পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পার্বত্য চট্টগ্রামে গুম-খুন-অপহরণ চাঁদাবাজি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সেখানে বিবদমান চারটি সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যকার আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নিজেরাও যেমন হতাহত হচ্ছে, পাশাপাশি তাদের সন্ত্রাসের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। গুম-খুনের শিকার হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও, অনেকেই বাধ্য হয়ে এলাকা ছাড়ছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে খোদ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত সশস্ত্র হামলার শিকার হয়ে আহত-নিহত হচ্ছেন। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সাথে নিয়োজিতরা কোনো ক্রমেই এর লাগাম টেনে ধরতে পারছেন না। অন্যদিকে শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কার্যক্রমকে সীমিত পর্যায়ে রাখা এবং বিপুল সংখ্যক ক্যাম্প প্রত্যাহার করার কারণে তারাও এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে চুক্তির ২২ বছরের মাথায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পরিস্থিতির গভীরতা অনুধাবনের জন্য সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা নিচে তুলে ধরছি।
বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ড:
পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন শেষে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট ভোট কেন্দ্র থেকে উপজেলা সদরে ফেরার সময় প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারসহ ভোটের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর ব্রাশ ফায়ারে ৮ জন নিহত হয় এবং আহত হন অন্তত ২০ জন। সোমবার (১৮ মার্চ) সন্ধ্যায় উপজেলার মারিশ্যা নয়কিলো নামক স্থানে পৌঁছালে উপজাতীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক অ্যাম্বুশের মধ্যে পতিত হয় নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্টরা। হতাহতদের মধ্যে বেশির ভাগই আনসার ও পুলিশ সদস্য। এছাড়াও ভোটগ্রহণকারী বেসামরিক কর্মকর্তারাও ছিলেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এবং ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) যৌথভাবে নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ-আনসারদের ওপর এ সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। আর এ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম এসেছে বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনে জেএসএস (সন্তু গ্রুপের) প্রার্থী বড় ঋষি চাকমার, যিনি ওই দিন সকালে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না দাবি করে ঘোষণা দিয়ে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েই এই হামলার পরিকল্পনা করেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বাঘাইছড়ি-সাজেকের উল্লেখিত এলাকাটি ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রæপের) নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সেখানে হামলার জন্য ইউপিডিএফ ক্যাডারদের ব্যবহার করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনের পরের দিন রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ তঞ্চঙ্গাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ জেএসএস (সন্তু) গ্রুপকে দায়ী করে, যদিও এ ঘটনার সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ)। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এর আগে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি এবং বরকল উপজেলায় ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা-গুম-খুনের শিকার হয়েছিল। সন্ত্রাসীরা স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে গণপদত্যাগেও বাধ্য করেছিল। অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পড়েছিল যে, এসব এলাকায় আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পরিষদ, এমনকি কোনো কোনো স্থানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাচ্ছিল না।
সম্প্রীতির বান্দরবানে খুনের আতঙ্ক:
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান সবসময়ই ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। গুম-খুন-অপহরণ-চাঁদাবাজির কথা এক সময় সেখানে শোনাই যেত না। এ কারণেই বান্দরবানকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু সেই সম্প্রীতির বান্দরবান এখন আর শান্ত নেই। প্রায়শই গুম-খুন-অপহরণ আর চাঁদাবাজির খবর আসছে সেখান থেকে। বিশেষ করে ২০১৯ সালটি যেন বান্দরবানের জন্য এক কলঙ্ক তিলক হয়ে দেখা দিয়েছে। থেকে থেকেই সেখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা খুনের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে খুন হওয়াদের তালিকায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে বান্দরবানের পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের তিন নেতার নাম। এই অবস্থায় আতঙ্কে থাকা উভয় দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। কেউ কেউ স্থায়ীভাবেই এলাকা ছেড়ে শহর বা অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বান্দরবানে শুরু থেকেই এসব খুনোখুনির জন্য পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস(সন্তু গ্রুপ)কে দায়ী করে আসছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা। জেএসএসের সন্ত্রাসীদের আটক ও তাদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বান্দরবানে হরতালসহ ধারাবাহিক নানা কর্মসূচিও পালন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে বরাবরের মতো জেএসএস এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মগ লিবারেশন পার্টি তাদের নেতাকর্মীকর্মীদের হত্যা করছে বলে দাবি করে আসছে। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর টার্গেটে রয়েছে, যার মধ্যে বান্দরবানের সিনিয়র ১০ জনের বেশি আওয়ামী লীগ নেতার নামও রয়েছে। তবে এক প্রতিবাদ সমাবেশে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্যশৈহ্লা জেএসএসের সন্ত্রাসীদের টার্গেটে আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী রয়েছে বলে দাবি করেন।
উত্তপ্ত রাজস্থলী ও কাপ্তাইয়ের রায়খালী:
সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসীদের অভয়ারাণ্য হয়ে উঠেছে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলা এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন। বিগত কয়েকমাস ধরে প্রায়ই এ এলাকায় ঘটছে খুন গুম চুরি-ডাকাতি, লুটপাটসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ নিরাপত্তা চৌকি না থাকায় এসব অপরাধ হরহামেশা ঘটছে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর দাবি। এ এলাকায় বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মায়নামারের সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান লিবারেশন আর্মির এক সময় আনাগোনা এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও বর্তমানে এখানে সন্তু গ্রুপের নেতৃত্বাধীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসি জেএসএস), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক (বর্মা গ্রুপ), আরাকান আর্মির সহযোগী মগ লিরাবেশন পার্টি এবং মগ লিরাবেশন পার্টি (সংস্কার) নামের সংগঠনগুলো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। রাজস্থলী উপজেলার উত্তরে কাপ্তাই উপজেলা, দক্ষিণে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবান সদর, পূর্বে বিলাইছড়ি উপজেলা এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের আনাগোনাটা বেশি হয় মূলত বান্দরবান জেলার দুর্গম রোয়াংছড়ি উপজেলা হয়ে। চলতি বছরের গত ১৮ আগস্ট রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্পের দক্ষিণে পোয়াইতুমুখ এলাকায় সেনাটহলের ওপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে সৈনিক মো. নাসিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় মাইন বিষ্ফোরণে আরো এক সেনা কর্মকর্তা ও একজন সৈনিক আহত হন। এর আগে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল দুই দল আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধে রাজস্থলীতে ৭ সন্ত্রাসী নিহত হবার খবর জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছিল। এরপর ২৩ এপ্রিল একই উপজেলার গাইন্ধ্যা ইউনিয়ন মেম্বার ও জেএসএস ইউনিয়ন শাখা সাধারণ সম্পাদক মংক্যসিং মারমাকে অপহরণ করা হয় বলে এক বিবৃতিতে জেএসএস দাবি করে। ৯ অক্টোবর প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন আরেক জেএসএস নেতা অং সুই অং মারমা। নিহত হওয়ার সময় তিনি সামরিক পোশাক পরিহিত ছিলেন এবং তার লাশের পাশ থেকে একটি দেশীয় এলজি উদ্ধার করা হয়। ২৩ অক্টোবর রাজস্থলী উপজেলার হেডম্যান ও বিএনপি নেতা দীপময় তালুকদারকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। ১৮ নভেম্বর রাজস্থলী উপজেলার গাইন্ধ্যা ইউনিয়নের বালুমোড়া এলাকায় অন্তর্দলীয় বন্দুকযুদ্ধে জেএসএসের তিন সদস্য নিহত হয়। অবশ্য জেএসএস এক বিবৃতিতে অন্তর্দলীয় বন্দুকযুদ্ধের কথা অস্বীকার করে নিহতদের সাধারণ গ্রামবাসী বলে দাবি করে। ২০ নভেম্বর রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের লংগদু পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদল সন্ত্রাসী চাঁদার টাকা না পাওয়ায় বিদ্যালয় ভবন কাজে কর্মরত শ্রমিকদের বেধড়ক পিটিয়ে একজন সাব-ঠিকাদারসহ দু’জন শ্রমিককে আহত করে। অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কাপ্তাই উপজেলার রাইখালীতে হামলা চালিয়ে সড়ক উন্নয়ন কাজে জড়িত ১০ জন শ্রমিককে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে আহত করে। বাড়ি-ঘর ও দোকানে হামলা চালিয়ে লোকজনকে মারধর করে নগদ টাকা, স্বর্ণ-অলঙ্কার এবং মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী লুটপাট করেছে। এর আগেও এ এলাকায় চাঁদার দাবিতে নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর একাধিকবার হামলা করেছে সন্ত্রাসীরা। ফলে ব্রিজ এবং সড়ক উন্নয়নের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে।
পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের সাম্প্রতিক তৎপরতা:
