পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত রোববার দৈনিক ইনকিলাব-এর ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠার একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: ‘বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লী’। সংবাদ প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে যা বলা হয়, তা হলো, বিশ্বের সব চাইতে দূষিত শহরের তালিকায় এক নম্বর স্থান দখল করে আছে ভারতের রাজধানী দিল্লী। পাঁচ নম্বরে কলকাতা, তার পরে মুম্বাই। দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম দশের তিনটি শহরই ভারতের।
ভারতের তিন তিনটি শহর বিশ্বের সব চাইতে দূষিত শহরের তালিকায় স্থান লাভ করার পেছনে সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে দূষিত শহরগুলোর দূষিত হওয়ার সম্পর্ক বাস্তবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, ভারতে শুধু বিশ্বের সব চাইতে দূষিত প্রথম দশটির তিনটিরই অবস্থান নয়, বরং ভারতের একশ্রেণির রাজনীতিবিদের কারণে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও চরম অবনতি হয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে যারা গবেষণা করেছেন বা করেন তারা সাক্ষ্য দেবেন, সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে দলটি সংগ্রাম করে পৌনে দু’শত বছরের ব্রিটিশদের পরাধীনতার কলঙ্ক থেকে ভারতকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে উন্নীত করে যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, সে দলটি এখন আর ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেই। ভারত এখন শাসিত হচ্ছে এমন একটি কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল দ্বারা, যার অন্যতম নেতা নাথুরাম বিনায়ক গডসে স্বাধীন ভারতের জাতির পিতা রূপে বহুল পরিচিত মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর অসম্প্রদায়িক চিন্তাধারার অপরাধে হত্যা করে।
ভারতে এখন চলছে এমন এক নেতার শাসন, যিনি তার নিজ জন্মভূমি গুজরাটের শাসক থাকাকালে মুসলিম বিরোধী গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি ‘গুজরাটের কসাই’ নামের কুখ্যাতি অর্জন করেন। এককালের সেই গুজরাটের কসাই নামধারী নরেন্দ্র মোদির চলছে এখন দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধান মন্ত্রিত্বের পালা।
যে ভারত এককালে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল সেই ভারতে নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনকালে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিজেপির নেতাকর্মীরা নির্বাচনী প্রচারণাকালে এমন কথা বলতেও এতটুকু লজ্জা বা সংকোচ বোধ করেননি যে, ভারতের মুসলমানদের দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করতে হলে নরেন্দ্র মোদকে পুনরিায় ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাতে হবে।
ভারতের কট্টর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির নেতাকর্মীদের এ দূরাকাংখা জয়যুক্ত হয়েছে। তাই এককালের বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মানিরপেক্ষ রাষ্ট্র রূপে পরিচিত ভারতে এখন চলছে কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের শাসন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে তাঁর দলের কট্টর সাম্প্রদায়িক নেতা-কর্মীদের দূরাকাংখা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে পূরণ করে চলেছেন তিনি (নরেন্দ্র মোদি)। এসব তথ্যও আমরা পেয়েছি বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম থেকে।
এসব খবরের মধ্যে রয়েছে: আসাম থেকে বঙ্গাল-খেদা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে আসামে এনআরসির নামে বেছে বেছে মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণ করে তাদের রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত করা। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদের জায়গায় রামের জন্মভূমির কল্পিত দাবির ভিত্তিতে রাম মন্দির করা। কট্টর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির শাসনকালের প্রভাবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়েও এর প্রতিফলন ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে একটি সংবাদ-মাধ্যমে যা বলা হয়েছে, তাহলো সুপ্রিম কোর্টের রায় সুপ্রিম হলেও তা যে অভ্রান্ত এমনটা মনে করার কারণ নেই।
এবার আসাম প্রসঙ্গে। আসাম থেকে বাঙালিদের বিতাড়নের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এক পর্যায়ে বঙ্গাল খেদা আন্দোলনের নামে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন নিরাপোস বিপ্লবী নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি সংগ্রামে জয়যুক্ত হওয়ার ফলে বঙ্গাল খেদা আন্দোলন তখনকার মতো ব্যর্থ হয়।
সে সময় আসামে চলছিল গোপীনাথ বরদলুই নামের এক সাম্প্রদায়িক হিন্দুর নেতৃত্বাধীন শাসন। তাঁর শাসনামলে আসামে শত শত বছর ধরে বসবাসকারী মুসলমানদের বঙ্গাল বলে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়িয়ে প্রচুর জনপ্রিয়তা
লাভ করেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
১৯৪৭ সালে যখন পৌনে দুশ বছরের সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের অবসনের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা সিলেট ছিল আসামের অন্তর্গত। তবে আসামের বিভিন্ন অঞ্চলেও প্রচুর সংখ্যক জনগণ ছিলেন মুসলমান। তাদের সংখ্যার নিরিখে বিশেষত তারা বাংলাভাষী হওয়াতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দাবি ছিল আসামকে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক জনপদ হিসাবে বাংলাদেশের অন্তর্গত হতে হবে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রবলভাবে বিরোধিতা করে এ দাবির।
