চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুফতী ওয়ালীয়ুর রহমান খান
ইসলামী শরীয়তের উৎস চারটি : ১। আল-কুরআন। ২। আস-সুন্নাহ। ৩। আল-ইজমা। ৪। আল-কিয়াস। সুন্নাহ তথা হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদায়কৃত তারাবীহ নামাযের রাকআত সংখ্যা বিভিন্ন রকম থাকায় এবং ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি মানুষকে নিয়ে জামাআত নিয়মিত না করায় হযরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা ও আমল দ্বারা তারাবীহ নামায বিশ রাকাত সাব্যস্ত হয়েছে।
সহীহ ও দঈফ মিলিয়ে রাতের নামায বা কিয়ামুল লাইল এর পরিমাণ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত আছে। বিভিন্ন হাদীসে ১১ থেকে ৪১ রাকাত পর্যন্ত নবীজীর আমল পাওয়া যায়। এসবের মর্ম সম্পর্কেও উম্মাতের ইমাম তথা বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতভেদ আছে। যে কারণে আহলে হাদীস বা লা-মাযহাবি পরিচয়দানকারী ব্যক্তিরা তারাবীহকে অস্বীকার করে তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত ১টি হাদীস দিয়ে ৮ রাকাত পড়েন এবং অন্যান্য মানুষকে তাদের অনুসারী হওয়ার দাওয়াত দেন। তাদের এসব বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে বিশেষ করে টেলিভিশনের কিছু ধর্মীয় আলোচকের কারণে দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ আহলে হাদীস না হওয়া সত্ত্বেও তারাবীসহ কিছু কিছু আমলে বৈপরিত্ব প্রকাশ করছেন। অথচ ব্যক্তিগত চর্চার ক্ষেত্রেও মুজতাহিদ পর্যায়ের আলেম ব্যতীত কারো পক্ষে এমনভাবে এক আমল এক ধারা অনুযায়ী করা বৈধ নয়। এতে স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ পায় দীনের আনুগত্য থাকে না। মহান আল্লাহ বলেছেন: হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আর অনুগত্য কর তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞান-ভিত্তিক নির্দেশ দাতা তাদের। (সূরা আন-নিসা-৫৯) তিনি অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, যে বিশুদ্ধচিত্তে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর। (সূরা লুকমান-১৫)
কুরআন এক, সুন্নাহ অনেক, ব্যাখ্যা আরো অনেক, তাই চার মাযহাব হয়েছে
পবিত্র কুরআনের অনেক বাণীই ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ বিষয়। মহানবী (সা.) এর বিভিন্ন রকম হাদীস অর্থাৎ একেক দিন একেক ধরন ও পরিমাণের আমল থেকে সাহাবায়ে কেরাম যে আমলটি নিজের জীবনে চর্চা করেছেন বা অনুসারীদের (তাবিঈন) শিক্ষা দিয়েছেন তার ভিত্তিতেই আমলের কয়েকটি ধারা বা মাযহাব প্রণীত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত, প্রযোজনীয় কিতাবাদি এবং পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাকারী ইমাম বা ফকীহ বিদ্যমান থাকায় চারটি মাযহাব উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্যের দ্বারা সারা বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে।
বিশ্বের ১৪টি দেশে হানাফি, ২০টিতে মালিকি, ৮টিতে শাফিঈ এবং ২টিতে হাম্বালি মাযহাবের অনুসারী মুসলিমগণ বাস করেন। (ড.আহমদ আব্দুল কাদের, মুসলিম বিশ্ব:ধর্ম ও রাজনীতি, নয়াদিগন্ত, ৯ এপ্রিল ২০১৬)
সুতরাং লা-মাযহাবী বা আহলে হাদীস সম্প্রদায় মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃত কোন সম্প্রদায় নয়।
চার মাযহাবের সিদ্ধান্ত ও দলিল
চার মাযহাবের ফিকহ গ্রন্থ ‘কিতাবুল ফিকহি ’আলাল মাযাহিবিল আরবা’আহ’য় বর্ণিত হয়েছে- “ তারাবীহর নামায সুন্নতে মুআক্কাদাহ। পুরুষদের জন্য জামাআতের সাথে আদায় করা সুন্নতে মুআক্কাদায়ে কিফায়াহ। পূর্ণ এক খতম কুরআন এতে তিলাওয়াত করা সুন্নত। (মহিলাদের জন্য জামাআতে নামায সুন্নত নয়। তারাবীহর জন্য মহিলাদের মসজিদে আসা মাকরূহ। তাদের ঘরে নামায পড়া উত্তম। কারণ পর্দা অক্ষুণœ রাখা ফরজ। ) “বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সা. রমযানের কয়েকটি রাতের মধ্যভাগে বের হয়ে আসেন; এগুলি ভিন্ন তিন রাত: ৩য়, ৫ম ও ২৭তম রাত; মসজিদে নামায আদায় করেন। লোকেরা তাঁর পিছনে নামায পড়েন এবং তিনি সাহবাগণকে নিয়ে আট রাকাআত পড়ে ঘরে চলে যান এবং বাকি নামায পূর্ণ করেন সাহাবাগণও তাদের ঘরে বাকি নামা আদায় করেন; যে জন্য বাইরে থেকে মৌমাছির গুঞ্জরনের মত আওয়াজ শোনা যায়। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি তারাবীহ নামায উম্মতের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন। এর জন্য জামাআত হবে। কিন্তু তিনি সবাইকে নিয়ে ২০, (২৪, ৩৬ বা ৪১ ) রাকাআত পড়েননি; মধ্যম পরিমাণ হিসাবে ২০ রাকাআত সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চালু হয়ে সকল যুগ এবং আজ পর্যন্ত চালু আছে। তিনি ২০ রাকাআত এবং জামাআতের নিয়ম অব্যাহত রাখেননি এই ভয়ে যে, এতে তারাবীহ উম্মতের ওপর ফরজ হয়ে যাবে। আর এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, এর রাকাআত সংখ্যা ৮ এ সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, তারা বিতরসহ বাকি নামায ঘরে পূর্ণ করেছেন। হযরত ওমর রা. এর আমল এ কথা স্পষ্ট করেছে যে, তারাবীহর নামায ২০ রাকাআত। এমনকি তিনি সকল মুসলমানকে এ সংখ্যার ওপর মসজিদে কায়েম করে গিয়েছেন। তাঁর সময়ে এবং পরে কোন সাহাবী এর বিপরীতে একটি কথাও বলেননি। বরং সকল সাহবাবী এর উপর ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।.. সুতরাং সাব্যস্ত হলো যে বিতর বাদে তারাবীহ নামায বিশ রাকাত। (‘কিতাবুল ফিকহি ’আলাল মাযাহিবিল আরবা’আহ’, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া, বৈরুত, খ.১, পৃষ্ঠা-৩১০, তারিখ ১৯৯০)
বিশ রাকাআত তারাবীহর সমর্থনে হাদীস
এ দেশে যারা আট রাকআত নফল নামাযের পক্ষপাতী তাদের কিছু উগ্র ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, বিশ রাকআত নামায পড়ার পক্ষপাতীগণ এর সমর্থনে একটি সহীহ হাদীসও পেশ করতে পারবেন না। তাদের উগ্রবাদী কেউ লাখ লাখ টাকার বাজি ধরে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে লিফলেট প্রকাশ করেন, যা কোন ইলমী ভালো মানুষের কাজ হতে পারে না। যাহোক, এদের লজ্জিত হওয়া উচিত যে, হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত আট রাকআতের হাদীসের পাশাপাশি সহীহ বুখারীতেই হযরত ইবনে আব্বাস র. কর্তৃক বর্ণিত ১২ (বার) রাকআত সংক্রান্ত হাদীসটি বিদ্যমান। তারা বার বা অন্যান্য সহীহ হাদীসে বর্ণিত সংখ্যা বা রাকাআতের কথা কেন বলেন না? মুসলিম, নাসাঈ, আবুদাউদ ও তিরমিযীরগুলোও তো সহীহ হাদীস। নাকি শয়তান সব আমলে কম পরিমাণে থাকার এবং মানুষকে কমের মধ্যে রাখার সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের ওয়াসওয়াসা দিতে পেরেছে। আল্লাহ হেফাযত করুন।
১। ইমাম মালিক (র) ইয়াযিদ ইবনে রূমান (র) হতে বর্ণনা করেনÑতিনি বলেছেন ঃ ওমর ইবনে খাত্তাব (রা)-এর খিলাফতকালে রমযানে লোকজন তেইশ রাক’আত তারাবীহ পড়তেনÑতিন রাক’আত বিতর এবং বিশ রাক’আত তারাবীহ। (সহীহ মুআত্তা মালিক, হাদীস নং-৩১৯, পরিচ্ছেদ-কিয়ামে রমযান বা তারাবী নামাযের বর্ণনা)
হযরত ওমর, হযরত ওসমান , হযরত আলী রা. এবং ইমাম আযম, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকসহ অসংখ্য অগণিত সাহাবী তাবেয়ী ও ইমামগণ এর ওপর আমল করেছেন। আজ পর্যন্ত মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে ২০ রাকাআত তারাবীহ ও ৩ রাকাআত বিতর পড়া চালু রয়েছে। এটাই হযরত ওমর শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (স.) যে তিন দিন জামাত সহকারে এ নামায পড়েছেন তার বর্ণনা সম্বলিত হাদীসে রাকআত সংখ্যার উল্লেখ নাই। চার মাযহাবের পাশাপাশি হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞ আলেমগণ বিশ রাকআতের পক্ষে রায় দিয়েছেন এবং তাই এ মাযহাবের অনুসারীগণ বিশ রাকআত তারাবীহ পড়ে থাকেন। এ সমাজে অন্য ধারার আমলের প্রচার অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা যেমন মক্কা বা মদীনা গিয়ে ঐ সমাজের মানুষকে হানাফি ধারার দাওয়াত দেওয়া অপরাধ।
একটু আগে ইমাম মালেক র. এর আল মুওয়াত্তা গ্রন্থে সংকলিত বিশ রাকআত সংক্রান্ত হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে। উপরাক্ত হাদীসের রাবী ইয়াযীদ ইবনে রুমান (র) সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি উমার (র.) যুগ পাননি। অতএব হাদীসটির সনদসূত্র বিচ্ছিন্ন। এব জবাব হল ইমাম মালেক (র.) এর মুওয়াত্তা গ্রন্থে এমন কোন হাদীস নেই যা অন্যান্য সূত্রে মুত্তাসিল নয়। তাছাড়া তিনি তার সমাজে তারাবীহ নামাযের যে বাস্তব চিত্র দেখতে পেয়েছেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন। তাতে উমার (রা) এর সাথে তার সাক্ষাৎ না হলে কিছু যায় আসে না। তিনি তো দাবি করেননি যে, তিনি হাদীসটি হযরত উমার (রা.)র মুখে শুনে বর্ণনা করছেন। দ্বিতীয়ত ,ইমাম আবু হানীফা র. এর মতে মুরসাল হাদীস শরীআতের দলীল হিসাবে সাধারণভাবেই গ্রহণযোগ্য।
২। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন. নবী করীম সা. রমযান মাসে জামাআত ব্যতিরেকে বিশ রাকআত ও এক রাকআত বিতর পড়তেন
বরাত: ইমাম বায়হাকীর আস-সুনানুল কুবরা , বাব মা রুবিয়া ফী আদাদি রাকআতিল কিয়াম ফী শাহরি রামাদান, ২খ, পৃ.৪৯৭, ইবনে আবু শায়বা, আল-মুসান্নাফ, ২খ, পৃ.৩৯৪, নাসবুর রায়া, ২খ, পৃ.১৫৩, তাবরানীর আল-মু’জামুল কবীর গ্রন্থেও এটি বর্ণিত হয়েছে। উপরোক্ত হাদীসের সনদ দুর্বল হলেও পরপর তিনজন খলীফার (হযরত উমার, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম ) খেলাফতকালে এবং চার মাযহাবের অনুসারীদের শত শত বছর ধরে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়ার দ্বারা হাদীসের বক্তব্য শক্তিশালী হয়েছে। তাছাড়া কোন হাদীস মওযু প্রমাণিত না হলে তদনুযায়ী আমল করা যায়। মুহাদ্দিসগণ এটির সনদে দুর্বলতা আছে বললেও তাদের কেউ এটিকে মওযু বলেননি।
ইমাম বায়হাকীর সুনান আল-কুবরা শীর্ষক হাদীস গ্রন্থে আস-সাইব ইবনে ইয়াযীদ র.সূত্রে নিম্নোক্ত হাদীস বর্ণিত আছে।
৩। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা.এর খেলাফতকালে লোকজন রমযান মাসে বিশ রাকআত তারাবীহ নামায পড়তেন। তাতে তারা দাঁড়ানো অবস্থায় দুই শত আয়াত পর্যন্ত পড়তেন। তারা উসমান রা.-র খেলাফতকালে (দীর্ঘক্ষণ) দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টের কারণে তাদের লাঠিতে ভর দিতেন। (২খ., প্র, ৪৯৬, বায়াহাকীর মা’রিফাতুস সুনান)।
আল্লামা ইমাম নববী, ইমাম যায়নুদ্দীন আল-ইরাকী ও ইমাম জালালুদ্দীন আস সুয়ুতী র. সুনানুল কুবরার সনদসুত্রকে সহীহ বলেছেন। আর আল্লামা তাজুদ্দীন আস-সুবকী ও মোল্লা আলী আল -কারী (র). মা’রিফাতুস সুনানে এ সনদসুত্রকে সহীহ বলেছেন।
আরো কয়েকটি দলিল
ইবনে আবু শায়বার আল- মুসান্নাফ গ্রন্থে আরো বর্ণিত আছে যে, আবুল খাত্তাব র. বলেন, সুওয়াইদ ইবনে গাফালা রা. রমযান মাসে আমাদের ইমামতি করতেন এবং পাঁচ সালামে বিশ রাকআত তারাবীহ নামায পড়াতেন ( আল-মুসান্নাফ, ২খ, ৩৯৩)
হযরত আলী রা.এর সহচর শুতাইর ইবনে শাকল র. থেকে বর্ণিত যে, তিনি রমযান মাসে লোকদের ইমামতি করতেন এবং বিশ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআতে বেতের পড়াতেন (পূর্বোক্ত বরাত, পৃ. ৩৯৩।
আবু আবদুর রহমান আস-সুলামী র. বলেন, হযরত আলী রা. রমাযান মাসে কারীগণকে ডেকে আনেন এবং তাদের মধ্য হতে একজনকে লোকদের সাথে নিয়ে বিশ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দেন। রাবী বলেন, আলী রা. তাদের সাথে বেতের পড়তেন (পূর্বোক্ত বরাত, পৃ. ৩৯৩। আবুল হাসনা র. বলেন, আলী রা. এক ব্যক্তিকে লোকদের নিয়ে পাঁচ সালামে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দেন। (পূর্বোক্ত বরাত, পৃ. ৩৯৩।
ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ র. বলেন, ইমার ইবনুল খাত্তাব রা. এক ব্যক্তিকে লোকদের বিশ রাকআত তারাহীহ পড়ানোর নির্দেশ দেন। (পূর্বোক্ত বরাত, পৃ. ৩৯৩।)
নাফে’ ইবনে উমার র. বলেন , ইবনে আবু মুলাইকা র. রমযান মাসে আমাদের নিয়ে বিশ রাকআত নামায পড়তেন। (পূর্বোক্ত বরাত, পৃ. ৩৯৩)
উবাই ইবনে কা’ব রা. মদীনায় লোকদের নিয়ে বিশ রাকআত নামায পড়তেন এবং বেতের পড়তেন তিন রাকআত (্্ঐ, পৃ.৩৯৩)
আল-হারিস (র.) রমযানের রাতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বেতের পড়তেন এবং রুকুতে যাওয়ার পূর্বে দোয়া কুনুত পড়তেন। (্্ঐ, পৃ.৩৯৩)
আবুল বাখতারী (র) রমাযান মাসে পাঁচ সালামে বিশ রাকআত তারবীহ নামায পড়তেন এবং তিন রাকআত বিতর পড়তেন। (্্ঐ, পৃ.৩৯৩)
তাবেঈ হযরত আতা (র.) বলেন. আমি লোকদেরকে বেতেরসহ তেইশ রাকআত তারাবীহ আদায়রত পেয়েছি। (্্ঐ, পৃ.৩৯৩)
সাঈদ ইবনে উবাইদ র. বলেন, আলী ইবনে রবীআ র, রমযান মাসে তাদেরকে নিয়ে পাঁচ সালামে বিশ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বেতের পড়তেন। (ঐ, পৃ.৩৯৩)
মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে তারাবীহ নামায ২০ রাকাআত
যারা আট রাকআতের পক্ষে তারা বিশ রাকআত পড়ুয়াদেরকে কটাক্ষ করেন। অথচ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দুই মসজিদ Ñ মক্কার মসজিদে হারাম (বাইতুল্লাহ শরীফ) ও মদীনার মসজিদে নববী অর্থাৎ হারামাইন শারীফাইন। তাদেরই প্রতিনিধিত্বকারীদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে। তারাই এই দুই মহান মসজিদের ইমাম নিয়োগসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন। সেই দুই মসজিদে রমযান মাসে এশার নামাযের পরে পর্যায়ক্রমে দুইজন ইমামের ইমামতিতে দশ রাকআত করে বিশ রাকআত তারাহীহ নামায অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৪০০ বছর ধরে। অতঃপর তিন রাকআত বিতর পড়ে এই নামায শেষ করা হয়। প্রথম ইমাম দশ রাকআত পড়িয়ে চলে যান না, বরং দ্বিতীয় ইমামের পিছনে বাকি দশ রাকআতও আদায় করেন এবং দ্বিতীয় ইমামও প্রথম থেকেই তারাবীহ নামাযে উপস্থিত থাকেন। যা কেবল নামাযীরাই দেখেন এমন নয় বরং বিশ্বের সকলের সামনে সরাসরি সম্প্রচারও হয়।
তাহাজ্জুদ মধ্যরাতের পর ৮, ১২ বা বেশিসংখ্যক রাকাআত
বুখারী শরীফের ১৫৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত অনেক হাদীসের মধ্যে হযরত আয়েশার হাদীসটি তাহাজ্জুদ নামাযের দলিল। এর আমল সারা বছর সারা বিশ্বের মুসলমানরা ঘরে করেন আর কোথাও রমজানে মসজিদে করেন। যেমনটি আমরা হারামাইনে দেখতে পাই। ২০ রাকাআত তারাবীহ থেকে আলাদা। এবং মধ্য রাতের পর। অতঃপর শুরু হয় সালাতুল লাইল এর আট বা বারো রাকআত নামাযের জামাআত। সারা রাত ধরে এই দুই মহান মসজিদে চলতে থাকে রাতের প্রথমাংশে ২০ রাকাআত তারাবীহ আর শেষাংশে ৮ বা ১২ রাকাআতের তাহাজ্জুদ নামায।
রমযানের শেষ দশ দিনের রাতের অবস্থা এমন হয় যে, এই দুই মসজিদে তিল ধরার ঠাঁই থাকে না।
হারামাইন শরীফাইনের ২০ রাকাআত পড়ার ব্যাপারে আহলে হাদীস পরিচয়ের লোকেরা (রাজ্জাক বিন ইউসুফ) ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, এ নিয়ম তুর্কি শাসনামলে চালু হয়েছিল তাদের প্রভাবে বর্তমান সউদি শাসকরাও এটা চালু রেখেছে। পাঠক লক্ষ করুন, হাস্যকর যুক্তি ও ইলমী প্রতারণা! মাতাফ সম্প্রসারণের জন্য যেখানে তুর্কি আমলে নির্মিত মসজিদ, স্থাপনা ও নান্দনিক সকল মূল্যবান সাজ-সজ্জা বর্তমান সউদি শাসকরা ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে ফেলছে, তারা সহীহ হাদীসের দ্বারা ৮ রাকাআত চালু করতে পারছেন না! কী যুক্তিহীন কথা!!
আসলে এগুলো কোন আলেমের কথা নয়। আলেমদের কথা হলো, তারাবীহর বিভিন্ন রেওয়ায়েত যেমন, ১১, ১৩, ১৬, ২৩, ২৬, ৩৬, ৪১ ইত্যাদি রাকাআত সংখ্যার মধ্যে চার মাযহাবের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত আছে মধ্যম সংখ্যা ২৩ রাকাআতের ওপর। আর মক্কা ও মদীনার আলেমরা হাম্বলী মাযহাবের আনুসারী হওয়ায় ২০ + ৩ = ২৩ রাকাআত আদায় করছেন। এরপর তাহাজ্জুদ হিসাবে রাত ১টার পর ৮ বা ১২ রাকআত আদায় করছেন। সাধারণ মানুষের জন্য এর চেয়ে বাস্তব প্রমাণ আর কী হতে পারে?
বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীসটি ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ এবং ৩ রাকাআত বিতরের দলিল ঃ
আহলে হাদীস পরিচয়ের আলোচকরা বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা রা. এর যে হাদীস দ্বারা তারাবীহ প্রমাণ করেন সেটা ৩ রাকাআত বিতর ও তাহাজ্জুদের ১টি দলিল। এখানে তাদের একটা চতুরতা বা অজ্ঞতা অথবা অসংলগ্নতা পরিলক্ষিত হয়। তারা এ হাদীস দ্বারা অযৌক্তিকভাবে তারাবীহ প্রমাণের চেষ্টা করেন অথচ এর মধ্যে বর্ণিত ৩ রাকাআতের বিতর নামাযের আমল করেন না। বিতরের ক্ষেত্রে এটা সহীহ না? নাকি হানাফিদের বিরোধ করা উদ্দেশ্য বা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির কোন বিদেশী এজেন্ডা আছে? শরীয়তের গ-ির মধ্যে মানুষ বেশি আমল করলে তো আলেম ও দাঈ হিসাবে আমরা আপনারা পরকালে লাভবান হবো। তাহলে বাধা দান বা কমানোর চেষ্টা কেন?
সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা যার দোহাই দিয়ে এসব গোজামিলের কাজ করে সমাজে বিভক্তি ও ফাসাদ সৃষ্টি করেছেন, সেই ইমাম বুখারী এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন তাঁর সহীহ বুখারীরর তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে। যার নাম কিতাবুত তাহাজ্জুদ। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। বাবুত তাহাজ্জুদ। উপশিরোনাম হলো, ‘বাবু কিয়ামিন্নাবিয়্যি (সা.) ফী রমাদানা ওয়া গাইরিহী’ অর্থাৎ রমজান ও রমজান ছাড়া অন্য সময়ে নবীজী (সা.) এর রাতের নফল নামায। উপরন্তু হাদীসটির মধ্যেও ‘রমজান ও রমজান ছাড়া অন্য সময়ে’ কথাটি থাকায় একথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এটা তাহাজ্জুদের কথা তারাবীহ নয়। কারণ রমজান ছাড়া তো তারাবীহ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বুখারী শরীফ হাদীসের ১টি সংকলন। তাঁর ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি (শাফেঈ মাযহাব) এর আলোকে তিনি এর তরজমাতুল বাব কায়েম করেছেন। শরীয়তের অনেক কিছুই যেমন এখানে আসেনি, তারাবীহর কোন স্পষ্ট হাদীসও এখানে আসেনি। সাধারণভাবে কিয়ামুল্লাইল প্রসঙ্গে অনেক হাদীস এসেছে। এখন কোনটার ওপর আমল করবেন? সাহাবাগণ যার ওপর করেছেন তার ওপর। এর পর আর কোন কথা নেই।
সহীহ হাদীস ৬ কিতাবে সীমাবদ্ধ নয়। সহীহ, হাসান ও জইফ ৩টি পরিভাষা
একটি বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে যে, সংকলকদের নিজস্ব মানদ-ের (ক্রাইটেরিয়া) বিচারে তারা তাদের পর্যন্ত পৌঁছানো সনদের কোন অংশের সমস্যার কারণে এসব পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। মূলত শরীয়ত রচনার সময়ে সাহাবী, তাবেঈ ও ইমামগণের নিকট সংরক্ষিত থাকা অবস্থায় এ সমস্ত হাদীস সহীহ সূত্রেই ছিল। অর্থাৎ প্রথম দিকের ১, ২ বা ৩ জনের সূত্রেই শরীয়তের ইমামগণ হাদীসটি প্রাপ্ত হয়ে শরীয়ত প্রণয়ন করে ফেলেছেন। ২০০ হিজরীর পর হাদীসের ইমামগণ সেসব হাদীস পেয়েছেন ৪, ৫, বা ৬ /৭ জনের সূত্রে। আর ৪, ৫ , ৬ বা ৭ম ব্যক্তির কোন দুর্বলতার কারণে পরবর্তী ইমাম সে হাদীসকে জইফ বলেছেন। তাছাড়া, সাহাবীগণের আমল এবং সমার্থক (শাহেদ ও মুতাবে‘) আরো হাদীস পাওয়া গেলে জইফ হাদীসও দলিলযোগ্য।
চার মাযহাবের সব আমল দলিলভিত্তিক
এ কথাটি আমরা বিশ্বাস করি। এর সমর্থনে সলফে সালেহীনের অনেক বক্তব্য আছে। যেমন মহান ইমাম শাফেঈ (র.) এর বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘আমি ফকীহগণের বিরোধপূর্ণ প্রায় সকল মতের অনুকূলে কুরআন ও হাদীসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দলিল বিদ্যমান পেয়েছি’। -আর রিসালাহ)
পিসটিভি বাংলা এবং অন্যান্য কিছু ইসলামী প্রোগ্রামের সম্মানিত আলোচকগণকে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নিম্নোক্ত বক্তব্যটি অনুধাবনের আহ্বান জানাই। তিনি বলেছেন, “হাদীসের গ্রন্থাবলী সংকলিত হওয়ার পূর্বকালের ফকীহগণ (ইমাম আযম ও ইমাম মালেকগণ) হাদীসের সংকলকদের (ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিমগণ)
তুলনায় রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত ছিলেন। এমন অনেক হাদীস তাঁদের নিকট সহীহ প্রমাণিত হয়েছে যা আমরা মোটেও জ্ঞাত নই অথবা আমরা তা পেয়েছি অপরিচিত বা বিচ্ছিন্ন সনদে কিংবা তা পূর্ণাঙ্গভাবে আমাদের নিকট পৌঁছেনি। কারণ তাদের সংকলন ছিল তাঁদের মহান বক্ষ যা পরবর্তী সংকলনগুলোর চেয়ে অনেকগুণ বেশি হাদীস ধারণ করে রেখেছিল।” (শায়খ আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়া, রাফউল মালাম আন আইম্মাতিল আ’লাম, মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, রিয়াদ, পৃষ্ঠা -৩৫, ২০১২ঈ.)
বিশ রাকাআত আদায় করা ঝুঁকিমুক্ত। ৮ রাকাআত আদায়কারীদের না তারাবীহ হচ্ছে, না সঠিক সময়ে তাহাজ্জুদ হচ্ছে!
