পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সম্প্রতি বলেছেন, ‘সৌদি আরবে ২ লাখ ৭০ হাজার নারী কাজের জন্য গেছেন। এদের মধ্যে ৫৩ জন (মরদেহ) ফিরে এসেছে। এর মধ্যে ৮ হাজারের মতো ওখানের কাজ থেকে ফিরে এসেছেন। শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা খুবই সামান্য। ৯৯ শতাংশ নারী ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন, দেশে তারাও টাকাও পাঠাচ্ছেন।’ স্বাভাবিক মৃত্যু ৫০০ জনের মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু অত্যাচার, হত্যা বা অস্বাভাবিক মৃত্যু একজনেরও মেনে নেওয়া যায় কী? তার দায় মন্ত্রীমহোদয় কি এড়াতে পারেন কিংবা পারবেন? সবক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা বোঝার মতো শিক্ষা-জ্ঞান ও মানবিকতা থাকা জরুরি।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, মন্ত্রী মহোদয়, সংখ্যাটা আর কত বড় হলে আপনার কাছে গুরুত্ব পাবে, বেশি বলে প্রতীয়মান হবে? প্রশ্ন আরো আছে: বিদেশের দূতাবাসগুলোর শেল্টার হোমে অভিযোগ করার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা আছে কী? যেখানে নারীদের আটকে রাখা, বাইরে বের হতে না দেওয়া, এমনকি মোবাইল ব্যবহারেরও অনুমতি থাকে না, সেখানে তারা কীভাবে শেল্টার হোমে এসে অভিযোগ করবেন?
কয়েক দিন পরপর নারী কর্মীদের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে অভিবাসনের কঠিন চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছিল সৌদি সরকার। এরপর গৃহ খাতে নারী শ্রমিক নেয়ার শর্তে ২০১৫ সালে আবারও খুলে দেয়া হয় শ্রমবাজার। কিন্তু শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে অনেক নারীই দেশে ফিরে আসছেন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও তাদের অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা প্রদর্শন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে ফেরত আসা শ্রমিকরা তার বর্ণনাও দিয়েছেন। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব মর্মান্তিক ঘটনা ও মানবিক বিপর্যয়ের পরও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং মন্ত্রণালয়সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সৌদি আরবে নিযুক্ত নারী কর্মীদের ব্যাপারে দায়িত্বহীন ও অবমাননাকর বক্তব্য দিচ্ছেন। যা একদিকে বিস্ময়কর, অন্যদিকে আপত্তিজনক।
নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক নিপীড়নের কারণে কাজের নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নারী গৃহকর্মীরা ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৮শ’ নারী কর্মী। গত বছর তাদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৫৩ জন। তবে যারা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাড়ি চলে গেছেন তাদের কোনো তথ্যই নেই। প্রবাসে নারী কর্মীর করুণ মৃত্যু নিয়ে মন্ত্রীর কাছ থেকে এতোটা অসংবেদনশীল মন্তব্য অত্যন্ত অনভিপ্রেত। এতে মনে হচ্ছে, এই নারীরা অত্যন্ত দরিদ্র হওয়ায় আমরা তাদের মৃত্যুকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করছি, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
নারী শ্রমিকদের অবস্থা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব কার? এক্ষেত্রে দূতাবাসের ভূমিকা কতটুকু, তা পরিষ্কার নয়। দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সরাসরি ভিসা দেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে ভিসা কিনে আনছে। তাই যখন নারী গৃহকর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তখন তাদের দায়িত্বটা হলো বড়জোর ফেরত নিয়ে আসা। এভাবে তো হতে পারে না। এখানে রিক্রুটিং এজেন্সির দায়দায়িত্ব বাড়াতে হবে। কেননা যিনি ফেরত আসছেন, তার তো বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল। তাই রিক্রুটিং এজেন্সিকে পরখ করে দেখতে হবে, যে মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে তারা ভিসা কিনছে, সেটা সঠিক কি না। তাকে যেমন দায় নিতে হবে, তেমনি সরকারকেও দায় নিতে হবে। কেননা, সরকার এদের ভিসা সত্যায়িত করছে।
প্রবাসে শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো ধরনের মার্কেট রিসার্চ, বাজার গবেষণা বা জরিপ আছে বলে মনে হয় না। মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে শ্রমিক পাঠানোর জন্য এমন গবেষণা জরুরি বলে আমরা মনে করি। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন বা আইওএমের সহায়তায় যদিও বাংলাদেশে স্বল্প পরিসারে বাজার গবেষণা রয়েছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে গবেষণা করছে তা মোটেই যথার্থ নয়। গবেষণা বা মার্কেট রিসার্চে যে লিঙ্কগুলো খুঁজতে হবে তা হলো: আগামী ১০ বছরে বা ২০ বছরে ওই দেশ কী ধরনের লোক নিয়োগ দেবে, কী ধরনের ফার্মের মাধ্যমে নিয়োগ দেবে, কীভাবে বাজারে টেন্ডার আসবে, তাদের কী ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন আছে, এগুলো নিয়ে গবেষণা ও বাজার অপারেট করা। বিশেষ করে যারা নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছেন, তারা শুধু যে ভুক্তভোগী তা নয়, তারা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও। তাদের থেকেই নানা তথ্য-উপাত্থ্য ও ক্লু অতি সহজেই পাওয়া সম্ভব। বিশ্বব্যাপী এক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর বা মার্কেটিং এজেন্সিগুলো যেভাবে গবেষণা করে থাকে, বাংলাদেশেও সেভাবে গবেষণা করা জরুরি। বিশেষত ফিলিপাইন, নেপাল, ভারত, কম্বোডিয়া এ ধরনের বাজার গবেষণা করে থাকে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত যে কার্যক্রম অনুসরণ করে তা হলো, তাদের যেসব পেশাজীবী যেসব দেশে কাজ করছে, তাদের স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি করে থাকে। সেগুলোকে তারা বলে থাকে ‘সোশ্যাল সার্ভিস’। ওই গ্রুপ তাদের খোঁজ রাখে। যখন কোনো অন্যায়, অবিচার হয়, তখন গ্রুপ দূতাবাসকে জানিয়ে থাকে। এরকম একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে দূতাবাসের পক্ষেও যথেষ্ট সেবা দেয়া সম্ভব নয়।
শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ নতুন নয়। কিন্তু তা অনেকটা চিন্তা, গবেষণা ছাড়াই। বাজার তো ফাঁকা থাকছে না। কেউ না কেউ তো ঢুকবেই। ইতিমধ্যে অনেকেই ঢুকেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ তার জায়গা হারাচ্ছে। তাই জায়গা ধরে রাখতে হলে, দক্ষতা বাড়াতে হবে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও টেকনিক্যাল গ্রেডের প্রশিক্ষণ এবং ভাষাগত দক্ষতা বাড়াতে পারলে দেশের শ্রমিকরা বিদেশে অবশ্যই ভালো করতে পারবে। বিদেশে যেসব শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার একটা বড় কারণ কমিউনিকেট করতে না পারা। ভাষা না জানার কারণে অনেক সময়ে কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হয়। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নারী শ্রমিক নিচ্ছেন, সেসব ক্ষেত্রে নিগ্রহের ঘটনা বেশি ঘটছে। শিক্ষিত বা চাকরিজীবী পরিবারে যেসব নারী শ্রমিক যাচ্ছেন, তারা কম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা বলতে চাই, কারণ যেটাই হোক না কেন, হত্যা নির্যাতন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর ৫৩ হোক অথবা একজনের মৃত্যু হোক, প্রতিটা হত্যাকা-ই বাংলাদেশের জন্য লজ্জার, অপমানের, আর স্বজনদের জন্য অপুরণীয় ক্ষতির। সেক্ষেত্রে সৌদি আরবে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরও ব্যাপক হওয়া দরকার। আরেকটি বিষয় জরুরি হলো, ওখানে যাওয়ার পর নারী শ্রমিকদের খোঁজ-খবর নেওয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে। এক্ষেত্রে দূতাবাস ভূমিকা অগ্রগণ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে গৃহশ্রমিক হিসেবে যাওয়া নারীদের ক্ষেত্রে বেশি নির্যাতনের কারণ হলো, যেসব নারী শ্রমিক সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই ভিসা এসে থাকে ব্যক্তিগতভাবে। অর্থাৎ যারা ওই দেশে থাকছেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে একটা বা দুইটা ভিসা পাঠাচ্ছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভিসাগুলো অনেকটা সরকারি আওতার বাইরে। এমনকি, এসব ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোরও তেমন নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই। যারা ভিসা দিচ্ছে, তারা অদক্ষ শ্রমিকদের নিয়ে যাচ্ছে। ৮টি পেশায় লোক নেয়ার ক্ষমতা রয়েছে আরবের বাড়ির মালিকের। দারোয়ান, বুয়া, গার্ড, ড্রাইভারসহ আটটি পেশায় তারা লোক নিয়োগ দিতে পারে। এখানে দক্ষদের পাঠানো হচ্ছে কিনা, কে দেখবে? নারী কর্মীদের সমস্যা নিয়ে আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক হবে বলে জানা যায়। কর্মীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তার সুরাহা ও বেতন বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে শ্রমিক পাঠানো হয়, বিশেষত নারী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা, নিরাপত্তা নিশ্চিত, আইন ও বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত মজুরি কার্যকরে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গৃহকর্মী ও শ্রমিকদের শারীরিক-মানসিক অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন বন্ধে সামনের বৈঠকে বাংলাদেশ সরকার ও সৌদি সরকারের মধ্যে প্রয়োজনীয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগকর্তার নাম, বাড়ি ও কর্মস্থলের বিস্তারিত ঠিকানাসহ অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সব তথ্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ রাখতে হবে।
বাংলাদেশের যেসব রিক্রুটিং এজেন্টের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহশ্রমিকদের পাঠানো হয় তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য, চুক্তি, শর্ত ও সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলি আবশ্যিকভাবে মন্ত্রণালয়ে থাকাসহ প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্টের লাইসেন্স বাতিলের সাথে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব নারী দেশে ফিরে এসেছেন তাদের আর্থিক সামাজিক, পারিবারিক অধিকার এবং মর্যাদা নিশ্চিতের সাথে নির্যাতিতদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব। আমরা আশা করবো, শ্রমিকদের ন্যায্য ও যৌক্তিক আইনি সুরক্ষা এবং নিশ্চিত নিরাপত্তায় সরকার সবরকম পদক্ষেপ নেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।