Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অকস্মাৎ পরিবহন ধর্মঘট : সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

অবশেষে পরিবহন ধর্মঘটের অবসান হলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে বাস ও ট্রাকের মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সাথে ৩ ঘন্টাব্যাপী বৈঠকে ধর্মঘট অবসানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাইসেন্স এবং ফিটনেস সনদ আপডেটের জন্য ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যে, নিরাপদ সড়ক সুনিশ্চিত করার জন্য সরকার সর্বশেষ আইনটি প্রণয়ন করেছে এবং যেটি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হয়েছে সেই আইনটি সংশোধন করা হবে এবং এ সম্পর্কে একটি সংশোধনী সরকারের নিকট সুপারিশ আকারে পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, মালিক ও শ্রমিকরা ৯ দফা দাবিতে বিনা নোটিশে অকস্মাৎ পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে। আলোচ্য বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দেন যে, এসব দাবির মধ্যে যেগুলি যৌক্তিক বলে মনে হবে সরকার সেগুলি বিবেচনা করবে।

পরিবহন ধর্মঘটের অবসান ঘটেছে, জনদুর্ভোগের লাঘব হয়েছে। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। বাস মালিকদের শীর্ষ নেতা কে? পরিষ্কার উত্তর তিনি রংপুরের মশিউর রহমান রাঙা। তিনি জাতীয় পার্টির একজন এমপি। শেখ হাসিনার বিগত ক্যাবিনেটে তিনি একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

এবারের ক্যাবিনেটে তিনি মন্ত্রী না থাকলেও সরকারের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এখনও সরকার থেকে তাঁকে আলাদা করা যায় না। অনুরূপভাবে শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা কে? তিনি হলেন শাহজাহান খান। তিনিও একজন এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতা। শেখ হাসিনার বিগত ক্যাবিনেটে তিনি একজন পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন। এখনও তিনি আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা। শাহজাহান খান সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতা, আর মশিউর রহমান রাঙ্গাকে আওয়ামী ঘরানার বলা যায়। তো আওয়ামী ঘরানার নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিবহন ধর্মঘট করেন কিভাবে? ঘরের মধ্যে কি ঘর হতে পারে? নাকি সরকারের মধ্যে সরকার হতে পারে? আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শাহজাহান খানকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটিরও প্রধান করা হয়েছিল।

কথায় কথা বাড়ে। কথার পিঠে কথা ওঠে। যখনই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং মানুষ মারা যায় তখনই আলোচনায় এসে যান এই দুই ব্যক্তি। গত বছর যখন সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হন তখন শাহজাহান খানের দন্ত বিকশিত করা হাসির ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আরও জোরদার হয়। তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে সড়ক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

দুই
বহু প্রতীক্ষার পর সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হয়েছে। আইনটি কার্যকর করার প্রথম দিনেই বাধা আসে পরিবহন শ্রমিকদের নিকট থেকে। তখন সরকার বলে যে, আইনটি কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার এক সপ্তাহ নমনীয় হবে। এই সপ্তাহে চালক, হেলপার ও পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে আইনটি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে অবহিত করা হবে। এজন্য প্রচারপত্র বিলি, বৈঠক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হবে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। ফের শ্রমিকদের তরফ থেকে প্রতিরোধ। সরকার আবার বলল যে আরও এক সপ্তাহ সরকার নমনীয় হবে। এভাবেই সময় যেতে থাকে। কিন্তু সরকারের নমনীয় হওয়ার পালা আর শেষ হয় না। বস্তুতঃ একদিনের জন্যও সরকার কঠোর হয়নি। সরকারের এই দুর্বলতার সুযোগে শ্রমিক এবং মালিকরা অকস্মাৎ ধর্মঘটে যায়। গ্রহণ করে সেই পুরোনো কৌশল। অঘোষিত ধর্মঘটে জিম্মি করা হয় জনগণকে। শ্রমিকরা শুধু যে নিজেদের গাড়ি চালনা থেকে বিরত থাকে তাই নয়, অন্যান্য যেসব গাড়ি রাস্তায় নেমেছিল সেগুলোর চালক বা অন্যান্য শ্রমিককেও মার ধোর করা হয় । দুটি দিন সারা দেশে চলে চরম নৈরাজ্য। অভিযোগ রয়েছে, এই নৈরাজ্য সৃষ্টির পেছনে আড়াল থেকে ইন্ধন জুগিয়েছেন এই দুই এমপি, শাহজাহান খান এবং রাঙা। এদের ধর্মঘট ছিল রীতিমত জনগণের বিরুদ্ধে ধর্মঘট। সারা দেশ যখন নৈরাজ্যের কবলে নিক্ষিপ্ত তখন পুলিশ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যে পুলিশ বিএনপিকে ঘর থেকে বের হতে দেয়না, বের হলে পিটিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়, সেই একই পুলিশকে এক্ষেত্রে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। যারা বুঝবার তারা ঠিকই বুঝে যান যে, ধর্মঘটের নামে একটি পাতানো খেলা চলছে।

কিন্তু এই খেলা কতদিন চলবে? জনগণ কিন্তু ইতোমধ্যেই খেলাটি ধরে ফেলেছে। জনগণকে বলতে শোনা যাচ্ছে, সড়ক পরিবহন আইন বানালো সরকার, সেই আইনটি পাশ করলেন সরকারের মন্ত্রীরা, অর্থাৎ মন্ত্রিসভা সেই আইন পাশ করেছে। এখন আবার সরকারেরই দুই এমপি সেই আইনের বিরোধিতা করছেন। সাদা চোখে দেখলে এই ধর্মঘট সরকারের পাশ করা আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট। অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট। শাহজাহান খান এবং রাঙ্গা ছাড়া আর যে দু একটি অনুল্লেখযোগ্য শ্রমিক মালিক সংগঠন রয়েছে তারাও মোটামুটি সরকারপন্থী। কলামিস্ট আবুল মকসুদ বলেন, ‘এ কেমন কথা যারা আইন করেছেন তারাই সেই আইনের বিরোধিতা করছেন। আইন করেছেন যারা তারা সরকারী দলের, আবার আইনটির বিরোধিতা করছেন যারা, তারাও সরকারী দলের। এগুলো এক ধরণের গোঁজামিল।’

বলা হয়েছে, আইনটি সংশোধন করা হবে এবং এ সম্পর্কে একটি সংশোধনী সুপারিশ আকারে সরকারের নিকট পেশ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারা দেশব্যাপী ছাত্র, তরুণ এবং কিশোরেরা মিলে এতবড় একটি আন্দোলনের পর এমন ভালো একটি আইন হলো, সেটি আবার সংশোধনের প্রশ্ন আসে কেন? ওরা সড়ক পথে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ মারবে, তার জন্য কি তাদের শাস্তি হবেনা? ওরা বাস থেকে যাত্রীকে ফেলে দিয়েছে, সেই যাত্রী আবার সেই বাসের তলায় অথবা অন্য বাসের তলায় পিষ্ট হয়েছে, তারপরেও তাদের শাস্তি হবেনা? সড়ক পথে যেসব বিভৎস, নারকীয় ঘটনা ঘটে সেই সব বিভৎস ও নারকীয় ঘটনা কি পৃথিবীর সভ্য কোনো দেশে ঘটে? ওরা মানুষ খুন করবে, সেজন্য শাস্তি দিতে গেলেই তারা গাড়ী ঘোড়া বন্ধ করে মানুষকে জিম্মি করবে, আর সরকার মধ্যরাত পর্যন্ত বৈঠক করে আইনের কার্যকারিতা স্থগিত রাখবে- কোনো জনবান্ধব সরকার এমন খেয়াল খুশির কাছে নতি স্বীকার করতে পারে না। হঠাৎ করে ধর্মঘট করার আগে জনগণকে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশায় নিক্ষেপের আগে শাহজাহান খান এবং রাঙা কি সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে পারতেন না?

শাহজাহান খান বলেছেন যে, শ্রমিকরা নাকি ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না। শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা হয়ে তিনি এমন কথা বলেন কিভাবে? সেই ভয়টি তো দূর করার দায়িত্ব তাঁরই। তাঁর কথা শ্রমিকরা শুনছেনা, সেটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর যদি শ্রমিকরা তাঁর কথা না শোনে তাহলে তাদের নেতৃত্বে থেকে তার সরে যাওয়া উচিৎ। পদত্যাগ করতে হবে শুধুমাত্র শ্রমিক সংগঠন থেকেই নয়, সরকারী দল থেকেও। যে ব্যক্তিটি এই সেদিন মন্ত্রী ছিলেন এবং এখন সরকারী দলের প্রভাবশালী এমপি, তাই এটি তার দায়িত্ব এই সমস্যার সমাধান করা। তা না করে তিনি সরকারের সাথে বৈঠকে বসেন কিভাবে? তিনি কি সরকারের প্রতিপক্ষ?

