Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহেশখালী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রবন্দর ও বু-ইকোনমিকে ঘিরে যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দূষণের আশঙ্কা। বিশেষত: মহেশখালীতে নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ নিয়ে উদ্বিঘ্ন হওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বহুমাত্রিক দূষণ সারাবিশ্বের পরিবেশবাদী এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের সাথে জড়িতদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে নির্মাণাধীন রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুরু থেকে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারসহ দেশি-বিদেশি পরিবেশবাদীদের আপত্তি-প্রতিবাদ আমলে নেয়নি সরকার। পরিবেশগত ছাড়পত্রসহ যেসব আইনগত বাস্তবতায় ভারত তার সুন্দরবন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি না দিলেও ভারতের রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ বিনিয়োগে রামপালে বিতর্কিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে ভারত সরকারের দ্বিমুখী নীতি স্পষ্ট। একই কথা দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নেদারল্যান্ডভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়ন ও বিনিয়োগে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ১০টি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। এই স্টাডিতে পরিবেশ দূষণের দিক থেকে মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ডেডলিয়েস্ট বা ভয়াবহতম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রামপালের মত মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও এসব প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা দূষণ শতকরা ১০-১৫ ভাগের বেশি কমাতে পারবে না বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

কয়লা ইন্ডাস্ট্রি ও বিনিয়োগকারীদের প্রচারিত ‘কিøনকোল’ মিথ বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকি সত্তে¡ও এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর আস্থা রাখছেন। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী দক্ষিণ কোরিয়ার ডাবল স্টার্ন্ডাড ভূমিকা ধরা পড়ে। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় সালফার ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের অনুমোদিত মাত্রা প্রতি বর্গফুটে ৬৫ মিলিগ্রাম সেখানে মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বয়লার টেকনোলজি ব্যবহারের পরও সালফার ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা প্রতি বর্গমিটারে ৪২০ মিলিগ্রাম হতে পারে বলে গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। বাতাসে ক্ষতিকর বর্জ্য নিঃসরণের মাত্রাও কোরিয়ায় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ১০ গুণ বেশি (প্রতি বর্গমিটারে ৫০ মিলিগ্রাম)। অন্যদিকে মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বাতাসের মান নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক পি.এম (পারটিকুলেট ম্যাটারের) উপস্থিতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমারেখার চেয়ে ৫০ গুণের বেশি দাঁড়াতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। মহেশখালীতে নাইট্রোজেন অক্সাইড নিঃসরণের সম্ভাব্য মাত্রা ১০টি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সর্বোচ্চ হবে বলে জানা গেছে। এর ফলে চট্টগ্রামসহ আশপাশে বড় ধরনের দূষণজনিত স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সালফার ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে এসিডবৃষ্টির আশঙ্কাসহ বাতাস, পানি, মাটি ও স্বাস্থ্য সমস্যা মিলে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও উন্নয়নের নিরিখে দেশে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বিদ্যুতের নানাবিধ উপায় এবং বিকল্প রয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, বায়ু ও পরিবেশগত দূষণ রোধে সারাবিশ্বই গ্রিন এনার্জি, রিনিউয়্যাবল এনার্জির দিকে ঝুঁকছে। পানিবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুতের মাধ্যমে চাহিদা পূরণে অনেক দেশই সফল হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে অনেক দেশ। অপেক্ষাকৃত কম দূষণের কারণে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ভরযোগ্য হলেও পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকির কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে অনেক দেশ। আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সব ধরনের উৎসই ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা মিটাতে গিয়ে পরিবেশগত বিপর্যয়, জনস্বাস্থ্য এবং সুন্দরবন ও মহেশখালীর মত পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনাময় স্থানগুলোর সামগ্রিক নিরাপত্তার কথ ভুলে গেলে চলবে না। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে সুন্দরবনে বায়ু, মাটি ও পানি দূষণ, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা পুনরুল্লেখ করা অনাবশ্যক। সেই সাথে মহেশখালীর বিশাল এলাকায় যে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা থেকে মুক্ত রেখে পরিবেশবান্ধব বা ইকোফ্রেন্ডলি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানিগুলো নিজ দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে ধরনের দূষণ নিবারক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বিদেশে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি সে তুলনায় অনেক নিম্নমানের বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়াসহ যে সব দেশ তাপবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে তাদের অবশ্যই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুতের চাহিদা ও উন্নয়নের নামে পরিবেশ দূষণ, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মত ইস্যুগুলোকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন