পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
টোকাই, মস্তান, সম্রাট, মাফিয়া প্রভৃতি আমাদের সমাজে বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় শব্দাবলী অতিগুরুত্বপূর্ণ ও বহুল প্রচারিত। টোকাই শব্দটি বাংলা সংস্কৃতি বা বাংলা অভিধানে সদ্য আমদানিকৃত। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর এখন অনেক অনেক সমাদর। টোকানী থেকে টোকাই শব্দের উৎপত্তি। মানুষের অপ্রয়োজনীয় বা মূল্যহীন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে সের দরে বিক্রি করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তারাই টোকাই বা টোকানী নামে পরিচিত। খ্যাতিমান কার্টুনিস্ট রনবীরের আঁকা একটি কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ‘টোকাই’ শব্দটি আলোচনায় আসে। টোকানী এখনো আছে, তবে টোকানী থেকে টোকাইদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, টোকাইরা এখন সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক Violence এর সঙ্গে জড়িত হয়ে টোকানীদের চেয়ে অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। টোকানীদের গন্তব্যস্থল ভাঙ্গারীর দোকান পর্যন্ত। অন্যদিকে বর্তমানে টোকাইদের অবস্থান অনেকটা এগিয়ে, কারণ তারা এখন জমি দখল, সন্ত্রাস ও রাজনীতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। টোকাই পৃথিবীর উন্নত দেশেও রয়েছে, যাদের অন্যতম পেশা চুরি, ছিনতাই, যারা সাধারণতঃ Street Boy হিসাবে চিহ্নিত। আদালতের ভাষায় তারা Deliquent। বিগত সময়ে দুটি সরকার বাংলাদেশে টোকাইদের সুস্থ ভাবধারায় নিয়ে আসার জন্য ‘পথশিশু’ ও ‘পথকলি’ নাম দিয়ে তাদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও সংশ্লিষ্ট সরকারের ইতিটানার সাথে সাথে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে।
London Kings College--এর একজন শিক্ষয়ত্রী Sally Atkinson Sheppard ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন বছরের মতো অবস্থান করে বখে যাওয়া শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি ২২ জন Street
Children,, পুলিশ, সমাজকর্মী, বিচার বিভাগসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ৮০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে মতামত প্রদান করে টোকাই বা Street
Children দের Illicit child Labour বলে আখ্যায়িত করেছেন (সূত্র: The gangs
of Bangladesh)| Sally Atkinson
Sheppard এর গবেষণা মতে, তিনি বাংলাদেশে মাফিয়া চক্রের সন্ধান পেয়েছেন যাদের তিনি ইংরেজি ভাষায় Mastaan (মস্তান) নামে অভিহিত করেছেন। ‘মস্তান’ বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নয়, বরং ভারতে অভিধানিকভাবে হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি থেকে এর উৎপত্তি। মুম্বাই থেকে রিলিজ হওয়া সিনেমাতে মাস্তানের ভ‚মিকা প্রকাশ পায়। কিন্তু কার্যত মস্তান বলতে তার গবেষণায় llicit
child Labour অর্থাৎ অবৈধ কাজে ব্যবহৃত শিশু শ্রমিকদের গডফাদারদের বুঝানো হয়েছে। এ গবেষকের মতে, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, ভ‚মি দখল, হত্যা ও রাজনৈতিক দাঙ্গা হাঙ্গামা করার জন্য মস্তানরা টোকাই বা রাস্তার শিশুদের ভাড়া করে ব্যবহার করে।
২০১০ সালে Urban Crime and Violence
in Dhaka নামকরণে প্রকাশিত বইতে উল্লেখ করা হয়, মস্তানরা পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি ও অব্যাহত রাখে। উক্ত গবেষকের মতে, মস্তানদের থেকে পুলিশ নিয়মিত টাকা পেয়ে অবৈধ কাজের বৈধতা প্রদান করে। তিনি আরো মনে করেন যে, রাজনীতিবিদরা তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য মস্তানদের ব্যবহার করে। তার ভাষায়: Mastaans operate
under the shelter of god father, who
are mainly Ministers, Members of
Parliament and Business leaders.. অর্থাৎ মস্তানরা গডফাদার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যাদের মধ্যে মন্ত্রী, পার্লামেন্ট সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতারা রয়েছে।
২০১২ সালে UNICEF কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ একটি LEAST DEVELOPED NATION এবং জনগোষ্ঠির অধিকাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের মতে, ঢাকার ১৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১০ মিলিয়ন রাস্তাঘাটে বা বস্তিতে বসবাস করে, যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা বা বেঁচে থাকার জন্য ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং টিকে থাকার জন্য যাদের Straggle করতে হয়। ঐ সব পরিবারের শিশু সন্তানরাই নিজেরা অবৈধ কাজের শ্রমিক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে নিজেরাই এক সময় টোকাই থেকে মস্তানে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ ২০ জন Top Terrorists এর নাম প্রকাশ করেছে, যাদের অধীনে শতাধিক টোকাই রয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে মস্তানদের নির্দেশ মোতাবেক অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে অর্থ রোজগার করা। ২০১০ সালের ৩১ মার্চ The
Daily Star পত্রিকায় Crime gants grip
city শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে প্রকাশ পায় যে, ডাকাত শহীদ ১২০ জনের একটি অপরাধী চক্র লালন-পালন করতো। পত্রিকা উল্লেখ করে, That dakat Shahid managed a criminal group that consisted of over
120 members.. উক্ত আর্টিকেলে এটাও প্রকাশ পায় যে, মস্তানদের নিয়ন্ত্রণে বস্তিভিত্তিক অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের অধিকাংশই পথ শিশু বা টোকাই। উক্ত অপরাধী চক্র বিভিন্ন নামে বিশেষ করে দলনেতার নামে প্রথম অক্ষর দ্বারা পরিচিত। যেমন 'P' Group, 'R' Group প্রভৃতি। মাস্তানদের কাজ হচ্ছে টোকাইদের দ্বারা অপরাধ ও Violence সংগঠিত করে তাদের প্রটেকশন দেয়া। চাঁদাবাজি, চুক্তিভিত্তিক খুন, জমি দখল, দোকান দখল, ফুটপাত দখল প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থ সম্পদের মালিক হওয়াই মস্তানদের একমাত্র উদ্দেশ্যে এবং এরা অধিকাংশই মাফিয়া চক্রের অধীনে কাজ করে। এসব বেআইনী কাজ করার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পুলিশ ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে। রাজনৈতিক দল পরিচালনা, ব্যায়বহুল নির্বাচনের অর্থের যোগান দেয়ার জন্য মস্তান বা মাফিয়ারা স্বেচ্ছায় ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করে প্রচুর ক্ষমতা ও অর্থের মালিক হয়। মস্তানরা সরকারি ও বিরোধীদলে যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি আছে তাদের অনেককেই আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। যে দল ক্ষমতায় আছে এবং যে দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে তাদের সকলকেই মাফিয়ারা আর্থিক যোগান দেয়। ক্ষমতাবানদের দেয় প্রকাশ্যে এবং সম্ভাব্য ক্ষমতাধরদের দেয় গোপনে। এভাবেই মস্তান ও মাফিয়ারা অনেক শক্তিধর।
গবেষক Sergi A (২০১৫) এর মতে, Mafia
and Polities as concurrent government
actor এবং তাদের Concurrent goverance এর এখতিয়ার বা অধিক্ষেত্র রয়েছে। Concerance
Juridection বলতে এক সাথে চলাকে বুঝায়। খারাপ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মস্তানদের দ্বারা বিভিন্ন এলাকা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তার ব্যাখ্যায় গবেষক উল্লেখ করেন: (1) It demonstrates
that mastaan groups in Dhaka work
in collusion with corrupt politicians,
(2) It shows that street children are
aware of organised crime, this means
that it infiltrates life on the streets and
that young people share information
about mastaans with their peers and
presumably the adults in their lives
& (3) It reveals children’s knowledge
of the connection between mastaans
and politics, this shows that, even at
a young age, children are able to call
into question the authority of corrupt
politicians.. এ তথ্য ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে Asian Journal of Criminology প্রকাশিত হয়।
একশ্রেণির রাজনীতিকদের সঙ্গে মস্তানদের সম্পর্ক ওতপ্রোত ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের প্রধান টার্গেট ‘ক্ষমতা’ (Power) এবং বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ‘জাতীয় নির্বাচন’ নামক একটি প্রহসনমূলক নাটকের মাধ্যমে এখন ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সন্ত্রাসী বাহিনী, যারা বাহুবলে কেন্দ্র দখল করে সিল মারতে পারে। মাফিয়া, মস্তানদের হাতে প্রচুর পরিমাণ টাকা এবং অবৈধ অস্ত্র যেহেতু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে সেহেতু সন্ত্রাসী-মস্তানদের উপর রাজনীতিবিদরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়ে মস্তানরা পালাক্রমে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবী শিকার করে নিচ্ছে, ফলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন প্রকাশ্যে রূপ ধারণ করেছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মদদ ছাড়া মস্তান বা মাফিয়া হিসাবে গড়ে উঠা সম্ভব নয়। দেশে প্রচলিত আইনগুলি অনেক কঠিন। এর প্রয়োগ হয় প্রধানত রাজনৈতিক প্রভাবে। ফলে করাপ্ট রাজনীতিবিদদের নিকট জাতি ও রাষ্ট্র অসহায় হয়ে পড়েছে। সরকার নিজেই যেখানে কেন্দ্র দখলের রাজনীতি করে, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য মস্তান ও পুলিশ তথা আইনকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করে, সেখানে এ অপব্যবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা অত্যন্ত কঠিন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় অর্থ ও প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।