পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ সিলেট। এখানে আছে সবুজ পাহাড়ের গল্প, চা-বাগানের সারি সারি গাছ, স্বচ্ছ নীল প্রকৃতির ভূমি আর দেয়ালে পুরাকীর্তির ও সভ্যতার দীর্ঘ সব ইতিহাসের এক অফুরক্ত ভান্ডার। আধ্যাত্মিক রাজধানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা এলে উঠে আসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজে ঘেরা অগনিত পাহাড়, টিলা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কালের বিবর্তন, কথিত নগরায়নের প্রয়োজন, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও পাহাড় খেকোদের অশুভ পাঁয়তারায় শহর ও শহরতলীর পাহাড়গুলোতে এখন চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব। তাই ধংস হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চল বলে খ্যাত নগরী সিলেটের পরিবেশ। শহরের প্রায় পাহাড়েই অবাধে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এলাকার প্রভাবশালী আর এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এক সময় সিলেট বৃক্ষের জঙ্গল হিসাবে পরিচিত ছিলো। টিলায় টিলায় সজ্জিত ছিল নগরী। সে টিলায় ছিল নানা গাছপালা আর লতাপাতার ঝোপ। এসব টিলা দেখে মনে হতো ‘সবুজের গালিচা’। কিন্তু কালের আবর্তনে এ জনপদে সে ঐতিহ্য আর নেই। বর্তমানে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি চলছে পাহাড় নিধনের প্রতিযোগিতা। ফলে মানুষের কঠিন হাতের ছোঁয়ায় সেই সবুজের সমাহার আজ ধ্বংসের মুখে।
খাদিমনগর, টিলাগড়, শাহীঈদগাহ, বালুচর, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, টুকের বাজার, শাহেববাজার, সিলাম, সালুটিকরসহ বিভিন্ন এলাকা এক সময় পাহাড় ও বৃক্ষের জন্য ছিল আকর্ষণীয় স্থান। আধুনিকতার নামে ওইসব এলাকার টিলাগুলোর বৃক্ষ নিধন করে এখন যেমন করা হয়েছে বৃক্ষশূন্য, তেমনি পাহাড় এবং টিলার মাটি অবাধে কেটে বিক্রি করায় পাহাড়ি এসব এলাকা এখন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিশষজ্ঞ মহল মনে করেন, পাহাড় এবং বৃক্ষ নিধনে সরকারিভাবে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ না করলে সিলেট নগরীর অবশিষ্ট পাহাড় ও টিলা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে সিলেটের সচেতন মানুষদের অভিমত হলো, বনভূমি ও পাহাড়ি জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানব সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অর্থাৎ এক শ্রেণির পাহাড় ও বন-খেকোর লোলুপ দৃষ্টিতে উজাড় হতে চলছে শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ। ফলে পাহাড়ের ঐতিহ্য হারানোর পাশাপাশি বিলুপ্ত হচ্ছে আমাদের জীববৈচিত্র্য।
বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে নগরীর বৃক্ষাচ্ছাদিত পাহাড়গুলো এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও বন উজাড়ের ফলে এসব স্থান ফুটবল খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। চোখের সামনে শহরের আশেপাশের সব পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তার নেতারা ১০-২০ হাজার টাকা উপরি নিয়ে ছিন্নমূল নতুবা বাস্তুহারা নাম দিয়ে কিছু মানুষকে বসিয়ে দেয়, মাসিক ভাড়া তুলে, জায়গা বেচা-কেনাও চলে, সেই সাথে চলে পাহাড় কাটা। আগে এসব অবৈধ কাজ আড়ালে-অবডালে করতো এখন প্রকাশ্যে করে। বালুচর, টিলাগড় এলাকায় পাহাড় এমনভাবে দখল হলো যে, এখন রাস্তাতেই ছন-টিনের ঝুপড়ি দেখা যায়। এসব জায়গায় প্রধান সড়কের পাশের পাহাড় ন্যাড়া করে তাতে টিনের বেড়া দিয়ে প্রভাবশালীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এমসি কলেজের পশ্চিম পাশে যে সুন্দর টিলা ছিল তা কেটে কেটে প্রায় শেষ করা হয়েছে। গড়ে তুলা হয়েছে বসতবাড়ি, আবাসিক এলাকা। বালুচরে যে সবুজ পাহাড়ের সারি ছিল তা কেটে কেটে বেদখল হয়েছে। পাহাড় এখন বিলুপ্তির পথে। এসব এলাকায় গেলে দেখা যায় অমুক তমুক নাম দিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখলের চিত্র। আশ্চর্য লাগে যে, কিছু মানুষ এতটাই মাটিখেকো হয়ে গেছেন যে, শুধু পাহাড় কিংবা টিলা নয় তারা এলাকার কবরস্থানের জায়গা পর্যন্ত দখল করে ব্যবসা করে থাকেন। যদি এই হয় দশা তবে আসছে ভবিষ্যতে যে কী অবস্থা হবে তাতো আর বলার আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজনীতির চাকের মতো মৌমাছি ক্ষুধা কীভাবে মিটাবে এই গরিব দেশ, সেটাই বরং ভাবনার বিষয় হতে পারে। সিলেট