। (ঙ) দুর্বল, অসহায়কে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে। (চ) সনদ স¦াক্ষরকারী পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাসুল (স.) তা আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী মিমাংসা করবেন।

মদীনা সনদের মাধ্যমে রাসুলের (স.) ক্ষমতা ও শ্রেষ্টত্ব বৃদ্ধি পায়, ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মদীনার পুণর্গঠন সম্ভব হয়।

মদীনা সনদের ধারাবাহিকতায় প্রিয়নবী (স.) গোত্র প্রধান শাসিত ২৭৬টি দেশীয় রাজ্যকে একত্রিত করেন। মদীনাকেন্দ্রিক এ ব্যবস্থার বিস্তৃতি ছিল দশ-এগার লক্ষ বর্গ মাইলেরও বেশি এলাকা। পরবর্তীতে সংঘাতের স্থলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ৬ষ্ঠ হি./ ৬২৮ খ্রি. প্রিয়নবী (স.) ‘হোদাইবিয়া’র সন্ধি স্বাক্ষর করেন।

অন্যদিকে ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মক্কা-মদীনার মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থগিত থাকার সুবাদে প্রিয়নবী (স.) ইসলাম প্রচারে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। শান্তি, সহযোগিতা, সহাবস্থান ও সংহতির বার্তা নিয়ে প্রিয়নবীর (স.) দূতগণ তাঁরই (স.) পবিত্র পত্রাবলী তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়কগণের কাছে পৌঁছে দেন।

ফলে প্রিয়নবীর (স.) জীবদ্দশায়ই ইসলাম আন্তর্জাতিকরূপ পরিগ্রহ করে। যার ভিত্তি হলো: উম্মাহ্ (অভিন্ন জাতীয়তাবোধ ও অখন্ডতা), উখ্ওয়াৎ (বিশ্বজনীন ইসলামি ভ্রাতৃত্ব), তাবলিগ (ধর্মীয় প্রচার), খিদমতে খালক্ (সৃষ্টির সেবা-সংরক্ষণ)

এ চেতনাবোধের সার্থকতায় প্রিয়নবীর (স.) পত্রাবলী অনন্য কিংবদন্তী। যা অবাক বিস্ময় ও প্রিয়নবীর (স.) চলন্ত-জীবন্ত মু’জিজা। ঐতিহাসিক এ সব পত্রাবলী আজো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে স্বসম্মানে সুরক্ষিত রয়েছে।

মিশরীয় গবেষক ড. হামিদুল্লাহ্র মতে, প্রিয়নবী (স.) যাঁদের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন তাদের সংখ্যা দু-আড়াইশ’র কম নয়। তাঁদের অন্যতম: ইয়ামামার গভর্নর- হাওয়া বিন আলী, বাহরাইনের গভর্নর- মুনযির বিন সাওয়া, ওমানের গভর্নর- জাফর বিন জুলান্দি, দামেস্কের গভর্নর- হারিস বিন আবি শামর গাসসানি, আবিসিনিয়া বা হাবশার বাদশাহ্- নাজ্জাসী আসহাম, মিশররাজ- মাকাওকাস, ইরানের শাহানশাহ- কিসরা খসরু পারভেজ, রোমস¤্রাট (কায়সার) হিরাক্লিয়াস।

প্রিয়নবীর (স.) পবিত্রপত্র পাঠে তাঁর (স.) সমসাময়িক রাজন্যবর্গের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর শাসক রোমস¤্রাট হিরাক্লিয়াসের মনোজগতে ঝড় বইতে শুরু করে। তিনি প্রিয়নবীর (স.) নবুওয়াতের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে বলেন: ‘হায়! আমি যদি তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারতাম! তবে, আমি তাঁর (স.) পা ধূয়ে দিতাম’ (বুখারি)। শুধু তাই নয়, তিনি রাজপ্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সামনে ঘোষণা করলেন: ‘হে রোমবাসী। তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়েত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব চাও? তা হলে এই নবীর আনুগত্য (বায়াআত) গ্রহণ করো....’ (বুখারি)। প্রিয়নবীর (স.) পত্রের প্রতিক্রিয়ায় হিরাক্লিয়াস আরো বলেছিলেন ‘শীঘ্রই তিনি (স.) আমার এ দু’পায়ের নিচের জায়গার (রোমসা¤্রাজ্য) মালিক হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর (স.) আবির্ভাব হবেই.....’ (বুখারি)। রোমস¤্রাটের এমন অভিব্যক্তি প্রিয়নবীর (স.) শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ।

এ ভাবেই ইসলাম হয়ে ওঠে শান্তির সমাজের আদর্শ। এখানেই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণীর নিত্যতা প্রমাণিত: “তোমরা পরষ্পর শত্রæ ছিলে অতপর আল্লাহ্ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, এখন তোমরা তার অনুগ্রহের কারণে পরষ্পর ভাই ভাই হয়েছ” (আল-ইমরান: ১০৩)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন