পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বাকশাল কায়েম হয়েছিল। কাজটা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। এর পরের সপ্তাহ ও মাসগুলো আপাতদৃষ্টিতে ভালো ছিল বা শান্ত ছিল; কিন্তু গভীরে ভালো বা শান্ত ছিল না। পেছনের দিকে তাকিয়ে পরিণত বয়সে জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, ওই আমলের বাংলাদেশের রাজনীতির স্রোত, জনমতের স্রোত ও প্রশাসনের আনুগত্যের স্রোত দু’টি ভিন্ন দিকে যাচ্ছিল। দৃশ্যমান ওপরের অংশ একদিকে বহমান ছিল; অদৃশ্য গভীর জলের অংশ ছিল উল্টো দিকে বহমান। তৎকালীন মিডিয়ায় ও মিডিয়ার বাইরে ব্যক্তি ও সমষ্টিপর্যায়ে সরকারের বন্দনা বেশি হতো, সমালোচনা হতো কম। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আগস্ট মাস এসে গিয়েছিল। দেশের ভেতরের কিছু ষড়যন্ত্র এবং দেশের বাইরের কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কারণ মিলে একটি শক্ত আকৃতি নিয়েছিল। সব কিছুর পরিণতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন; যা দেশের জন্য শোকাবহ ঘটনা ও শোকাবহ দিন।
১৫ আগস্টের ঘটনার সংগঠক বা নেপথ্য নায়ক বা খলনায়ক একজন নন; সংখ্যায় একাধিক ও একাধিক অঙ্গনের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক মধ্যম আর কনিষ্ঠ সারির অফিসার একটা আঙ্গিকের ও একটি অঙ্গনের সংগঠক বা খলনায়ক। তৎকালীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সংগঠনভুক্ত তথা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রমের কমান্ডের অধীনে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ঘটনাগুলোতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডারের অগোচরে। সেনাবাহিনী সদর দফতর বা আর্মি হেডকোয়ার্টারের চিফ অব দি জেনারেল স্টাফের (সিজিএস) কমান্ডের অধীনে বা সিজিএসের সরাসরি অধীনস্থ থাকা অবস্থায় এবং তৎকালীন সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের অগোচরে বা গোপনে গোপনে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল একটি সাঁজোয়া ইউনিট বা আর্মার্ড কোরের রেজিমেন্ট, যেটির নাম ছিল: ‘প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার’। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অন্যান্য অফিসার। এটা হলো একটা আঙ্গিকের এবং একটি অঙ্গনের কথা। এখন অন্য একটি আঙ্গিকের কথা বলছি। স্বাধীনতার আগেকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই দশকের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সহচর ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর নামের ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন কেবিনেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গী দুই শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন আরেকটি আঙ্গিকের সংগঠক বা নায়ক বা নায়কমন্ডলী বা খলনায়কমন্ডলী। বিদেশী খলনায়করা তো ছিলই। তবে সেনাবাহিনী থেকে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে এবং বিদেশী নায়ক বা নায়কমন্ডলী নিয়ে যত কথাবার্তা হয়েছে, তার থেকে অনেক কম আলোচনা সমালোচনা পর্যালোচনা হয়েছে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধী, ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে।
’৭৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ অংশ বা সেনাবাহিনীর উচ্চতম পর্যায়ের অফিসাররা ব্যস্ত এবং তৎপর ছিলেন তাদের ওইসব সদস্যকে নিয়ে, যারা ১৫ আগস্টের ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন। ওই আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম সারির বেশির ভাগ কর্মকর্তার চিন্তার বিষয় ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের ভেঙে যাওয়া ‘চেইন অব কমান্ড’কে জোড়া লাগানো বা পুনঃস্থাপন করা। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? যেহেতু ১৫ আগস্টের ঘটনায় জড়িত অফিসাররা, তাদের উপরস্থ জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলেন, তাদের কী হবে, এটাই ছিল বিবেচ্য। আগস্টের ২৪ তারিখ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। সেনাবাহিনী অত্যন্ত ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হওয়া জাতীয় রক্ষীবাহিনী বা জেআরবি নামক সংগঠনটিকে ভেঙে দেওয়া হয়নি বা বাতিল করা হয়নি। এটিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যেই বা সেনাবাহিনীর ভেতরে একীভূত বা আত্তীকৃত করে ফেলা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন রণাঙ্গনের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সাথে যেসব স্টাফ অফিসার কাজ করছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি নিজে। ওই সুবাদে বলছি, সময় খুব ব্যস্ত এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ছিল। এর মধ্যে চাপা অবস্থায় বিরাজমান ছিল ওই দ্বন্দ্ব। এটি কী? দ্ব›দ্বটি হলো যারা ১৫ আগস্ট সংঘটিত করে ফেলেছে তারা কোথায় যাবে, কোন অবস্থায় থাকবে, কোন দায়িত্বে থাকবে? নাকি, তাদের দ্বারা কৃতকর্মটিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হিসেবে বিবেচনাকরে সেটির বিহিত করা হবে? এর সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না; এ বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টিতে বা সিনিয়র অফিসারদের কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছিল।
এরূপ পরিস্থিতিতেই সে আমলের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে কর্মরত সুনামধারী, মেধাবী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাহসী সেক্টর কমান্ডার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদী কর্মকান্ড অথবা কারো কারো দৃষ্টিতে ‘সংশোধনমূলক’ কর্মকান্ড সংঘটিত হয়। বাংলায় বলা যেতে পারে ‘সামরিক অভ্যুত্থান’। এর অংশ হিসেবে খালেদ মোশাররফ তার উপরস্থ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ১৫ আগস্টের সশস্ত্র নায়করা ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায় বন্দি অবস্থায় থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছিলেন অথবা করান। অভ্যুত্থানের ফলে তৎকালীন প্রধান প্রচারপতি এ এস এম সায়েমকে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল; মোশতাক কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন ছিল অব্যাহত। বাস্তবে জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন বিপ্লব বা বিদ্রোহটি আসলেই ভারতপন্থী ছিল, নাকি ভারতপন্থী ছিল না সেটি, কঠিন প্রশ্ন এবং এর উত্তর বের করা দীর্ঘ বিশ্লেষণের ব্যাপার। কিন্তু ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর দু-এক দিনের মধ্যেই কিছু লক্ষণের কারণে, খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানটি রাজনৈতিক অঙ্গনে, সচেতন জনগণের মনের ভেতরে এবং তৎকালীন বাংলাদেশের সৈনিকদের মনে একটি ‘ভারতপন্থী’ অভ্যুত্থান হিসেবেই রঙ পায়। সচেতন জনগণ ও সৈনিকগণ এটা পছন্দ করেনি। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু তত দিনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা, লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমের মতো মুক্তিযোদ্ধারা ‘বিগত’ হয়ে গেছেন।
৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঘটনার পর আরেকটা গোপন গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন জাসদের অনুপ্রেরণায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, আগ্রহে ও প্রয়োজনে (১৯৭৩-এর শেষাংশ থেকে) তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গোপন সংগঠন কাজ করত। সংগঠনটির নাম ছিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ ছিল সেনাবাহিনীর বাইরের একটি সংগঠন, সেটি ছিল জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামক রাজনৈতিক দলের গোপন অঙ্গসংগঠন, যার নাম ছিল ‘গণবাহিনী’। জাসদ নামক দলের আনুষ্ঠানিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আরো একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন জাসদের গণবাহিনীর প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, একজন মেধাবী সাহসী সেনা কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ তাহের বীর উত্তম। জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা চাচ্ছিল একটা ‘বড় রকমের’ বিপ্লব হোক। এই লক্ষ্যে তারা কাজ করছিল অনেক দিন ধরেই। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনার পর তারা সচকিত হয়ে উঠল। অতঃপর, তাদের অগোচরে ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা সবাই অস্থির হয়ে পড়ে এবং মনে করে ‘আবার কোনো অপরিকল্পিত ঘটনা হঠাৎ এসে না জানি বিপ্লবের পথে বাধার সৃষ্টি করে।’ তাই তারা স্থির করল ৭ নভেম্বরই তাদের কাজটি করে ফেলবে। তাদের মধ্যে যারা চরমপন্থী বা উগ্রপন্থী ছিল তারা সিদ্ধান্ত নিলো, সেনাবাহিনী হতে হবে ‘অফিসারমুক্ত’। তারা ঘোষণা দিলো ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই।’
ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ ৩ নভেম্বরের পরবর্তী দিনগুলোতে অন্যান্য স্তরে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে আলোচনা ও চিন্তা চলছিল, জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়েছিল, এ কাজটিকে সাধারণ সৈনিকরা কোনোমতেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি; সাধারণ সৈনিকগণ বেদনাহত হয়েছিলেন এতে। ইংরেজি পরিভাষায় বলা যেতে পারে, রাইটলি অর রংলি, অর্থাৎ সঠিক হোক বা বেঠিক হোক, ৪ ও ৫ নভেম্বর তারিখের মধ্যেই ধারণা জন্মে গিয়েছিল, যদি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা না যায়, তাহলে দেশ ‘বিপ্লবীদের’ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে অথবা অনাকাক্সিক্ষত সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। অতএব, জিয়াকে মুক্ত করতেই হবে। বলা বাহুল্য, জিয়াউর রহমান দেশবাসীর কাছে সুপরিচিত ছিলেন, ১৯৭১ সালে প্রথমে নিজের নামে ও পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কারণে। জিয়া সুপরিচিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে এবং সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন একজন ডায়নামিক ও ক্যারিসমেটিক সেনাবাহিনী উপপ্রধান এবং পরবর্তীকালে প্রধান হিসেবে। ১৯৭২-এর এপ্রিলে সবাই আশা করেছিল, জিয়াই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন। যেকোনো কারণেই হোক, তখনকার সরকার তাকে সেনাবাহিনী প্রধান বানাননি; বানিয়েছিলেন তারই ব্যাচমেট বা কোর্সমেট; কিন্তু জ্যেষ্ঠতার তালিকায় জুনিয়র, তুলনামূলক কম পরিচিত ও কম ক্যারিসমেটিক, তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার কে এম সফিউল্লাহকে। জিয়াউর রহমানকে বানানো হয়েছিল উপ-সেনাবাহিনী প্রধান। যথাক্রমে সেনাবাহিনী প্রধান বা উপপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার কিছু দিন পর, সফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমান উভয়েই মেজর জেনারেল হলেন। সৈনিকগণের এরূপ মানসিক প্রেক্ষাপটে, ৩ নভেম্বরের পর থেকেই নিজ বাসভবনে গৃহবন্দী, জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছিলেন সাধারণ সৈনিকরা।
৬ নভেম্বর দিনের শেষে রাত ১২টার পর ৭ নভেম্বর সৈনিকদের বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সৈনিকদের বিপ্লবটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। বড় অংশ ছিল অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন নিখাদ বাংলাদেশ প্রেমিক, জিয়াপ্রেমিক সৈনিকগণ। ছোট অংশ ছিল জাসদের প্রভাবিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যগণ ও অনুসারীগণ। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই ঢাকা মহানগরের জনগণ জড়িত হতে থাকেন এতে। সূর্য উদয়ের ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈনিকরা ঢাকা মহানগরে ছড়িয়ে পড়ে। রাতের মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন অংশে, একাধিক অফিসার ও অফিসারের পত্মী বিদ্রোহী বা বিপ্লবী সৈনিকদের হাতে নিহত হন। তবে নিহত ব্যক্তিরা পরিচিত হলেও হত্যাকারীদের শনাক্ত করা মুশকিল ছিল। ব্যক্তিগতভাবে, এ পর্যায়ে আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যাটালিয়ন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত থেকে ঘটনাবলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণ কোনো কিছুর সাতে-পাঁচে ছিলেন না, কিন্তু ৭ তারিখের প্রথম প্রহর তথা রাত একটা-দেড়টা থেকে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাপন্থী অর্থাৎ বিপ্লবী সৈনিকরা, শান্তিপ্রিয় শৃঙ্খলাপন্থী দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন দিক থেকে বৈরী প্রচারণা এবং আক্রমণাত্মক কর্মকান্ড প্রকাশ্যে শুরু করেছিল। উপস্থিত জ্যেষ্ঠতম অফিসার হিসেবে আমি পুরো ব্যাটালিয়নকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। জাসদপন্থী বিপ্লবী সৈনিকরা যেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সীমানার ভেতর অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করি। যে যে পন্থীই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই যেন সৈনিকে-সৈনিকে পারস্পরিক গোলাগুলি বিনিময় না হয়, সেটা নিশ্চিত করার পন্থা আবিষ্কার করেছিলাম। অতঃপর ভোর হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকদের সিপাহি-জনতার বিপ্লবে যোগদানে সহায়তা করি। উল্লেখ্য, এই দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈনিকগণ একান্তভাবে জিয়াকে ভালোবাসতেন এবং তার অনুরক্ত ছিলেন। ৭ নভেম্বর জাসদপন্থী সৈনিকদের ও জাসদ কর্মীদের বিপ্লব সূর্য উদয়ের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পানিতে যেমন চিনি গলে যায় ওইভাবে বিলীন হয়ে যায়। জীবিত থাকে এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে জিয়ার অনুরাগী হাজার হাজার সৈনিকের এবং হাজার হাজার জনগণের সম্মিলিত বিপ্লব। সেই থেকে এই দিনের নাম হয়েছে সৈনিক জনতার বিপ্লব বা বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ৭ নভেম্বর তারিখে জাসদপন্থী সৈনিকদের পরিকল্পিত ও আংশিকভাবে বাস্তবায়িত বিপ্লবটি ছিল জাতীয় সংহতিবিধ্বংসী, সেনাবাহিনীবিধ্বংসী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিধ্বংসী। সাধারণ সৈনিকগণ ও জনগণ মিলে প্রথমে জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে মুক্ত করে; অতঃপর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব মেনে ও তার দিকনির্দেশনায় জাতীয় সংহতি পুনস্থাপন করে; সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপন করে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শুরু হয়ে ২ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত ৮০ দিনের সময়টি প্রকাশ্যে নিশ্চুপ হলেও অভ্যন্তরীণভাবে থমথমে ও অনিশ্চিত ছিল। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের ভোর পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই অস্থিতিশীল ও দুর্ঘটনাসম্ভবা (ভোলাটাইল অ্যান্ড পোটেনশিয়ালি এক্সপ্লোসিভ) ছিল। এরূপ সময়ের শেষে এক অগ্নিগর্ভ মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সেনাবাহিনীর দায়িত্বের অতিরিক্ত, অবশ্যই পরোক্ষভাবে, পুরো দেশ ও জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। যদি ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ তথা তৎকালীন জাসদ তাদের নেতিবাচক বিপ্লবাত্মক কর্মকান্ডে সফল হতো, তাহলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব থাকত কি থাকত না, সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। কারণ তাদের শ্লোগানই ছিল ‘অফিসারবিহীন সেনাবাহিনী’। যদি জাসদ সফল হতো, তাহলে ওই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে, পাশের দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করত কি করত না, সেটিও একটি বিরাট প্রশ্ন। অর্থাৎ তিনটি মৌলিক বিষয় যথা: দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ত; জাতি একাধিক ভাগে বিভক্ত হতো; গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রচুর ও যথেষ্ট ছিল। এমন একটি সময়েই জিয়া দেশের হাল ধরেছিলেন, ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ভোরে। তিনি বিভক্ত জাতিকে সংহত করার কঠিন প্রক্রিয়া শুরু করেন। ৭ নভেম্বরের বিকেল থেকেই পরবর্তী দেড়-দুই দিনের চ্যালেঞ্জ ছিল, সৈনিকদের হাতে হাতে ঘুরছিল যে অস্ত্র, সেই অস্ত্রকে অস্ত্রাগারে ফেরত আনা এবং পথে পথে ঘুরছিল যে সৈনিক, সেই সৈনিকদের নিজেদের ব্যারাকে ফেরত আনা। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত শান্ত কিন্তু দৃঢ় মনোভাব ও বক্তব্যের মাধ্যমে, সৈনিকদের ওপর অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপনের কাজটি শুরু করেন। সৈনিকগণ যেন অস্ত্র জমা দেয় সেটি নিশ্চিত করেন। সৈনিকদের মনে পুঞ্জীভূত কষ্টগুলো দূর করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন; এসব কথা একজন চাক্ষুষ বা অনুভূতিশীল সাক্ষী হিসেবেই বলছি। আমরা যদি ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখের প্রশাসনের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব, মাত্র দুই দিন পুরনো একজন প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ ৫ নভেম্বর তারিখ সকালে নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু ওই মহামান্য প্রেসিডেন্টের কোনো মন্ত্রিসভা ছিল না। সে মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সায়েম বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালনা করতেন বা করছিলেন, সেটি একটি গবেষণার বিষয়। সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট সায়েম, জিয়াউর রহমান এবং তিন বাহিনী প্রধানদের সহায়তা গ্রহণ করেন এবং বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক কারণেই বৃহত্তম বাহিনী তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যিনি প্রধান, সেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহায়তা তিনি সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেছেন। অনেক দিন ধরে, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তথা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সায়েম এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ মোট তিনজন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মিলেই সরকারের নীতিনির্ধারণী দায়িত্ব পালন করেন। একটি কঠিন ও গভীর গভর্ন্যান্স ক্রাইসিস থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করেছিলেন জিয়াউর রহমান ও তার সহকর্মীগণ। উদারভাবে মূল্যায়ন করলে বলাই যায় যে, দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিলেন জিয়া। তাই অভিনন্দন পাবেন জিয়াউর রহমান এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।