পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৫ অক্টোবর শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দিল্লীর হায়দরাবাদ হাউজে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির বিস্তারিত জনগণকে জানায়নি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের স্বার্থকে ন্যূনতমও বিবেচনায় না নিয়ে ভারতের সকল চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা হয়েছে।
নতুন এসব চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অবারিত সুযোগ পাবে ভারত। এতে করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলে মালামাল আনা-নেওয়া করতে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সড়ক ও রেল পথ ব্যবহার করতে পারবে ভারত। বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি তুলে ত্রিপুরায় নিতে পারবে। তরল গ্যাস রফতানি হবে। এসব চুক্তির মাধ্যমে সমুদ্র নজরদারির কথা বলে বাংলাদেশের উপক‚ল অঞ্চলে ভারতকে রাডার স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে থেকেই ভারতীয় পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য বাংলাদেশের সড়ক ও নদীপথ ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়ে শুল্কমুক্ত ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাওয়া-আসা করবে।
এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তিসমূহে বাংলাদেশের অর্জনের খাতা যে একেবারেই শূন্য কেবল তা নয়, বরং এসব চুক্তি বাস্তবায়ন হতে শুরু হলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি গভীর হুমকি ও সংকটের মুখে পড়ে যাবে। কারণ, ইতোমধ্যেই আমাদের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর দেশের আমদানি-রফতানির ভার বহনে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক সময় সপ্তাহর পর সপ্তাহ বন্দরে জাহাজ জট লেগে থাকে। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের ৭ রাজ্যের আমদানি-রফতানির ভার এই দুই বন্দরের উপর পড়লে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য মারাত্মক প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে পড়বে নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশের নাজুক সড়ক ব্যবস্থাপনার কথা আমাদের সকলেরই জানা। এমনিতেই ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের সড়ক নির্মাণে যথাযথ মান রক্ষা না হওয়ায় বছর না ঘুরতেই খানাখন্দকে ভরে সড়কের নাজুক অবস্থা তৈরি হয়। এরপর চাহিদার তুলনায় অপ্রশস্ত ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে মহাসড়কগুলোতে প্রায়ই দীর্ঘ জ্যাম লেগেই থাকে। যখন চুক্তি মতে, দুই বন্দর ব্যবহার করতে শুরু করবে ভারতের ৭ রাজ্য, তখন দেশের প্রাধান প্রধান মহাসড়কগুলোতে গাড়ির চাপ বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ জটিলতার মুখে পড়বে, ভাবতেও গা শিউরে উঠে। এর মধ্যে ভারতকে দেওয়া হয়েছে বিনাশুল্কের ট্রানজিট সুবিধা। তখন দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিই কেবল স্থবির হবে না, ভারতীয় গাড়ি চলাচল ও আমদানি-রফতানির জন্য সড়ক ও বন্দর সচল রাখতে জনগণের ট্যাক্সের টাকাও খরচ করতে হবে।
ফেনী নদীর পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। ভারতের সাথে ফেনী নদীর পানি চুক্তির কারণে হুমকির মুখে পড়বে মুহুরী সেচ প্রকল্প। এমনিতেই ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে যখন দেশের উত্তরাঞ্চলে চাষাবাদের জমি ফেটে চৌচির, নদী, খাল-বিল-পুকুর শুকিয়ে খা খা করে, দেশের খাদ্য ও মৎস উৎপাদনে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়, তখন ফেনী নদী মুখের মুহুরী প্রজেক্ট সেই অভাব মেটাতে বিশাল ভ‚মিকা রাখে। এখন চুক্তির ফলে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে শুষ্ক বোরো মৌসুমে নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই, খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, ফুলগাজী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালী-ল²ীপুরের কিছু অংশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানির জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে করে লাখ লাখ হেক্টর চাষাবাদের জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। অকার্যকর হয়ে পড়বে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘মুহুরী সেচ প্রকল্প’। যার আওতায় এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ থেকে ১৫টি উপজেলার ৮-৯ লাখ হেক্টর জমিতে লোণামুক্ত পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।
মুহুরী প্রকল্পের আওতায় যেখানে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস পাহালিয়া- এ তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৮-৯ লাখ হেক্টর জমির সেচকাজ করার কথা, সেখানে এখনই শুকনো মৌসুমে ভারত ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে পানি তুলে নেওয়া ও মুহুরী নদীর ভারতীয় অংশে বাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করে দেওয়ার কারণে পানির অভাবে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয় সম্ভব হয় না। এছাড়াও মুহুরী সেচপ্রকল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা ৩৫ হাজার একর মৎস্য প্রকল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ।
ফেনী নদীর পানি ভারত তুলতে শুরু করলে মুহুরী প্রকল্পের নয়নাভিরাম পর্যটন সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে নিমিষেই। হুমকির মুখে পড়বে কয়েক লাখ হেক্টর জমির গাছপালা। ফেনী নদী, মুহুরী ও কালিদাশ পাহালিয়া নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মৎস্য খামার বন্ধ হয়ে যাবে। বছরে প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। নদীর তীরবর্তী ২০-২২ হাজার জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা অন্ধকারের মুখে পড়বে।