এতে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার এ দুই পরস্পর বিরোধী দাবি সম্পর্কে সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সিলেটে একটি গণভোটের আয়োজন করে। এ গণভোটে পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসাবে আমিও যোগদানের সুযোগ লাভ করি। বলা বাহুল্য, এ গণভোট ছিল সিলেট
আসামে থাকবে না বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হবে সেটা নির্ধারণ করা।
এ গণভোটে যখন আমি অংশগ্রহণ করি তখন আমি ঢাকা সরকারি ইসলামিক ইন্টার মিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলাম। হাতে কোনো জরুরি কাজ না থাকায় এ সময় আমি মুসলিম লীগের অঙ্গ-সংগঠন মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড নামের একটি সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম। তখন সারা দেশে এমন অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যে, যে কোনো সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে।
এই ন্যাশনাল গার্ডে যোগদানের ব্যাপারে আমার আব্বা মরহুম হাজী হাবিলুদ্দিনেরও প্রচুর উৎসাহ ছিল। তিনি নিজে ভালো লাঠি খেলা জানতেন এবং অবসর সময়ে সুযোগ পেলেই আমাকে লাঠি খেলা শিক্ষা দিতেন। তাঁর দৃষ্টিতে লাঠি খেলার উপকারিতা এই যে, হঠাৎ শত্রæ পক্ষ তথা মুসলিম লীগ বিরোধী হিন্দুদের দ্বারা আক্রান্ত হলে লাঠি খেলার শিক্ষার মাধ্যমে তা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হওয়া।
সিলেটে গণভোটে যোগদানের ফলে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা আমার এখনও সুস্পষ্টভাবে মনে আছে। আমাদের প্রধান কর্মস্থল সিলেট শহর হলেও তৎকালীন সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেই আমাদের পাঠানো হয় গণভোটে মুসলিম লীগের পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিলেট বাংলাদেশের অংশ হবে, না কংগ্রেসের দাবি মোতাবেক আসামের অন্তর্গত থাকবে সে বিষয়ে গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করতে। আমরা বাংলাদেশ থেকে মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য হিসাবে যারা গিয়েছিলাম তার মধ্যে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত প্রচুর উর্দুভাষী অবাঙ্গালী মুসলমানও ছিল।
গণভোটে আমার অন্যতম সঙ্গী ছিলেন আমার চাচাতো ভাই এছাহাক আলী। গণভোটে এমন সব অঞ্চলে যেতে হয়েছিল যেসব এলাকায় প্রচুর অমুসলমানও বাস করতো। সেখানে পাঠানো হত দীর্ঘদেহী অবাঙ্গালী মুসলমানদের। অবাঙ্গালী মুসলমানদের হিন্দুরা বেশি ভয় করতো বলে এ সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের ফলে আমার সহযাত্রী চাচাত ভাই এছাহাক আলী এসব বিপদজনক এলাকায় যাওয়ার দায় থেকে বেঁচে গেলেও আমি দীর্ঘদেহী হওয়াতে আমাকে ঐসব বিপদজনক এলাকায় অবাঙ্গালী মুসলমানদের সঙ্গী হয়ে যেতে হতো।
তবে আমার প্রতি মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের প্রধানের নির্দেশ ছিল, আমি যেন খুব কম কথা বলি এবং যখন কথা বলি যতটা সম্ভব উর্দুতে কথা বলতে চেষ্টা করি। কারণ প্রতিপক্ষ হিন্দুরা অবাঙ্গালী মুসলমানদের বেশি ভয় করতো। আমি সেই নির্দেশ মোতাবেক যথাসম্ভব খুব কম কথা বলতাম, যখন কথা বলতাম যথাসাধ্য উর্দুতে কথা বলতে চেষ্টা করতাম।
এসব সত্তে¡ও গণভোট চলাকালীন সময়ে আমরা বাংলায়ই শ্লোগান দিতাম যেমন: (এক) আসামে থাকবো না, গুলি খেয়ে মরবো না। (দুই) আসাম সরকার জুলুম করে, নামাজের উপর গুলি করে। এ দুটি শ্লোগানের কারণ ছিল আসামের তৎকালীন কংগ্রেসী সমর্থক গোপীনাথ বরদলুই সরকার বেশ কয়েকবার জামাতে নামাজ আদায়রত ঈদ-জামাতের মুসল্লীদের উপর গুলি চালিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলার অপচেষ্টা চালায়।
আগেই বলা হয়েছে, সিলেটে গণভোট হয় সিলেট আসামে অমুসলিম সংগঠন কংগ্রেসের শাসনাধীন থাকবে, না বাংলাদেশে যোগ দিয়ে মুসলিম লীগের দাবি মোতাবেক মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ দেবে সে সম্পর্কে জনমত যাচাই করা। এলক্ষ্যে আমরা আরো কয়েকটা শ্লোগান ব্যবহার করতাম, মুসলিম লীগ কর্মী সমর্থকদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিতে। এসব শ্লোগানের অন্যতম ছিল: ‘সিলেটের গণভোটে কংগ্রেসের পরাজয়, নিশ্চয় নিশ্চয়।’
নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠকদের জানা থাকার কথা, সিলেটের গণভোটে মুসলিম লীগের দাবি জয়যুক্ত হওয়ায় সিলেট বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। অপর পক্ষে র্যাডক্লিফ গোয়েন্দাদের চক্রান্তের ফলে সিলেটের একটি অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে কংগ্রেস প্রধানত হিন্দু-অধ্যুষিত দল হওয়াতে ক্রমে ক্রমে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা ভারতে দ্রæত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার ফলে এককালের কংগ্রেস শাসিত ভারতে এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে উগ্র মুসলিম বিরোধী হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি এবং এখন চলছে ভারতে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংগঠন বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদির শাসন, যার প্রধান শিকার হয়েছে ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীর, তাছাড়া অন্যান্য রাজ্যেও চলছে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন ও দুর্বল করার ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের অপচেষ্টা, তার ফলে কংগ্রেস নেতাকেও কাশ্মীরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে শ্রীনগর বিমান বন্দর থেকেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।