তিন
আলোচ্য বৈঠকরে পর সরকার সম্প্রতি প্রণীত ও বাস্তবায়নাধীন পরিবহন আইনে ছাড় দিলো বলে পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিরাপদ সড়ক আইনের মুখর প্রবক্তা ইলিয়াস কাঞ্চন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি বলেছেন, ‘এবার যদি আমরা এই আইন বাস্তবায়ন করতে না পারি, এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ।’ সরকার ঐ বৈঠকে আরো একটি ছাড় দিয়েছেন। ট্রাক শ্রমিক নেতাদের মতে, নতুন আইনে বাস ট্রাকের চালকের জামিন না পাওয়ার যে বিধান রয়েছে সেটাকে জামিনযোগ্য করার আশ্বাস তাঁরা পেয়েছেন।

পর্যবেক্ষক মহল বলেন, এক বছরেরও আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়েছিল। তারপর থেকেই পরিবহন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরা সরকারের সাথে আলোচনা করেছেন। সেই সময়েই তো শ্রমিকদের দাবির একটা সুরাহা করা যেতো। তখন সেটা না করে আজ তাদের দাবির কাছে সরকার নতি স্বীকার করছে কেন? আইন কার্যকর করতে যেয়ে তারপর চাপের মুখে সেটাকে শিথিল করা যায় কিনা? এই সরকার বিরোধী দল গুলির ক্ষেত্রে কঠোর হতে পারে, লবণ সঙ্কটে কঠোর হতে পারে, তাহলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কঠোর হতে পারেনা কেন? ব্যাপারটি ঐ সর্প হইয়া দংশন করো/ ওঝা হইয়া ঝাড়ো’র মত হচ্ছে না কি?
Email: journalist [email protected]



 

Show all comments
  • Nannu chowhan ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ৭:১৫ এএম says : 0
    Asholei shorkarer shathe atat thakar fole era eaivabe deshe orajogota srishti korse,tara nijera hortal kore abar onnoder shorire garite alkatra makhe nana vabe najehal kore manushke, eaita koto boro human rights violation er aowatai pore ta chintar bahire,jodio shorkari bahini birudhi doler lokder jel nirjaton goom porjonto kore felese othocho eai shorkarke eder biruddhe kothur howar jonno jonogoner shomorthon thaka shotteo keno shorkar o ayn sringkhola bahini bahini eder biruddhe kono bebosta nite parsena taki jonogoner bodhgommo noy?
    Total Reply(0) Reply
  • Badal Hussain ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১১ এএম says : 0
    ১০০ ভাগ সত্য কথা বলেছেন
    Total Reply(0) Reply
  • জাহিদ ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১২ এএম says : 0
    এরা দেশের জনগণের সাথে তামাসা শুরু করেছে
    Total Reply(0) Reply
  • পারভেজ ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১৩ এএম says : 0
    শাহজাহান খান আর রাঙার কাছে পুরো দেশ জিম্মি
    Total Reply(0) Reply
  • নাজিম উদ্দিন ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১৪ এএম says : 0
    তিক্ত সত্যগুলো তুলে ধরার জন্য মোবায়েদুর রহমান সাহেবকে অসংখ্য মোবারকবাদ জানাচ্ছি
    Total Reply(0) Reply
  • মাসুম ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:১৫ এএম says : 0
    আইন করেছেন যারা তারা সরকারী দলের, আবার আইনটির বিরোধিতা করছেন যারা, তারাও সরকারী দলের। এগুলো এক ধরণের গোঁজামিল।
    Total Reply(0) Reply
  • এইচ.এম রাসেল ইসলাম ২৬ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:২৩ পিএম says : 0
    এবার যদি আমরা এই আইন বাস্তবায়ন করতে না পারি, এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ। নিরাপদ সড়ক আইনের মুখর প্রবক্তা ইলিয়াস কাঞ্চন এর সাথে আমি সহমত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন