পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যে বয়সে বই হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে শুধুমাত্র জীবিকার জন্য দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু-শহর-গ্রামের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহস্থলী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুসুলভ আচরণগত কারণে কিংবা ছোটোখাটো ভুলের জন্য প্রতিনিয়তই তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের মাত্রা অনেক সময় চরম নির্মমতায় পৌঁছায়। নির্দয় নির্যাতনের ফলে অকালে ঝরে যায় অনেক প্রাণ। যা অনভিপ্রেত, অপ্রত্যাশিত। আমাদের দেশে শিশু-গৃহকর্মী নির্যাতন আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে। মাঝে-মধ্যেই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। শিশু-গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিদিনই। যা বছরে কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এদের অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে। শিশু-গৃহকর্মী নির্যাতন বা হত্যা বা আত্মহত্যার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। অনেক শিশু-গৃহকর্মীকে হত্যার পর গৃহকর্তা বা কর্তীকে বাঁচাতে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ লেনদেনের কথা শোনা যায়। বিশেষজ্ঞরা শিশু-গৃহকর্মীদের বিষয়ে আলাদা চিত্র চিত্রায়িত না করলেও শিশু-শ্রমিকের বিষয়ে তাদের গবেষণা রয়েছে। এই শিশু-শ্রমিকদের মধ্যে শিশু-গৃহকর্মীদের গোত্রভুক্ত করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের রাজধানী ঢাকাতেই শিশু-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ৮ হাজার যার মধ্যে ৩ লাখ ৮৭ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। জীবনের তাগিদে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে কোমলমতি এসব শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। ফলে তারা নানা রকম শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে- এমনকি মৃত্যুবরণও করছে। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী সারাদেশে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে। ২০০২-০৩ সালে এই জরিপ করা হয়। এরপরে আর কোনো শিশুশ্রম জরিপ হয়নি এদেশে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩শ’ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪১.৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ জন শিশু যাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছর বয়সী গৃহশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৩১ হাজার। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। অথচ এই বৃহৎ শ্রমক্ষেত্রে শ্রমিকদের পরিচালনা বা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই কোনো সরকারী নীতিমালা। তবে একটা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি ও এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু-শ্রমিক। এই নারী ও শিশুরাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অব রিসার্চ, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ চিল্ডেন কালচারাল ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, নগরায়ন ও শিল্পায়নের পাশাপাশি জীবন-জীবিকার কারণে মানুষ আজ শহরমুখী। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গঠিত হচ্ছে। এসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী প্রায়ই কর্মরত থাকে। সেক্ষেত্রে গৃহকর্মী রাখা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক দারিদ্র্যের কষাঘাতে যখন একজন পিতা সন্তানদের ভরণ-পোষণে ব্যর্থ হন কেবল তখনই তার সন্তানকে বাইরে কাজ করতে পাঠান। ফলে শিশুটির পক্ষে পারিবারিক আবহাওয়াতে থাকা সম্ভব হয় না। অল্প বয়স থেকে সে অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করে। সেই অপরিচিত পরিবেশের মানুষেরা যদি হয় নিষ্ঠুর, তাহলে তার অস্তিত্ব রক্ষা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যখন একটি শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রস্ফুটিত হওয়ার সময় তখন অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট হয়। এসব শিশুর অভিভাবক যেমন ১০-১৫ বছর ধরে একজন শিশুর লেখাপড়া চালানোকে অলাভজনক মনে করে, তেমন গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীও নিজের সংসারের কাজকর্মের বাইরে স্কুলে যাওয়া মেনে নিতে পারেন না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ (বিলস) সূত্রে জানা যায়, বাসার কাজের মেয়েদের ওপর নির্যাতন এবং আত্মহত্যা সম্পর্কে কয়েক বছর পূর্বে সীতাকুন্ডু থানার তখনকার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহেদ আলীর বাসায় ১০ বছরের রোমেলা খাতুন নির্যাতনের শিকার হয়। রোমেলা খাতুন গৃহকর্মীর কাজ করত পুলিশ অফিসারের বাসায়। পান থেকে চুন খসলেই তার পিঠের চামড়া আর অক্ষত থাকত না। প্রতিনিয়ত সে নির্যাতনের শিকার হতো। লাগাতার মারধরে মেয়েটি ক্ষত-বিক্ষত হয়, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পাবনার এই মেয়েটি কয়েকবার আত্মহত্যারও ব্যর্থ চেষ্টা করে। একবার বেধড়ক পিটুনিতে তার মুখ কেটে গেলে শাহেদ আলীর স্ত্রী সুইটি বেগম নিজেই কাপড় সেলাইয়ের সুঁই-সুতা দিয়ে সেই কাটা সেলাই করে দেন। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে গৃহকর্মীদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কয়েক হাজার। এর মধ্যে নির্যাতনে নিহত হয়েছে ৩৯৮ জন, মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ২৯৯ এবং অন্যান্য নির্যাতনে শিকার প্রায় সহস্রাধিক। গৃহকর্মীরা মারা যাওয়ার পর গৃহকর্তা বা গৃহকত্রীর কাছ থেকে পুলিশ টাকার বিনিময়ে তা অপমৃত্যু ও আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছে বলে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের দাবি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে যে, গৃহশ্রমিকদের কারোরই নিয়োগ চুক্তি নেই। তাদের গড় মজুরি ৫০৯.৬ টাকা। এরমধ্যে নিয়মিত মজুরি পায় ৬০ শতাংশ এবং অনিয়মিত মজুরি পায় ৪০ শতাংশ। এত অল্প মজুরিতেও নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে তারা। এরমধ্যে ৬৬.৬৭ শতাংশ শিক্ষার সুযোগ এবং ৫৩.৩৩ চিত্তবিনোদনের সুযোগ পায় না। বকাঝকার শিকার হয় ৮৩.৩৩ শতাংশ, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৪৬.৬৭ শতাংশ, সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ করে ৬৩.৩৩ শতাংশ, যৌন-নিপীড়ন সহ্য করে ১৬.৬৭ শতাংশ, মানসিক হতাশায় ভোগে ৬৭.৬৭ শতাংশ গৃহশ্রমিক। গৃহশ্রমিকের ঘুমানোর জন্য যথার্থ স্থানও দেয়া হয় না। ড্রইংরুমে ২০ শতাংশ, রান্নাঘরে ৩৩.৩৩ শতাংশ, বারান্দায় ১৬.৬৭, স্টোর রুমে ৩.৩৩, বেড রুমের মেঝেতে ২০.৬৭ এবং আলাদা রুমে ৬.৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী ঘুমায়। বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রীর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাসা-বাড়ির কাজে নিযুক্ত ৯৫ শতাংশ শিশু গৃহকর্তা বা গৃহকত্রীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবারের প্রধান কর্তা ছাড়া নির্যাতনকারীদের ৩০ শতাংশ পরিবারের অন্যান্য সদস্য। এসব শিশুর মধ্যে ৫২ শতাংশ নিয়মিত নির্যাতিত হয়। মৌখিক (গালি) নির্যাতনের শিকার হয় ৯৫ শতাংশ। আর ৮৬ শতাংশ শিশু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়। ৯৩ শতাংশ নিয়মিত খাবার পায়, আর ৮২ শতাংশ পরিবার সময় মতো খাবার দেয়।
উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন ও গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ এই সনদে অনুসমর্থন করে আইন বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার গ্রহণ করে। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ‘শিশু আইন ১৯৭৪ প্রবর্তিত হয়। এখানে শিশুর সংজ্ঞা, শিশুর বয়স, তার অধিকারের পরিধি প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শিশু বা কিশোরদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার জন্য শর্তাধীনে নির্ধারিত হালকা কাজে নিয়োজিত করার বিধান রয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ এর আলোকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই নীতি অনুযায়ী যেসব শিশু দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় কাজ অথবা বিনা মজুরি, অনিয়মিত মজুরি, স্বল্প মজুরিতে কাজ করে এবং বাধ্য হয়ে কাজ করে সেসব ক্ষেত্রে মালিক, নিয়োগকর্তা, শিশু এবং শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিয়োগ না করা। তাদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়া, আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা করার শর্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়। শিশুদের সপ্তাহে অন্তত একদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকবে। নির্দিষ্ট হারে নিয়মিত বেতন পাওয়ার অধিকারও তাদের থাকবে।
বাংলাদেশ চিনে কালচারাল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কোমলমতি শিশুরা বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ যে কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে। সংসারের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা ছাড়াও সন্তান পালন, পানি তোলা, ঘর মোছা, হাড়িবাসন ও কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা, সবজি কাটা, বাটনা বাটা ইত্যাদি। বিনিময়ে তারা পায় ন্যূনতম খাবার সংস্থান (যার বেশিরভাগই উচ্ছিষ্ট, পচা-বাসী খাবার), ব্যবহৃত পোশাক পরিচ্ছদ, তারা ব্যবহার পায় ক্রীতদাসের মতো। তাদের ঠিক মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। তাদের হাসতে মানা, তাদের কাঁদতে মানা, তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে মানা, তাদের পড়াশোনা করতে মানা। শুধু কি তাই, আরো আছে চলাচলের ওপর থাকে কড়া নজরদারি। তাদের বোবা ভাষাগুলো চার দেয়ালে গুমরে গুমরে কাঁদে। অনেক সময় গৃহকর্তা-গৃহকত্রী তাদেরকে তালাচাবি বন্ধ করে কর্মক্ষেত্রে যান। ফলে কার্যত তাকে কারাজীবন মতো কাটাতে বাধ্য হয়। তাদের অধিকার, পাওনার কথা খুব কমই গোচরে আসে। গোচরে আসে কেবল তখনই, যখন তারা মৃত্যু শয্যায়। যে মা-বাবা তাদের প্রিয় সন্তানকে অভাবের তাড়নায় বাসায কাজ করতে পাঠায় তারা মনে করে হয়তো ভালোই আছে তাদের আদরের সন্তান। তবে বাস্তবতা হলো দুটির জায়গায় তিনটি মরিচ পোড়ানোর জন্য, ভাত বেশি গলে বা পুড়ে গেলে, গৃহকত্রীর সন্তান একটু আঘাত পেলে, প্লেট ভেঙে ফেললে, আরো কত রকম কারণে একজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয় তার হিসাব কেউ রাখে না। অনেক সময় তারা যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে আমরা নির্যাতনের যেসব চিত্র দেখতে পাই তার সবই মধ্যযুগীয় বর্বরতা। অথচ এরা অধিকাংশ শিক্ষিত পরিবারে কাজ করে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে রয়েছে, তোমরা নিজেরা যা খাবে-পরবে, কাজের লোকদেরও তাই-ই খেতে পরতে দেবে। ইসলামে তাদের হক ও অন্যের ব্যাপারে অবহেলাকে জুলুম বলা হয়েছে। অথচ ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে সেই কবে। কিন্তু মানুষের মনে প্রভুত্ব করার বাসনা মরে যায়নি আজও। তাইতো অসহায়, নিরীহ গৃহকর্মীদের ওপর চলে স্টিমরোলার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।