শহরের চারপাশে যেসব ছোটছোট টিলা বা পাহাড় ছিল তাতে একসময় সেগুন, শাল-গজারি, কড়ই, গামারী, গর্জন, জারুল, মেহগনির মতো মূল্যবান গাছ ছিল। এছাড়াও ছিল আম, জাম, কাঁঠাল, বরই, আমলকি, বহেরা, হরতকিসহ বিভিন্ন ফসল ও ঔষধি গাছ। এক সময় এই এইসব পাহাড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কবিরাজ বা হেকিমগণ ছুটে আসতেন নানা প্রজাতির ঔষধি গাছের জন্য। এছাড়া এই নগরীর বিভিন্ন এলাকাতেও ছিল অসংখ্য কবিরাজ। কিন্তু যে সব গাছ গাছড়া এখন বিলুপ্ত হওয়ায় ওই সব করিরাজরাও পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ আয়ূর্বেদী চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে ওই সব প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সামান্য কিছু প্রজাতির গাছ থাকলেও সেগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় সিলেটের পাহাড়ে বাঘ, ভালুক, বানর, হরিণ, হনুমান, সজারু, ময়ূর, টিয়া, ময়না, খরগোশ, বন মুরগি ও বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অসংখ্য পশু-পাখির অবাধ বিচরণ ছিল। অবাধে পরিবেশ ধংশ করে গাছ আর পাহাড় কাটাসহ পশু ও পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে ওই সব পশু-পাখির অনেক আগেই এলাকা ছেড়ে গেছে। তবে কালেভদ্রে বানর, বন মোরগ, শূকর, কাঠবিড়ালি আর সামান্য কিছু সাপের দেখা মেলে বলে স্থানীয় এলাকাবাসী ও বন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে। পাহাড়ে ওই সব পশু-পাখির বিচরণের কথাটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে কল্পকাহিনী বা ইতিহাস মাত্র। গত কয়েক বছরে সিলেট শহরের আশপাশ কয়েকটি এলাকার স্থানীয়রা পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন শুরু করলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধ্বসে ও মাটি চাপা পড়ে কয়েক ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর সরকার মাটি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিলাগড় এলাকার স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা বলেন, একটি চিহ্নিত সিন্ডিকেট বন বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে গাছ কাটা। ঠিক একইভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসৎ কর্মচারীর সহযোগতিায় পাহাড় কাটা হচ্ছে অবিরাম গতিতে। কেউ প্রতিবাদ করলে তা আইনশৃঙ্খলা, বন ও পরিবেশ কমিটিতে আলাপ-আলোচনা হলে প্রতিরোধে তৎপরতা কিছুটা শুরু হয়, এতে নাকি আবার বর্ধিত হারে উৎকোচ দিতে হয় তাদেরকে যারা এসব রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। মাঝে মধ্যে কেউ কেউ রক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি করলে বা কথা না মানলে লোক দেখানোর ভান করে মাঝে মধ্যে দু একটি কাঠের চালান আটক করেও তা আবার গোপনে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ওই সিন্ডিকেটের লোকজন। কিছু প্রভাবশালী মহল বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন কাজে এবং ব্যক্তিগত বহুতল বাড়ি নির্মাণে পাইলিং করতে প্রকাশ্যে গাছ ব্যবহার করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকে নিরব। চিহ্ন মুছে ফেলতে রাতারাতি চুরি যাওয়া গাছের গুড়ি উপড়ে ফেলা হয় এমন খবরও আছে। এছাড়া বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী বনের কোনো গাছ চুরি গেলে তা নিকটস্থ থানায় জিডি করতে হয়। কিন্তু বন বিভাগ তা করে না। তবে গাছ চুরির ব্যাপারে বন বিভাগের সাথে বনিবনা না হলে এবং তাদের স্বার্থে কেউ ব্যাঘাত ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক গাছ চুরির মামলা ঠুকে দেন বলে এলাকার একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন। বন বিভাগের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে জনৈক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে পাহাড় কাটা বন্ধ রয়েছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে গাছ কাটা রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখই রকম বক্তব্য পরিবেশ বিভাগেরও তবে পরিবেশবিদদের অভিমত, অভিলম্বে পাহাড় কাটা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেই সঙ্গে অবাধে পাহাড় ও বন কাটা বন্ধ করে দেশীয় প্রজাতি ফল-মূলসহ নানা বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করে এবং বনায়ন করে হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।