আরেকটা বড় প্রশ্ন, ফেনী নদীর পাশের মুহুরী নদীর পানি ভারত প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে বাঁধ দিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখে এমনিতেই মুহুরী প্রজেক্টকে অর্ধেক অকার্যকর করে দিয়েছে, সেখানে ভারতকে কী করে বাংলাদেশের ফেনী নদীর পানি দিতে সরকার রাজি হতে পারলো, ভাবাই যায় না।
চুক্তিতে উপক‚লীয় নজরদারির কথা বলে বাংলাদেশে ভারতকে রাডার স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ঢাকা এবং দিল্লির মধ্যে এই সহযোগিতার কারণে চীনের সাথে যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকা বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে ইতোমধ্যেই অনেক বিশ্লেষক মতপ্রকাশ করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে বিশ্বের পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহের সাথে নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। কিন্তু এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও পরাশক্তিসমূহের দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত ও সামরিক প্রতিযোগিতায় জড়ানো হবে। যেটা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে নিয়ে যেতে পারে।
দেখা যাচ্ছে, এসব চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও নিরাপত্তাগত পরিস্থিতিকেই শুধু হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে একতরফাভাবে ভারতের সকল চাওয়াই কেবল পুরণ করা হয়নি, বরং ভারতের তরফ থেকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়া কয়েকটা জরুরি ইস্যুতে বাংলাদেশের বারংবার উত্থাপিত আবেদন-অনুরোধ সত্তে¡ও ভারত সামান্যতমও কোন ছাড় দেয়নি। ভারতের কাছে বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের চাওয়া তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তি নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের পণ্য ভারতে রফতানিতে নানা রকমের দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান বাধা দূরীকরণে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের যে জোরালো সমর্থন বাংলাদেশ চায় সেটিও মেলেনি। এমনকি যৌথ ঘোষণায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও ব্যবহার করানো যায়নি। বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে আসা ‘আশ্রয়চ্যুত’ মানুষজন।
আমরা মনে করি, ভারতের সাথে একতরফা এসব চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত ও ক্ষুণœ হয়েছে। দেশের জনগণের পক্ষে ক্ষতিকর এসব চুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভবপর নয়। আমরা দেখে আসছি, সরকার এ যাবত ভারতকে দুই সমুদ্র বন্দর দিল, ট্রানজিটের জন্য সড়ক দিল, রেলপথ দিল, নদীপথ দিল, ফেনী নদীর পানি দিল, ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার উন্মুক্ত সুযোগ দিল, লাখ লাখ ভারতীয়কে এদেশের বিভিন্ন কোম্পানির উচ্চপদের চাকুরিতে জায়গা দিল, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করে দিল, বাংলাদেশে ভারতের সমরাস্ত্র বেচার সুযোগ দিল এবং বর্ডারে পাখির মতো বাংলাদেশি হত্যায় নিশ্চুপ থাকল। কিন্তু কিছুই তো ভারত থেকে আনতে পারলো না। এক তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘ এক যুগ দৌড়ঝাপ করেও একফোঁটা পানি আনতে পারেনি। ভারতকে কৃতজ্ঞতা হিসেবে সরকারের আর কী কী দেওয়ার বাকী আছে, জনমনে এখন এটাই বড় প্রশ্ন।
বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক শাসনের তিন মেয়াদে এটা স্পষ্টত সকলেই অবলোকন করছেন যে, ভারত নিজের দেশের স্বার্থে কোনো কিছু চাইলেই দ্বিধাহীনভাবে সরকার চুক্তি ও সমঝোতায় উপনীত হতে তড়িঘড়ি রাজি হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে ভারতের সমর্থন পাওয়াকেই যেন বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের চাওয়াগুলো যে বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে এবং দেশটি যে বাংলাদেশের জন্য হুমকিজনক একের পর এক ইস্যু তৈরি করছে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা সংকটে আড়াল থেকে প্রতিপক্ষকে সহযোগিতা দিচ্ছে, এসব বিষয়ে সরকারের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই। বরং ভারতের সুরেই সরকার তাদের হয়ে যুক্তি খাড়া করতে যারপর নাই চেষ্টা করছে। এসব বিষয়ে জবাবদিহির জায়গা জাতীয় সংসদেও খোলামেলা আলাপ-আলোচনা হয় না। এর মানে হচ্ছে, সরকারের কাছে জনগণের মতামত একেবারেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। জনগণ কী ভাবল না ভাবল, তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। সরকারের লক্ষ্য একটাই- যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতা ধরে রাখা। আর এ জন্য ভারতসহ বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলোর সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করে তাদের সমর্থন পক্ষে রাখতে যা যা করার সবই করে যাচ্ছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে পরস্পর প্রতিযোগী বা বৈরী ভাবাপন্ন বড় বড় শক্তিকে একযোগে জায়গা করে দিয়ে দেশকে এক গভীর হুমকিজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে না তো? ক্ষমতার জন্য জাতীয় স্বার্থ তোয়াক্কা না করার এরূপ নজির বিশ্বেও আর কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই।
লেখক: মহাসচিব
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।