মহান সাহাবাগণের ইজমা, বিগত ১৪৩০-৩২ বছরের উম্মতের আমল এবং বর্তমানে হারামাইন শরীফাইনের আমল উপেক্ষা করে এ দেশীয় লা-মাযহাবী ও সুবিধাভোগী টিভি বক্তাদের কথায় তারাবীহ মনে করে ৮ রাকাআত পড়া ঝুঁকিপূর্ণ। জীবনভর সাহাবাগণের আমলকে উপেক্ষা করে ১২ রাকাআত কম যারা পড়বেন কুরআন শরীফও কম শোনবেন, পরকালে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। যদি তারাবীহ পড়তে হয় তাহলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ রাকাআতই পড়তে হবে। তর্কের খাতিরে বলা যায়, যারা ২০ রাকাআত পড়ছেন তাদের উভয় সংখ্যা বা বর্ণনার উপর আমল হয়ে যাচ্ছে। ৮ রাকাআত আদায়কারীদের না তারাবীহ হচ্ছে না সঠিক সময়ে তাহাজ্জুদ হচ্ছে !
উম্মতের সকল যুগে ২০ রাকাআত পড়ার কারণে সারা বিশ্বের হাফেযি কুরআন শরীফ ২০ পৃষ্ঠায় ছাপা
সউদি আরবসহ সারা বিশ্বের হাফেযি কুরআন শরীফ ২০ রাকাআত তারাবীহর সুবিধার্থে ২০ পৃষ্ঠা করে একেক পারা ছাপানো হয়েছে। এটাও ২০ রাকাআত তারাবীহর একটা দলিল।
আরবের সাধারণ মসজিদগুলোতে সাধারণত ৬, ৮, ১২ রাকাআত পড়া হয় কেন?
নামাযের প্রতি ক্রমবর্ধমান উদাসীনতা বা শিথিলতার কারণে। অনেক ক্ষেত্রে, সেখানকার বা এখানকার সাধারণ আলেমদের ফিক্হ ও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। আমি পড়াশোন ও কাজের জন্য আরব দেশসমূহে ছিলাম। দীর্ঘ দিন মহল্লার এসব মসজিদে তারাবীহ পড়েছি এবং ইমামসহ বিশিষ্ট মুসল্লীদের জিজ্ঞাসা করেছি যে সাহাবাগণের আমল, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদসহ শ্রেষ্ঠ আলেমদের রায় ও আমল বাদ দিয়ে তোমরা মহল্লার মসজিদে ৬, ৮, ১২ রাকাআত ইত্যাদি পড় কেন? তারা স্বীকার করেছে যে, সত্যি কথা বলতে কী! আমাদের মধ্যে তাসাহুল তথা আমলের ব্যাপারে শিথিলতা বা উদাসীনতা জন্ম নিয়েছে। দিনে দিনে এমন হয়েছে যে, লোকেরা মসজিদেই আসতে চায় না। যখন আসে, কোন রকম ফরযটা আদায় করেই চলে যায়। রমযানে ২০ রাকাআতের জন্য থাকবে না বিধায় আমরা তাহাজ্জুদ বা কিয়ামুল্লাইল হিসাবে ৮/৯ রাকাআত পড়িয়ে ছেড়ে দিই। যার ইচ্ছা হয় সে বাড়ি গিয়ে বাকি নামায পড়ে। তবে সউদি আরবে ২ হারামে গেলে ঠিকই ২৩ রাকাআত পড়ে এবং মধ্য রাতের পর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ হিসাবে ৮ বা ১২ রাকাত পড়ে। পাঠক লক্ষ করুন! ওখানকার আলেমরাও ২০ রাকাতের পক্ষপাতী। কিন্তু অবনত পরিস্থিতির কারণে তারা সঠিক আমলটি করতে বা করাতে পারছেন না।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া র.-এর অভিমত
যদি কেউ তারাবীহ নামায ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিঈ ও আহমাদ (র.)-এর মাযহাবমতে ২০ রাকআত আদায় করে অথবা ইমাম মালিকের মাযহাব মতে ৩৬, ১৩ বা ১১ রাকআত পড়ে তবে সে উত্তম কাজ করলো।
(আল-ফাতওয়া আল-কুবরা, দারুল কুতুব আল - হাদীসা, মিসর, বাব সালাতিত তাতাব্বু, ৪খ. পৃ.৪২৭)
মহানবী সা. রমযান ও গাইরে রমযানের রাতে ১১ রাকআত অথবা ১৩ রাকআত নামায পড়তেন, তবে তা আদায় করতেন দীর্ঘ কিয়াম সহকারে। যখন (দীর্ঘ কিয়াম) লোক জনের জন্য কষ্টকর হলো তখন হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. উমার ইবনুল খাত্তাব রা.এর যুগে ২০ রাকআত আদায় করতেন, এরপর বিতর নামায পড়তেন, তবে কিয়াম করতেন সংক্ষিপ্ত (ফাতাওয়া আল-কুবরা, বাব ফী মান ইউসাল্লিত তারাবীহ বা’দাল মাগরিব, ১খ, পৃ ,১৭৬, মাসআলা নং-১৩৮)
আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. তার ফাতওয়ার আরেক জায়গায় লিখেছেন, প্রমাণিত হলো যে, উবাই ইবনে কা’ব রা. কিয়ামে রামাদানে (রমযানের নৈশ ইবাদতে) লোকজনকে নিয়ে বিশ রাকআত আদায় করতেন এবং তিন রাকআত বেতের নামায পড়তেন।
অতএব অধিকাংশ আলেমের মত হলো, এটাই সুন্নাত। কারণ তিনি তা কায়েম করেছেন প্রাথমিক যুগের মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের মাঝে। অথচ কোন প্রতিবাদকারী তার প্রতিবাদ করেননি। অন্যরা ৩৯ রাকআতকে মুস্তাহাব বলেছেন। এই ভিত্তিতে যে, তা মাদীনাবাসীদের পুরোনো আমল। আরেক দল বলেছেন, সহীহ রিওয়ায়াত অনুযায়ী প্রমাণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ স. রমযান ও অন্যান্য মাসে ১৩ রাকআতের বেশি পড়তেন না। একদল লোক উপরোক্ত হাদীসের ভিত্তিতে মতভেদ করেছেন এবং পূর্বোক্ত আমলকে সহীহ হাদীসের বিপরীত মনে করেছেন। আসলে সঠিক হলো, এর সবগুলোই (৩৬, ২০, ১৩, ১১) উত্তম (মাজমুউল ফাতাওয়া, ২৩খ, পৃ. ১১২-১১৩, বাব নিযাইল উলামা ফী মিকদারি কিয়ামে রামাদান, খ- ১ম, রিয়াদ)।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. অন্যত্র বলেছেন, কিয়ামে রামাদান তথা তারাবীহ নামাযের রাকআত সংখ্যা মহানবী স. নির্ধারিত করেননি। তিনি রমযান ও অন্যান্য মাসে ১৩ রাকআতের অধিক পড়তেনা না। কিন্তু তার রাকআতগুলো ছিল অতি দীর্ঘ।
হযরত উমার রা. মুসলমানদেরকে যখন উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর ইমামতিতে একত্র করলেন তখন তিনি তাদের কে নিয়ে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়তেন, তারপর তিন রাকআত বিতর পড়তেন।
নিঃসন্দেহে মহান খুলাফাগণের আমল ও নির্দেশনা উম্মতের জন্য অবশ্য পালনযোগ্য। কেননা, প্রিয়নবী সা. বলেছেন, আলাইকুম বিসুন্নাতী ওয়া সুন্নাতিল খুলাফাইর রাশিদীন আল মাহদিয়্যীন, আদ্দু আলাইহা বিন নাওয়াজিয। অর্থাৎ তোমাদের ওপর কর্তব্য হলো, আমার ও খুলাফায়ে রাশিদীন এর আদর্শ অনুসরণ করা। তোমরা এসবকে সুদৃঢ়ভাবে কামড়ে আকড়ে ধরে থাক।
উপসংহার
তাই আসুন আমরা সকলে নিজ নিজ এলাকায় জনগণকে নিয়ে নিজ নিজ মহল্লার মসজিদে বিশ রাকআত তারাবীহর জামাআত কায়েম করে বিশ রাকআত ফরযের সমান সওয়াব ও মর্যাদা লাভে সচেষ্ট হই। একই সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মহান সাহাবীগণের আমলের ক্ষেত্রে মানুষকে বিভক্ত না করি। আহলে হাদীস বা তাদের সুবিধাভোগী টিভি আলোচক ভাই ও বন্ধুগণ! দেড় হাজার বছরের ইবাদত বন্দেগীর ধারা ও ঐক্যকে বিনষ্ট না করে দীন ও ঈমান বিরোধী অন্যান্য কাজ ও নাফরমানির ব্যাপারে দর্শক ও শ্রোতাদের সতর্ক করুন। এতে সকলের উপকার হবে। দীনের বিস্তার ঘটবে। আহলে হাদীস মসজিদের ইমাম-খতিবগণ! আপনাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী হিসাব করলে এদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়!
এ পরিসংখ্যান কি আপনাদের জন্য সুখকর?
একান্তই যদি কারো ব্যতিক্রমী কিছু করতে ইচ্ছা জাগে তাহলে তা নিজ বাসায় বা ঘরে ইনফিরাদিভাবে করি। আল্লাহ আমাদের দীনের সঠিক চেতনা ধারণের তাওফিক দিন। আমীন। ওয়া সাল্লাল্লাহ আলা নাবিয়্যিনা ওয়া ‘আলা আসহাবিহী ওয়া সাল্লাম।
লেখক: মুহাদ্দিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।