৪৫ দিনের মধ্যে সন্তু লারমার অধীনে থাকা সকল অবৈধ গোলা-বারুদসহ সশস্ত্র সদস্যদের তালিকা সরকারের কাছে জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের শর্তেই সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে চুক্তির ১৪ বছর পূর্তির প্রাক্কালে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাথে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় সন্তু লারমা স্বীকার করেন, তার অধীনে বেশ কয়েকশ’ সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে এবং তিনি এটাও বলেন যে, ২০০০ সাল থেকেই এরা পাহাড়ে সক্রিয় আছে। এখন প্রশ্ন হলো, চুক্তির পর ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিন দফায় সন্তু লারমাসহ শান্তিবাহিনীর সকল সদস্য তাদের হাতে থাকা গোলা-বারুদসহ আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়েই তারা সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় আসেন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরভাবে শুরু হয়। তাহলে, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সকল অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করার দুই বছরের মধ্যে আবার বেশ কয়েকশ’ অস্ত্র এবং সেইসব অস্ত্রধারী ক্যাডারকে সন্তু লারমা কীভাবে সক্রিয় করলেন? তিনি কি চুক্তির শর্ত মোতাবেক সকল অস্ত্র জমা দেননি? নাকি আগের সকল অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে আবার এসব অস্ত্র নতুন করে সংগ্রহ করেছেন? যদি জমা দিয়ে না থাকেন তাহলে তিনিই প্রথম চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন। আর সেটা হলে চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত; তা নাহলে সরকারের দিক থেকেও বিষয়টি চুক্তি লঙ্ঘনের আওতায় পড়বে। আর যদি তিনি এসব অস্ত্র পরে কিনে বা সংগ্রহ করে থাকেন তাহলে সরকার এ বিষয়ে তার কাছে জবাবদিহি চাইতে পারে প্রচলিত আইনের আওতায়। দুই বছরের মধ্যে এ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনার টাকা তিনি কোথা থেকে কীভাবে পেলেন, এতগুলো অস্ত্রই বা কোথা থেকে, কোন পথ দিয়ে সংগ্রহ করলেন এসবও সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হয়ে তার প্রতিবিধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সাম্প্রতিক গোয়েন্দা রিপোর্ট সূত্রে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের চারটি আঞ্চলিক সংগঠন- জনসংহতি সমিতি (জেএএসএস-সন্তু), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-প্রসীত), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) কাছে ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- রকেট লঞ্চার ৫৪টি, এসএমজি ৬৪১টি, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল ৫৯৪টি এবং হাতবোমা আছে এক হাজারেরও বেশি। এছাড়া চার শতাধিক দেশি পিস্তল ও বন্দুক এবং ৪০টি মর্টার রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আছে জেএসএস(সন্তু গ্রুপ) এবং ইউপিডিএফের (প্রসীত গ্রুপ) কাছে। ২০১১ সালে টেলিভিশনে সন্তু লারমার বক্তব্য প্রচারের পর পরই যদি বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহির আওতায় আনা হতো, তাহলে একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন যেমন কার্যকর হতো, তেমনি জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের পাশাপাশি অন্য সংগঠনগুলো এ বিপুল পরিমাণ মারণাস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলার সাহস পেত না। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি, পার্বত্য চট্টগ্রামের অবৈধ অস্ত্রধারীদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে যা যা করণীয় তার সবকিছুই করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে চাকমা সার্কেল চিফ বিভিন্ন সভা সেমিনারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনিরেপক্ষ ভূমিকার ব্যাপারে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ হতে হবে। এমনকি পাহাড়ের সাম্প্রতিক সময়ে যেসব হত্যাকান্ড ঘটছে সেসবকে শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা না করতে পরামর্শ দেন তিনি। বিশেষ করে বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্বপালন শেষে ফিরে আসার সময় সরকারি লোকজনের উপর হামলার পরবর্তী সময়ে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত ভূমি কমিশনের এক বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ হত্যাকান্ডের প্রতি নিন্দা জানানোর পর এসব ঘটনাকে শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত বিষয় হিসেবে বিবেচনা না করার প্রতিও মত দেন। চাকমা সার্কেল চিফ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই নিরপেক্ষহীনতা বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন সেটি স্পষ্ট হওয়া দরকার, অন্যদিকে রাজনীতির নামে তিনি মানুষ হত্যাকে সমর্থন করছেন কিনা সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার।
বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভা:
