পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কখনোই তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ও কল্যাণের মানদন্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ব্রিটিশ ঔপসিবেশিক আমলে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল স্থানীয় মুৎসুদ্দি ও কেরানি তৈরির লক্ষ্যকে সামনে রেখে। প্রথমেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে নৈতিক-দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও চিরায়ত ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রত্যাশিক উৎকর্ষের পথ থেকে বিচ্যুত করা হয়েছিল। শিক্ষার সাথে বৈষয়িক বিত্ত-বৈভবের যোসূত্রকে অবধারিত করে তোলার মধ্য দিয়েই শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণের সূত্রপাত ঘটেছিল। আমাদের শিশুদের যখন শিখানো হয়েছিল, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চরে সে’, তখন তার মন মগজে গেঁথে গিয়েছিল, লেখাপড়া করে সে অঢেল বিত্ত-বৈভব ও বাড়ি-গাড়ির মালিক হবে। এই শিশুটি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে যখন সরকারি চাকরি পেল, তখন তার শৈশবে-কৈশোরে প্রোথিত বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার স্বপ্নই তার চিন্তা-চেতনায় মূর্ত হয়ে উঠা স্বাভাবিক। সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে পেছনে ফেলে শিক্ষার সাথে ব্যক্তিগত বৈষয়িক অর্জন ও ভোগবিলাসের স্বপ্ন থেকেই শিক্ষার মানহীনতা ও অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিল। ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন এবং দেশে দেশে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে আলোকিত, উদার, দার্শনিক-আধ্যাত্মিক চিন্তাশীল মানুষ গড়া ও পরিচর্যার কেন্দ্র থেকে ভবিষ্যতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার ও অফিসার-আমলা গড়ার কারখানা হিসেবে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যতই আমাদের মন-মগজ ও জাতীয় সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা করা হোক না কেন, হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির বিবর্তনে গড়ে ওঠা আমাদের সমন্বিত মনোজাগতিক প্রকল্প পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি। এ কারণেই পথভ্রষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মধ্যে এত উৎকণ্ঠা, আক্ষেপ, হতাশা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও পুনর্গঠনের ভাবনা সদা সক্রিয় রয়েছে। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের গড়ে তোলা প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিক শিক্ষার ভিত্তিমূলে কিছু ইংরেজি শিক্ষিত দক্ষ আমলা, কেরানি সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলেও তা শিক্ষাব্যবস্থাকে সনদ-সার্টিফিকেট সর্বস্ব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক মুনাফাবাজির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে ভারত বিভাগের পর থেকে। প্রায় দুই শতাব্দির ঔপনিবেশিক শাসনের পর আমাদের জাতিরাষ্ট্রে গণমানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়াস-প্রচেষ্টা ছিল অনেকটা দায় সারা। এ কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয় লক্ষ্যের সাথে সমন্বিত করা কখনো সম্ভব হয়নি। সেই সাথে রাজনৈতিক দুর্গতি ও অস্থিতিশীলতার হাত ধরে স্বাধীনতার পর শিক্ষাব্যবস্থার অবক্ষয়-অবনতি ও স্খলনের নতুন গতি লাভ করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সনদের প্রতি মানুষের আগ্রহ, সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও প্রতিপালনে সরকারের ব্যর্থতার কারণে এক সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ে ওঠে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষায় বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষায় সরকারি, রেজিস্টার্ড, আনজেরিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন, ভোকেশনাল স্কুল থেকে শুরু করে ধর্মীয় শিক্ষায় ইবতেদায়ী, আলিয়া, বিভিন্ন নেসাবের মক্তব, নূরানি ও হাফেজিয়া মাদরাসা, বিভিন্ন ধর্মের মিশনারি স্কুলের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মান, পদ্ধতি ও অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে আকাশ-পাতাল ব্যবধান ক্রমে বেড়েই চলেছে। মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সুশিক্ষিত ও দক্ষ শিক্ষক এবং প্রত্যাশিত মানসম্মত যুযোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়নে সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে শিক্ষায় এই বৈষম্য সৃষ্টির সাথে সাথে শুরু হয় বেসরকারি বিনিয়োগের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা।
পাবলিক পরীক্ষায় উচ্চ গ্রেডসহ শতভাগ পাসের হার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে এক শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নগর জীবনে নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তোলার মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়। বর্তমানে তা শিক্ষার চেয়ে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস, সার্টিফিকেট বাণিজ্য এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক পেশিশক্তির ভাড়াটিয়া বাহিনীর কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। একেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতি, অপকর্ম, দুষ্কর্ম অন্যায় অবিচার ও রক্তাক্ত সংঘাত ও দখলবাজির ভয়ানক আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মাদক ব্যবহার ও কেনাবেচার আস্তানায় পরিণত করেছে। সেখানে একেকজন বড়ভাই যেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার। সেখানে তারা টর্চার সেল খুলে ভিন্নমতের সাধারণ শিক্ষার্থীদের টর্চার করে নিষ্ক্রিয়-নীরব করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হওয়ার আগেই কোটি কোটি টাকা ও বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে আয়েশি জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন। একদিকে হাজার শিক্ষার্থী পরিবারের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে অনেক কষ্টে শিক্ষাজীবন শেষ করেও প্রত্যাশিত চাকরির সোনার হরিণের দেখা পাচ্ছে না, অন্যদিকে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির ছত্রছায়ায় শিক্ষাঙ্গণের গন্ডি পার হওয়ার আগেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া করে নয়, শিক্ষাঙ্গণ এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে তারা অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি দমনের নামে দেশের বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী ও জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সুখ্যাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও ছাত্রাবস্থায় কোটিপতি হয়ে যাওয়া ফ্রাঙ্কেস্টাইনদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাসিনো জুয়া ও গ্রæপ অব কোম্পানিজ এর স্বত্বাধিকারী হওয়ার পর সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে যখন এদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে তখনো দুদকের ঘুম ভাঙ্গে না। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ তোলেন, এমন অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্রলীগের দু’চারজন শীর্ষ নেতাকে বহিষ্কার করা হলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যাপ্রলিয় ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের স্থানীয় কমিটিতে এমন শত শত নেতার দেখা মিলবে, যারা এক সময় খালেদ মাহমুদ, ইসমাঈল হোসেন সম্রাট, জি কে শামীম হয়ে ওঠার অপেক্ষায় আছেন। এদেরকে আগেই যদি জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে হয়তো আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সংকট থেকে রেহাই পেত। মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্রবাজির মতো ভয়াবহ সমস্যা থেকে আমাদের সমাজ অনেকটাই মুক্ত হতে পারত। ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লাঠিয়ালবাজির কারণে যে পরিমাণ ক্ষতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে পোহাতে হচ্ছে তা’ অপরিসীম ও অপূরণীয়। একচেটিয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু, অথর্ব করে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন বা উন্নয়নের ফানুস ওড়ানো রাজনৈতিক শ্লোগানবাজি দিয়ে এই ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো অস্ত্র ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। তবে চরম উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতা সত্তে¡ও এক ধরনের রাজনৈতিক সহাবস্থান ও গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ অক্ষুণœ ছিল। এমনকি সামরিক শাসনামলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চর্চা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা সামরিক শাসকরাও করেননি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে দেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক শতাব্দির ইতিহাসের সাথে হাত ধরাধরি করে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের রাজনৈতিক কার্যক্রম। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের গণআন্দোলন পর্যন্ত দেশের প্রতিটি রাজিনৈতিক সংগ্রামে যে কোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ও ছাত্র সমাজের ভূমিকা অনেক বেশি উজ্জ্বল ও গুরুত্ববহ। ডাকসুর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এটা প্রমাণীত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত হয়ে সব সময় পরিবর্তনের পক্ষেই রায় দিয়ে থাকেন। পাকিস্তান আমলে মুসলীম লীগ বা সামরিক শাসকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই করেনি। সেখানে বেশিরভাগ সময়ই বাম ধারার প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠনের প্রভাব বেশি দেখা গেছে। স্বাধীনতার বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেও বিরোধী জাসদ ছাত্রলীগকে ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করতে দেখা গেছে। ছাত্র সমাজের মধ্যে সরকার বিরোধী ভাবধারা বেশি সক্রিয় থাকার কারণেই সম্ভবত নব্বই সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর অনীহা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এ দীর্ঘ সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। এ সুযোগে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংস্কৃতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষমতার ছত্রছায়ায় পেশিশক্তি ও অস্ত্রের জোরে খর্ব করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার অপচেষ্ট করা হয়। সেই অপচেষ্টার ফলাফল ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। শিক্ষাঙ্গনের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতাসীনদের দলবাজি, দলীয়করণ, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে। শিক্ষকদের দলবাজি এখন স্কুল-মাদরাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদেরও দুর্নীতিগ্রস্ত ও কলুষিত করে তুলেছে। এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেছে নিম্ন থেকে উচ্চশিক্ষার মান। প্রাথমিক-প্রাকপ্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বুয়েট পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষায়তনে ক্ষমতার চর্চা, দলবাজি পেশিশক্তি ও মুনাফাবাজির চক্রে ফেলে ফায়দা লোটার খেসারত দিচ্ছে জাতি। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শ্রেণি পরীক্ষা, কনভোকেশন ও সনদ বিতরণের মতো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, গবেষণা ও নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রতিভার দ্বারা চলমান জাতীয় ও আন্তজার্তিক সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বিশ্বের ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও জায়গা পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি শিক্ষা ও গবেষণার চাইতে ১০ টাকায় চা, সিঙ্গারা ও সমুচা খাওয়ানোর সুযোগকেই তিনি গর্ব ও ঐহিত্য বলে মনে করেন। এ তথ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম উঠতো বলে তিনি দাবি করেছেন। শিক্ষা ও গবেষণার চাইতে যখন চা-সিঙ্গারা-সমুচার ভর্তুকি মূল্য একজন ভিসির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন সে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের কোন স্তরে অবস্থান করছে তা সহজেই অনুমেয়।
এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির নামে অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল, এখন তা নেই বলে কেউ কেউ আত্মপ্রসাদ বোধ করছেন। সহাবস্থান ও মতপার্থক্যের কারণে দ্ব›দ্ব সংঘাত হতে পারে, হয়েছেও। সে ক্ষেত্রে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতাই মূল ভূমিকা রেখেছে। মতপার্থক্য ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রুদ্ধ করে দিয়ে দ্ব›দ্ব-সংঘাত নিরসনের প্রয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে না। ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র সংসদের স্পেস রুদ্ধ করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের ফলাফল কী হতে পারে তা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ, অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার অপব্যবহার ও আইনের বরখেলাফ করে দলবাজির মানদন্ডে শিক্ষক ও ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার খেসারত দিচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গন। এক সময় ছাত্র সংগঠনগুলোর দ্ব›েদ্বর কারণে ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরত। এখন ছাত্রলীগের টর্চার সেলে ও সন্দেহজনক তুচ্ছ বিষয়ে প্রকাশ্য নির্যাতনে প্রাণহারায় শিক্ষার্থীরা। র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মনস্তাত্তি¡ক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থীর মধ্যে। গত দশক পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত হতেন। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সাথে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও চাটুকার রাজনীতিবিদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এই মুহূর্তে দেশের অন্তত ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ-আত্মসাৎ, অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে থাকা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এসব ব্যক্তিদের কেউ কেউ দলবাজি, ক্ষমতাসীন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কোটি টাকা চাঁদা দিয়ে দুর্নীতি-অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহারের মচ্ছব দেখে সাধারণ মানুষ ভিমরি খায়। স্বাভাবিক কারণেই এদের অনিয়ম-দুর্নীতি, অযোগ্যতার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিসির অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তুলেছে। এসব কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর থেকে বুয়েটের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং আহসানউল্যাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদত্যাগ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলামের দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা তার অপসারণের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং ২ ঘণ্টার নোটিশে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেই আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এ হচ্ছে আমাদের উচ্চশিক্ষার নমুনা। যারা উন্নত নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলী সম্পন্ন সৃষ্টিশীল, উদ্ভাবনী প্রতিভাবান দক্ষ ও আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার কথা তারাই এখন চরম অবক্ষয়-দুর্নীতি ও চারিত্রিক স্খলনের শিকার। এদের দিয়ে শিক্ষার কোনো মানদন্ডই রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট। দেশের লাখ লাখ যুবক উচ্চশিক্ষা নিয়েও উপযুক্ত কর্মসংস্খান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিদেশের ন্যূনতম বেতনের একটি চাকরির আশায় লাখ লাখ বাংলাদেশি যুবক অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্তত ১০ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশের ডিটেনশন ক্যাম্প ও কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। অথচ প্রতিবেশী দেশের লাখ লাখ কর্মী এসে গার্মেন্টস সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে দেশ থেকে শত শত কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরী ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বিনিয়োগ, উৎপাদনশীলতা ও রফতানিমুখী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে অথবা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের কর্মসংস্থান দিতে পারছেনা। দেশে সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা চরম আকার ধারণ করেছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চরম বৈষম্য ও লুণ্ঠনের যে নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে তা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতারই ফসল। জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রতিবনআধকতা অপসারণ এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা নির্ভর করছে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক পরিববর্তনের উপর।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।