২০১৭ সালে পার্বত্য চুক্তির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক না, এমন অভিযোগ এনে ‘পাহাড়ে আগুন জ্বলবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন। এর পর থেকেই বিশেষ করে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ির এমনকি জেলা সদরেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গুম-হত্যা-অপহরণের শিকার হতে শুরু করে। একই সময়ে বিবদমান পাহাড়ি গ্রæপগুলোও পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান শুরু করে, যা পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা হত্যা এবং তার অন্তষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে আসা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নেতৃবৃন্দের উপর হামলায় ছয় জন নিহতের ঘটনা। এছাড়াও খাগড়াছড়ির সেভেন মার্ডারের ঘটনাসহ আরো বেশ কিছু সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিএইচটি রিসার্স ফাউন্ডেশন প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে ৩৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে আহত হয়েছে আরো ৬৭ জন, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি। উল্লেখিত সময়ে ৫৬টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১৫৯৫ রাউন্ড বিভিন্ন ধরনের গুলি উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে চুক্তির ২২ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেন ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে, সে প্রশ্নটিই সামনে আসছে বারবার। এর পরিপ্রেক্ষিতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন। গত ১৬ অক্টোবর এবং ১৭ অক্টোবর দুইদিনব্যাপী এ সফরে তিনি রাঙ্গামাটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের আয়োজনে তিন পার্বত্য জেলার বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত দুটি সভা করেছেন তিনি। একটি সভা তিনি করেছেন তিন পার্বত্য জেলার ডিসি, এসপিসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে। অপর সভাটি ছিল প্রশাসনিক এবং স্থানীয় প্রতিনিধিসহ অন্যান্যদের নিয়ে। এসব সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি বাসন্তী চাকমা, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, পুলিশের মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান, সার্কেল চিফ এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। শান্তি চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়ে এতটা উচ্চ পর্যায়ের সভা এর আগে কখনো হতে দেখা যায়নি। ফলে এর গুরুত্বও সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো সত্তে¡ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা এসব সভায় উপস্থিত হননি, এমনকি তিনি তার কোনো প্রতিনিধিকেও পাঠাননি। যাহোক, এই বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যার মধ্যে দৃশ্যমান প্রথম উদ্যোগটি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্থায়ী র্যাবের একটি আলাদা ব্যাটলিয়ন গঠন করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানালেও এ অঞ্চলের সন্ত্রাসী এবং তাদের পৃষ্টপোষকরা এটাকে স্বাভাবিক কারণেই ভালো চোখে দেখছে না, যা বিভিন্ন মহলের কাছ থেকে আসা মতামত বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায়।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেই হবে। এর কোনো বিকল্পও নেই। যারা এটাকে আইনশৃঙ্খলাজনিত পরস্থিতি বিবেচনা না করে রাজনৈতিক দিক থেকে দেখার নসিহত দেন, তারা হয়তো রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা করাকে বৈধ বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশেই কিংবা কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে এটাকে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর যাই হোক, মানুষ হত্যা কখনো রাজনীতি হতে পারে না। তাই পার্বত্য চুক্তির ২২ বছর পূর্তিতে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে রাঙ্গামাটিতে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। বিশেষ করে, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস করছে, চাঁদাবাজি করছে, খুনখারাবি-রক্তপাত করছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্মকান্ডে মদত দিচ্ছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর জন্য যত রকমের সাপোর্ট দরকার তার সবকিছু সরবরাহ করতে হবে। প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পগুলোতে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ মোতায়ন করে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাহাড়ি-বাঙালি জনসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদে (যদিও এর বৈধতার প্রশ্নটি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের বিবেচনাধীন আছে, তাই সেটির দ্রুত নিষ্পত্তি করে) দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিরা অধিষ্ঠিত হলে জবাবদিহি যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর পার্বত্য চুক্তি হয়েছে ‘বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া।’ অতএব, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো পুনর্মূল্যায়ন, সংশোধন বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে দ্রুত বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত আছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।